মারুতি সুজুকি কারখানার শ্রমিকদের যাবজ্জীবনের সাজার পটভূমিতে, কারখানা শ্রমিকের দিকে তাকিয়ে …

ভোলা মজুমদার@
প্রতিদিন সকালে উঠে কাছে পাওয়া সব প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিরলসভাবে তৈরি করে যাওয়া বিশ্বের প্রতিটি শ্রমিক বন্ধু। শ্রমের দাসত্বের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলনে সামিল প্রতিটি মানুষ। নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার প্রতিটি নিরপরাধ শ্রমিক। আর কাজ করতে চেয়েও কারখানার গেট-এ এসে ফিরে যাওয়া আপামর শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের দাসত্বের মুক্তির অভিপ্রায় নিয়ে। আর ‘মারুতি সুজুকি’ কারখানার আন্দোলনের ফলে অভিযুক্ত সকল শ্রমিকের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার দাবিকে সম্মান জানিয়ে সকল ‘শ্রমিক’দের উদ্দেশ্যে এই লেখা।

শ্রমিক নয়, তুমি শিল্পী হয়ে ওঠো।
মুক্ত করো শ্রমের দাসত্বের শৃঙ্খল।।

=============================
আদিম প্রস্তর যুগ থেকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে শ্রম করে এসেছে, তা শিকার করার জন্যই হোক বা বন্যপ্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্য। শ্রম কমবেশি প্রতিটি সুস্থ মানুষকেই করতে হয়েছে। সে উৎপাদক হোক বা উৎপাদনের মালিক উভয়কেই, শ্রম ছাড়া পৃথিবীতে টিঁকে থাকাটাই বাস্তবিক অসম্ভব। তাহলে শ্রমের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা কোথায়! কাঁচামালকে দ্রব্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায়। ‘শ্রম’ মানসিক প্রক্রিয়ায় দৈহিক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ শ্রমের সাথে মানসিক ও দৈহিক দুটি পার্থিব প্রক্রিয়ারই সম্পর্ক আছে। একটি অন্যটির পরিপূরক, কিন্তু সভ্যতা যতই এগিয়েছে, পৃথিবীতে জ্ঞানের চর্চা বেড়েছে, দৈহিক ও মানসিক শ্রম একে অন্যের থেকে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে। ক্রমেই দৈহিক শ্রমের চেয়ে মানসিক শ্রমের গুরুত্ব বেড়েছে, মূল্যও বেড়েছে। কিন্তু মানসিক শ্রম তো একটি ধারনার জন্ম দিতে পারে, কল্পনায় ছবি আঁকতে পারে, কিন্তু তার বাস্তবিক রূপ দিতে তো দৈহিক শ্রমের প্রয়োজন, তাকে তো অস্বীকার করা যায় না।

দৈহিক প্রক্রিয়াটি যেহেতু দৃশ্যমান তাই শ্রমের সাথে দৈহিক কথাটি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের মনে এইরকম ধারনা জন্মেছে যে, আমরা যত দ্রুততার সঙ্গে কাঁচামালের সাথে দৈহিক শ্রমকে যুক্ত করতে পারব ততই তাড়াতাড়ি আমরা কল্পিত বস্তুটির রূপ দিতে পারব। কিন্তু কাঁচামাল থেকে বস্তুতে রূপান্তরের জন্য শ্রমিকের শুধু হাত-পা থাকলেই তো চলবে না, তার একটা সুস্থ সবল মাথারও প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দৈহিক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও তার গুরুত্ব স্বীকার করি না। তাহলে জ্ঞানের আলোকে আলোকিত মানুষজনের সাথে দৈহিক শ্রমের মানুষের তফাত রইল কোথায়! মানুষ যেহেতু, তাই তফাত তো থাকবেই, কিন্তু মূল্যের বা গুরুত্বের ফারাকই তো আসলে দ্বন্দ্বের কারণ। প্রকৃতিতে তো আর সব গাছ সুন্দর বাগানে জন্মায় না, কিছু কিছু ঝোপঝাড়ে, নোংরা জায়গায়ও জন্মায়। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় যোগান কিন্তু সে লড়েই আদায় করে নেয়। আর প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন দিয়ে যায়। তাই দুটি মানুষকে আলাদা চোখে দেখার ফারাক যেন না তৈরি হয়।

মানুষের অসীম কল্পনার বাস্তবিক রূপ দিল মানুষের শ্রম। তাই ধীরে ধীরে উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ার নামই হয়ে উঠল শিল্প। মানবজাতি শ্রমিককে তার কারিগর হিসেবেই দেখে এসেছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বোধ হয় ধারনাটা এইরকম দাঁড়ায় যে ‘শ্রমিক’ আসলে শুধু কারিগরই নন। তিনি একাধারে শিল্পীও বটে। রং তুলির টানে চিত্রকর যেভাবে একটি সুন্দর ছবি তৈরি করে তেমনি শ্রমিকও একটি লোহার তালকে বদলে করে ফেলে হাতুড়ি। যার ভারী ও শক্ত ছোঁয়ায় তৈরি হয় হাজারো যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, যান। তাই কলকারখানা যদি হয় শিল্প, তবে একজন শ্রমিককেও আমরা শিল্পী বলতে পারি।

এদিক দিয়ে কৃষিজীবী এবং শ্রমিক আলাদা, কৃষিশ্রমিক, পরিষেবা শ্রমিক আর কারখানায় কাজ করা শ্রমিক আলাদা। ধান ‘ভগবান’-এর সৃষ্টি, সাবান মানুষের। কারখানা শ্রম সম্পূর্ণভাবে মানবিক কল্পনার বাস্তবায়নের জায়গা।

কিন্তু শিল্পী তো ছবি আঁকবে তাঁর পছন্দ মতো, তার ইচ্ছে মতো। সে তো কারো ‘দাস’ নয়। সে তো মুক্ত বিহঙ্গ। শ্রমিক যে দ্রব্যটি উৎপাদন করল তা আপামর মানুষের প্রয়োজনে লাগে। শ্রমিকের নিজের লাগে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। অর্থাৎ শ্রম হলো এমনই একটি দৃশ্যমান প্রক্রিয়া যা উৎপাদিত দ্রব্যকে দেখলে বোঝা যায় যে সেখানে শ্রম নিযুক্ত হয়েছে, কিন্তু শ্রমটি কে বা কারা করেছে বা কতটা শ্রম নিযুক্ত হয়েছে, তা পরিমাপ করা যায় না। অর্থাৎ শ্রমের কোনো মালিকানা নেই। শ্রমের শুধুই দাসত্ব আছে।

তাই মানুষের শ্রম ক্ষমতা যখন তার পুঁজিতে পরিণত হল, তখন ক্রমেই সে হয়ে উঠল তার ‘শ্রমের দাস’। ক্রমেই সে শিল্পী সত্ত্বা হারিয়ে পরিণত হয়ে গেল একজন শ্রমিক-এ। আর তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো যাবতীয় ভাবনার অধিকার। কল্পনার অধিকার। ক্রমে সে-ও হয়ে উঠল আর একটি যন্ত্র বিশেষ।

বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিকের অবস্থা এবং অবস্থান
———————————–
শ্রম-শ্রমিক সম্পর্ক, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, মুনাফা, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, ধর্মঘট, বিপ্লব — ইত্যাদি প্রভৃতি নানান কিছুর মধ্যে আলাদা করে একটি শ্রমিক-মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই সমাজে আর পাঁচটা মানুষের মতো একই। বিশ্বের প্রতিটি কোণে কোণে সমাজে প্রতিনিয়ত স্বাধীন হওয়ার যে লড়াই শ্রমিকরা চালায় তাই কিন্তু আন্দোলন। প্রতিটি মানুষের সাথে একই সারিতে আত্মমর্যাদা আদায়ের যে লড়াই চলে তাই কিন্তু আসলে সমাজ পরিবর্তনের গল্প।

কৃষি-কাজ ছেড়ে বা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত থাকতে থাকতে যারা কল-কারখানায় কাজে জোটে, তারা ক্রমে শ্রমিক হয়ে ওঠে। আগেই বলেছি, শ্রমই মানুষের কল্পনার রূপকার, উৎপাদনের কারিগর হয়ে ওঠে। ছোটো ছোটো কারখানায় সুযোগ সুবিধা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই। আর আমাদের দেশে এইরকম কারখানার সংখ্যাই বেশি। স্বাস্থ্য-পরিবেশ-নিরাপত্তা কোনো কিছুর প্রশ্নেই এই কারখানাগুলো যথার্থ নয়।

এইরকম ছোটো কারখানার শ্রমিকদের বলা হয় মিস্ত্রি। কেউ ছোটো-মিস্ত্রি তো কেউ হেড-মিস্ত্রি। খাবার খাওয়ার জায়গা তো দূর অস্ত, প্রস্রাব করার জায়গা পর্যন্ত নেই। যে মেশিনে যে কাজ করে টিফিনের সময় সেখানেই মাটিতে বসে হাতে থালা নিয়ে খাবার সেরে ফেলতে হয়। দুপুরে রাস্তার টাইম কলে মাথা গুঁজে স্নান করে খাবার খেয়ে আবার কাজে লেগে পড়ে শ্রমিকরা, মানে মিস্ত্রিরা। এইরকম শ্রমিকদের একটা অংশ যদি স্থানীয় হয়, তবে একটা বড়ো অংশ আসে দূর থেকে। তারা কিন্তু কাজের শেষে বাড়িতে ফিরে যায় না। মালিকের বাড়িতেই কিম্বা কারখানার মধ্যেই থেকে যায়। আলাদা কোনও শোবার ঘর নেই। কারখানারই ওপর মাচা করে রাত কাটানো। ২৪ ঘন্টা কারখানায় থাকার সুবাদে, মেশিনপত্রও এরা প্রায় ১৬ ঘন্টা চালিয়ে দেয়।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল নিয়ম কানুনের কোনো বালাই নেই। বদলে ঘরোয়া একটা নিয়ম আছে। যার জন্য শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে সুন্দর দাদা-ভাই মার্কা একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। আর এর ওপর ভিত্তি করেই এরা বছরের পর বছর কাজ করে যায়। সংসার চালিয়ে। ছেলে মেয়ে মানুষ করে। ছোটো শিল্পের নানান ওঠাপড়া মাথায় নিয়েই। মালিকের সঙ্গে সুখ দুঃখ বিনিময় করে। তাই ছোটো শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এই ধরনের কারখানাকে শ্রমিকরা ঘর বলে। লেদ-ঘর, কাস্টিং-ঘর, ফোর্জিং-ঘর, সেলাই-ঘর ইত্যাদি। এইরকম পরিবেশে কাজ করে হাজারো কষ্ট হয়ত আছে, কিন্তু কথায় কথায় গালিগালাজ দেওয়া বা ঘাড় ধাক্কা দেওয়া নেই। সপ্তাহ শেষে দেশের বাড়িতে ফিরে আবার সোমবার কাজে আসাও নেই অনেকসময়। একদিন বা দু-দিনের ছুটিকে অনায়াসেই তারা তিনদিন বানিয়ে নেয়। সপ্তাহ শেষে কাজ পুষিয়ে দিলেই হলো। এইরকম ছোটো ছোটো জায়গাতে মিস্ত্রিরাই সব। সেই অর্থে কোনো বাবুদের নজরদারি নেই। পূজো আচ্চা, পিকনিক এইরকম ছোটো ছোটো চাওয়া পাওয়ার হিসেবের মিলে অমিলে চলছে ছোটো শিল্প।

তুলনামূলকভাবে একটু বড়ো অর্থাৎ মাঝারি শিল্পের জায়গার ধরনটা একটু আলাদা। ছোটো শিল্পের চেয়ে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। তাই সেখানে অনেক বেশি যন্ত্র আর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রসঙ্গতঃ যন্ত্রের হাত ধরেই কিন্তু বড়ো বড়ো কল-কারখানার সৃষ্টি। আর তাই সেখানে অনায়াসেই হাজার হাজার মানুষ কাজ পেতে পারে। ২৪ ঘন্টায় তিন শিফটে কাজ হয়। ব্যবসার ওঠাপড়া যন্ত্র আর শ্রমিকের সাথে খুবই ওতোপ্রত ভাবে যুক্ত। তাই শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসে। শ্রমিক ইউনিয়ন যেখানে আছে, সেখানে নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন নেতারা থাকে, তেমনি যেখানে শ্রমিক ইউনিয়ন নেই, সেখানে গোষ্ঠীভিত্তিক ভাবে শ্রমিকরা কাজ করে। ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রণে শ্রমিকরা কাজ করে। উন্নততর যন্ত্রের ব্যবহারের সঙ্গে কর্মী-সংকোচনের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকলেও তার সাধারণীকরণ করা উচিত নয়। অতি আধুনিক কলকারখানায় কিন্তু প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। যন্ত্রের আধুনিকীকরণ দ্রব্যের সময়-উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন পদ্ধতি সহজ করে তোলা ও গুণমান বৃদ্ধিতে কাজে লাগে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ শ্রমিকেরা যেরকম প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, তেমনি মালিকদের একটা বড়ো অংশও কৃষি, কিংবা অন্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকা লোকজন। তারা আর পাঁচটা ব্যবসার মতোই উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পকেও একইরকমভাবে বিচার করে। তাই যে অর্থে কর্পোরেট শিল্প সংস্থার মতো অত কড়া নিয়ম কানুন বা আইন নেই, তাই সেই অর্থে শ্রমিকদের চোখে পড়ার মতো উন্নতি সাধনও নেই। শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে কাজ করে। একই গোষ্ঠীর শ্রমিকের মধ্যে কেউ ৭ ঘন্টা কাজ করলে অন্যজন ৯ ঘন্টা কাজ করে তা পুষিয়ে দেয়। সেই ক্ষেত্রে সুপারভাইজাররাও সেই দিকে খুব একটা নাক গলায় না। কাজ করতে করতে এক একজন করে ঘরে গিয়ে চপ মুড়িও খেয়ে আসে শ্রমিকরা। সাথে সুপার ভাইজাররাও তাতে ভাগ বসায়। এইরকম কারখানায় মালিক উৎপাদনের জন্য ম্যানেজার বাবুদের থেকে মিস্ত্রিবাবুদের ওপর বেশি ভরসা করে। মাসিক মজুরি এরা অনেক সময়ই ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে গোষ্ঠীভিত্তিক মজুরি নেয়। তারপর নিজেরা ভাগ যোগ করে নেয়। শ্রমিকদের যদি পোষায় তো তারা কাজ করে না হলে অন্যত্র চলে যায়। আবার প্রয়োজনে ফিরেও আসে।

বড়ো শিল্প বা কর্পোরেট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত শিল্পের বেশিরভাগটাই ব্যবস্থাপনা নির্ভর। নিখুঁত উৎপাদন কাঠামো। কারখানার কাঁচামাল ঢোকা থেকে ফিনিশ গুডস বিক্রি হওয়া যেন একটা সুন্দর শেকলে আবদ্ধ। তার যে কোনো একটি রিং ছিঁড়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়াটাই ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মালিক নয় ব্যবস্থাপনার অদ্ভুত এক নিয়ন্ত্রণশক্তি যেন প্রতি মুহুর্তে নিয়ন্ত্রণ করছে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই এমন একটা জাল করা আছে যে শ্রমিকরা চাইলেই তার থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে না। গতি আরো গতি সেখানে গ্রাস করেছে শ্রমিকের স্বাধীনতা। কিছু অটোমেটেড প্ল্যান্ট আছে যেমন, রিফাইনারি, পেট্রো কেমিক্যাল ইত্যাদি। দেখলে মনে হবে, অত বড়ো যখন তখন নিশ্চয়ই প্রচুর শ্রমিক কাজ করে। কিন্তু তা সত্যি নয়। এখানে উৎপাদনের প্রক্রিয়াটার মধ্যেই শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তার অভাব আছে। শ্রমিক অসন্তোষ তাই এখানে সেই অর্থে দেখা যায় না।

কিন্তু যেসব শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে যথেচ্ছ শ্রমিকের প্রয়োজন, সমস্যাটা সেখানেই। সমস্যা কেন? সমস্যা বলছি এই কারণেই যে উত্তপাদনের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তাই নিয়ে। কারণ এইসব শিল্প যতই প্রযুক্তি নির্ভর হোক না কেন, কারখানার অন্দরমহলের শ্রমিকদের ব্যক্তিগত প্রতিভার ওপর ভর ও ভরসা করেই এগিয়ে চলে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা না করা নিয়ে। আবার উল্টোদিকে শ্রমিকরা এটা ভালো করে ‘বুঝে’ নিয়েছে যে তারা যে কাজটি যেইরকম দক্ষতার সাথে করতে পারে ম্যানেজমেন্টের লোকরা তা চাইলেই করতে পারবে না। তাই অনেকাংশে তার ওপর ভর করেই শ্রমিকরাও দাবি দাওয়ার দর কষাকষি করে। করতে পারে। অর্থাৎ শ্রমিকের দক্ষতাই এখানে শ্রমিকের পুঁজি। শ্রম নয়। তাই এইরকম বড়ো মাপের শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করা অত সহজ নয়। তাই সেক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন নয় প্রতিনিয়ত শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করার একটি বাড়তি দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টের কাঁধে চলে আসে। একদিকে উৎপাদনের চাপ, অন্যদিকে শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করার নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে তা চালনা করা। আর তার সাথে সাথে উচ্চতর ম্যানেজমেন্টকে খুশি করা বা রাখা। এই ত্রিমুখী অবস্থার মধ্যে কারখানাগুলি চলে অনেকটা খাদের কিনারা দিয়ে হাঁটার মতো। এই মাপের শিল্পে জৌলুস যেমন আছে, আছে ভালো মজুরিও। তাই দক্ষ শ্রমিকরা বারবার করেই এখানে ছুটে আসে, তাদের দক্ষতার সঠিক ও প্রাপ্য মজুরি পাওয়ার আশায়। পায়ও। তাইতো ব্যবস্থাটা টিঁকে থাকে। যারা এই ব্যবস্থাটার সাথে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারে তারা ম্যানেজমেন্টের কাছের লোক হয়ে যায়। আর যারা এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না, কিন্তু তার হকের চাকরিতে থাকতে চায়, তারা প্রতিবাদ করে। আন্দোলন করে। চিৎকার করে। পালিয়ে না গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে।

মারুতি সুজুকির ঘটনার নির্মমতা
————————–
মারুতি কারখানার শ্রমিক আন্দোলন ও তার জের-এ একজন পার্সোনাল ম্যানেজারের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ায় কারখানার পরিবেশ, শ্রমিক আন্দোলনের দিশা যেমন বিভ্রান্ত হলো, তেমনি শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি সমাজের অন্য পেশার মানুষের সহানুভূতিও ধাক্কা খেল। কিন্তু মারুতি কারখানার ঘটনাপঞ্জি* থেকে একটা জিনিস খুব চোখে পড়ার মতো সেটা হলো প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে ১টি করে গাড়ি তৈরি হওয়া অর্থাৎ প্রতি শিফটে প্রায় ৫০০টি গাড়ি উৎপাদন। এই ভয়াবহ উৎপাদনের সাথে তাল মেলানো তো একটা দানবের সাথে হাত মেলানোর সামিল। কীভাবে ধারনা জন্মায় — এইরকম উৎপাদনশীলতার পেছনে একটাই কারণ, ম্যানেজমেন্ট শ্রমিকের উপস্থিতিটাই স্বীকার করে মাত্র। মস্তিষ্কটা নয়। তাই শ্রমিকের না ভাবলেও চলবে, শুধু কাজ করলেই হবে। এইরকম একটি ধারনা নিয়েই এরকম ব্যবস্থাপনার জন্ম। শোনা যায়, এই কারখানায় প্রচুর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে যার ক্ষমতাবলেই এই বিশাল পরিমাণ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু মানুষ যে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে তা তো নয়। আর তাল মিলাবেই বা কেন। কোন প্রয়োজনীয়তায়? আসলে প্রয়োজনীয়তা তো তার আছে যে প্রয়োজনীয়তার শিকলে বাঁধা। শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা কোথায়, সে ত ‘রইল ঝোলা চলল ভোলা’।

প্রায় পাঁচবছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে মারুতি সুজুকির মানেসর প্ল্যান্টের ভয়াবহ দুর্ঘটনা। আচ্ছা, আন্দোলনটা না দেখে আমরা বারবার দুর্ঘটনাটাই উল্লেখ করছি কেন? সেই দিকেই আমাদের নজর বারবার করে চলে যাচ্ছে। বেশ। তার কারণ সব কিছুর থেকে বেশি মূল্যবান হলো মানুষের প্রাণ। তাই একটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারে না। তাই এযাবৎ কালের মধ্যে সবথেকে বড়ো ও উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হলেও শেষ পর্যন্ত তা এসে দাঁড়ালো এই জায়গায় যে, ২০১২ সালের ১৮ জুলাই মানেসর মারুতি মোটরগাড়ি কারখানার এক নম্বর প্ল্যান্টে সন্ধ্যার সময় আগুন লেগে যে হিউম্যান রিসোর্সের জেনারেল ম্যানেজার পুড়ে মারা গেলেন, তার জন্য শ্রমিকরা দায়ী না দায়ী নয়। তাদের হাত আছে না নেই। তাই এতবড়ো সম্ভবনাময় আন্দোলন শ্রমিকদের কাছে, শ্রমের ইতিহাসে রূপকথার গল্প হয়ে উঠল না। পোড়া দাগ রয়ে গেল। যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তি হলো ১৩ জন শ্রমিকের।
১৪৮ জন শ্রমিকের গ্রেপ্তার, তাদের বিনা অপরাধে তিন বছর জেল, আরো কিছু শ্রমিকের ৪-৫ বছর জেল, পরিবারের রোজগার বন্ধ, খাওয়া পড়া বন্ধ, এবং তদুপরি তার মধ্যে ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড, যদি ধরেও নিই যে ঘটনাটা হত্যাকাণ্ড এবং তার পেছনে শ্রমিকের হাত রয়েছে তাহলেও ওইরকম সংঘবদ্ধ আন্দোলন, দলবদ্ধভাবে বিদ্রোহের মধ্যে ১৩ জনকে আলাদাভাবে চিহ্নিতকরণ করা কীভাবে গেল তা যথেষ্ট অবাক করার মতো ঘটনা। কিন্তু আসলে এই তেরোজন ছিল আন্দোলনের একদম সামনের সারিতে। এই তেরোজনের মধ্যে মারুতি সুজুকি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের তৎকালীন অফিস বেয়ারারদের ১২ জন রয়েছে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এ জাপান খুবই এগিয়ে। এই বিষয়ের উদ্ভাবন বা বিষয় নিয়ে গবেষণায় জাপান পৃথিবীতে প্রথম সারিতে। কীভাবে কম শ্রমিক নিয়োগ করে কম সময়ে বেশি উৎপাদন করা যায় তার প্রতিটা সূত্র তাদের জানা, অঙ্ক কষা, ম্যানেজমেন্টের ছাত্ররা কিন্তু তাদের দেখানো এই পথেই এগিয়ে চলে, এবং সফল হয়। শোনা যায়, এইরকম উৎপাদনে পদ্ধতির জন্য জাপানের কলে কারখানায় উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকা শ্রমিকরা ৪০-৪৫ বছর বয়স পেরোনোর পর আর সেইরকমভাবে কর্মক্ষম থাকে না। প্রতি ৪৫ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটে একটি গাড়ি অ্যাসেম্বলি করা যেখানে কলকাতার নিকটবর্তী হিন্দুস্থান মোটরস এ দিনে ৫০ থেকে ৭০টি গাড়ি তৈরি হত। যদিও সেখানে মারুতির মতো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, তবু সংখ্যাটার পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। মাস গেলে মাইনে দিচ্ছি বলে কি শ্রমিকের হাত পা প্রতিটি আঙুল মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা উপশিরা আমার কেনা হয়ে গেল নাকি? কেনা যায় না। আর সেটা বুঝতে হবে ম্যানেজমেন্টকে। সময় এসেছে বোঝার। নাহলে ভবিষ্যতে আরো পাঁচটা ‘মানেসর’ ঘটার সম্ভবনা তৈরি হবে।

উল্লেখযোগ্য যে, ওই গ্রেপ্তার হওয়া ১৪৮ জনের জামিনের সমস্ত আবেদন নাকচ করে সেশন কোর্ট এবং হরিয়ানা হাইকোর্ট। অপরাধের গভীরতা এবং বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্বের বিচারে। সত্যিই তো বিদেশি বিনিয়োগ বলে কথা! বিদেশীদের তো আর চটানো যায় না! তারা মাই বাপ আমাদের দেশে বিনিয়োগ করেছে, চাকরি দিয়েছে! বোধহয়, এরকম বোধ থেকেই ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মতো ঘটনার পরেও আমেরিকানরা আমাদের দেশের সহযোগিতায় তাদের দেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

আচ্ছা এইবার একটু দেখা যাক, যিনি পুড়ে মারা গেছিলেন, তিনি হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার। এই হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার কে? এদের কাজই বা কী? গালভরা এই নামের সামনে কতকগুলো ভালো ভালো পর্দা সাজানো আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনশিপ, মালিক, কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকের মধ্যেকার সেতুর মতো কাজ করা। কর্মরত প্রতিটি কর্মচারির ভালো মন্দ দেখা, সমস্যা হলে সেগুলি মেটানো, ও সর্বোপরি কারখানার কর্মচারীদের শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে উৎপাদন সুষ্টুভাবে পরিচালনায় সাহায্য করা। আর পর্দার আড়ালে কী? শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের হাত করা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাত করা। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে হাতে রাখা। শ্রমিকদের মধ্যে গোপনে চরবৃত্তি করানো ইত্যাদি ইত্যাদি। মালিক বা উচ্চতর ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলার নাম করে শ্রমিকদের ওপর যাবতীয় নিপীড়ন চালায় এই পার্সোনাল ম্যানেজারের হাত ধরে। তাই নীতি নির্ধারনের যাবতীয় সুফল বা কুফলের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার দায় বর্তায় তার ওপর। তাই শ্রমিক-কর্মচারীদের রোষের মুখে পড়তে হয় তাঁকেই। আসলে একজন পার্সোনাল ম্যানেজারও এই সিস্টেমের একজন দাস। তাছাড়া আর কিছু নয়।

তাহলে কি কারখানা উৎপাদন ব্যাপারটাই ধ্বংসাত্মক জায়গায় চলে যাচ্ছে? শ্রমিকের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়া দিয়ে যার শুরু, শ্রমিক আন্দোলনের হিংসা ও তার অপরাধীকরণের মধ্যে দিয়ে কি সে এই জায়গাতেই যাচ্ছে না? যখন ছ’শোর ওপর শ্রমিকের ওপর অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হয়, শতাধিক শ্রমিককে ক্রিমিন্যাল কেস দিয়ে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয় জামিন না দিয়ে, তেরোজনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে বারোজনই ইউনিয়ন আন্দোলনের নেতা — তখন কিন্তু একটাই বার্তা হাজির করা হয় — শ্রমিক আন্দোলন অপরাধ। হিংসার ঘটনাকে বহুগুণে ছাপিয়ে যায় এই অপরাধীকরণ। যার ইঙ্গিত আছে শ্রমিক আন্দোলনের জের-এ কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যেও। শ্রমিক আন্দোলন শ্রমিকের স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাওয়ার সংঘবদ্ধ রূপ, তাকে অমানুষ বানানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া কখনোই শ্রমিকের চাহিদা নয়। শ্রমিক আন্দোলনের চাহিদা নয়। কারখানা উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়াও কখনোই শ্রমিকের চাহিদা নয়।
কলকারখানায় যেখানে শ্রমিক এবং অশ্রমিক কর্মচারি একসাথে কাজ করে সেখানে শ্রমিক কর্মচারিরা যে সেই কোম্পানিরই একজন তা মনে করা হয় না। অনেকটা তু তু ম্যায় ম্যায় এর মতো। শ্রমিকদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়। আলাদা পোষাক, আলাদা হেলমেট, আলাদা টিফিনের ব্যবস্থা, আলাদা ক্যান্টিন, বিশ্বকর্মা পুজোর প্যাকেট নেওয়ার আলাদা লাইন। ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজে আর পাঁচটা মানুষের সাথে সেখানে একসাথে বাজার করতে পারছে, মন্দিরে মসজিদে যেতে পারছে, বাসে ট্রামে চড়তে পারছে, সেখানে কারখানা নামক একটি সংস্থায় কীভাবে আলাদা একটি জাতিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে শ্রমিক? দৈহিক পরিশ্রম করে খেটে খাওয়া সব মানুষেরই বা নাম কেন হয়ে যাবে শ্রমিক? আর আমরা তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে যাব, “দুনিয়ার মজদুর এক হও। কোথায় আমরা তো এটা বলি না যে দুনিয়ার সমস্ত ডাক্তার এক হও, সব ইঞ্জিনিয়ার এক হও, বা সব শিল্পী এক হও।

আমাদের দেখতে হবে, একজন খেটে খাওয়া মানুষকে শ্রমিক সম্বোধন করে তাকে আমরা শ্রমের দাসে পরিণত করছি না তো! এর পরেও বলছি, “দুনিয়ার মজদুর এক হও”, তবে তা তো “মজদুর” পরিচয়ের দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। শ্রমের দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।

*মারুতি কারখানার ঘটনাপঞ্জী মন্থন সাময়িকী প্রকাশিত পুস্তিকা পড়লে জানা যাবে। পুস্তিকাটির সফট কপি নিচের ইউআরএল এ পাওয়া যাবে।

http://songbadmanthan.com/wp-content/uploads/2017/05/maruti-suzuki.pdf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *