বয়লার চালু রেখে লেবার লাগিয়ে ছাই নিষ্কাশনের সিদ্ধান্তেই বিপর্যয় : এনটিপিসি উঞ্চাহার ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করা হবে না কেন?

কুণাল রায়, কলকাতা, ৬ নভেম্বর#
উত্তরপ্রদেশের রায় বেরিলিতে এনটিপিসি-র উঞ্চাহার প্ল্যান্টের ৬টি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিটে বিস্ফোরণ ঘটেছে ১ নভেম্বর। এখনও পর্যন্ত মারা গেছে ৩৫ জন, যাদের বেশির ভাগই শ্রমিক। শতাধিক আহত হয়েছে, যাদেরও বেশিরভাগই শ্রমিক। ৩২ জন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছিল। আঠারো জন গুরুতর আহতকে দিল্লিতে উড়িয়ে আনা হয়েছিল, যাদের মধ্যে তিনজন মারা গেছে। বাকিরা মৃত্যুর সঙ্গে যুঝছে। গত এক দশকের সবচেয়ে বড়ো ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিপর্যয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে উঞ্চাহার।

এনটিপিসি উঞ্চাহারে বয়লার বিস্ফোরণে মৃত শ্রমিকের ছবি ইন্টারনেট থেকে পাওয়া।

কী ঘটেছিল
এনটিপিসি উঞ্চাহার প্ল্যান্টে ১৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। মোট ছ’টি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিটে (৬ নম্বর) এই দুর্ঘটনা ঘটে। প্ল্যান্টের ওই ইউনিটের বয়লারের বটম অ্যাশ হ্যান্ডলিং ইউনিট বা নিচের স্বয়ংক্রিয় ছাই নিষ্কাশন যন্ত্রাংশ দু’দিন ধরে কাজ করছিল না। ফলে বয়লারের মধ্যে ছাই জমে গেছিল প্রায় ১৬ মিটার উঁচু হয়ে। কর্তৃপক্ষ বয়লারটাকে শাট ডাউন না করেই লেবার লাগিয়ে ওই ছাই ম্যানুয়ালি নিষ্কাশন করে ফেলবে বলে ভেবেছিল। চুল্লির ১০ মিটার উচ্চতার বাম ও ডানদিকের ম্যানহোল দরজা খুলে শ্রমিকদের কাজ করতে বলা হয়। তাদের কাজ ছিল জ্বলন্ত ছাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিচের অ্যাশ হপার এ আনা এবং সেখান থেকে সেটাকে পরিষ্কার করা। খোঁচানোর সময় জ্বলন্ত ছাইয়ের এক বিশাল স্তুপ নিচে ছাই হপারের ওপর পড়ে যায়। ফলে ছাই হপারের জল বাষ্পীভূত হয়ে যায়। যার ফলে মারাত্মক উচ্চ বায়ুচাপ তৈরি হয়। ফলে চুল্লির নিচের দিকে ওয়াটার ওয়াল বা জলের দেওয়ালে জোড়ের কাছে চিড় ধরে অনেকটা জুড়ে। একইসাথে উচ্চ বায়ুচাপের কারণে চুল্লির মধ্যে থেকে না-পোড়া এবং আংশিক পোড়া কয়লা ইকোনোমাইজারের মধ্যে চলে যায়। ইকোনোমাইজারে বিস্ফোরণ ঘটে। ইকোনোমাইজারের হপার উড়ে যায়। চুল্লির মধ্যে বায়ুচাপের কারণে জ্বলন্ত ছাই এবার ম্যানহোলের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ওইখানে যে শ্রমিকরা কাজ করছিল তাদের গায়ে এসে পড়ে জ্বলন্ত ছাই। তারা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এমনকি আশেপাশে যে শ্রমিকরা কাজ করছিল, তারাও গরম গ্যাস ও ছাইয়ের আঁচে জ্বলে যায়। এই বিপর্যয় যখন ঘটে তখন ওখানে অন্ততঃ তিনটি কন্ট্রাক্ট ফার্মের শ্রমিকরা কাজ করছিল।

কীভাবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কাজ করে তা জানতে উইকিপিডিয়ার এই পেজটা কাজে লাগতে পারে। দুটি ছবিতে চুল্লি, তার জলের দেওয়াল, বটম অ্যাশ হপার ও ইকোনোমাইজার দেখানো আছে।
কিছু জরুরি প্রশ্ন :
১) বয়লার বন্ধ বা শাট ডাউন না করে চুল্লির তলার জমে যাওয়া ছাই নিষ্কাশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো কোন স্তরে এবং কোন যুক্তিতে? এই ক্ষেত্রে অ্যাশ হ্যান্ডলিং-এ কোনো লোককে পাঠানোর আগে বয়লার শাট ডাউন না করা একটা ক্রিমিনাল বা অপরাধমূলক কাজ। ম্যানেজমেন্টের তরফে যে যুক্তিটা আসে তা হলো, বয়লার শাট ডাউন করে ছাই জমে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করে তা সারাতে ১ মাস সময় লাগার কথা, এই একমাস ২০০ মেগা ওয়াটের ওই ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকত। এক মাস ২০০ মেগাওয়াট ইউনিট বন্ধ না করার যুক্তিতে এতগুলো মানুষের প্রাণের ঝুঁকি নেওয়া হলো।

২) আজকালকার দিনে প্রায় সব স্বয়ংক্রিয় প্ল্যান্টেই প্রতিটি যন্ত্রাংশ নিয়ন্ত্রিত হয় কন্ট্রোল রুম থেকে। প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার চাপ, তাপমাত্রা, প্রবাহ ইত্যাদিতে যে কোনো অস্বাভাবিকতা সহজেই নজর করতে পারে কন্ট্রোল রুম থেকে। ওখানেই দুর্ঘটনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার ঠিক কী করেছিল? অস্বাভাবিকতাগুলো কী কী ছিল? কেন তড়িঘড়ি শ্রমিকদের সরে আসতে বলা হলো না? যে কোনো কার্যকলাপ শুরুর আগে প্রসেস ডিপার্টমেন্ট সমস্ত দিক চেক করে কাজটাকে অ্যালাউ করে। এক্ষেত্রে কি তা করা হয়েছিল?

৩) এখন যন্ত্রাংশ তৈরির দায়িত্বে যারা থাকে, তারা যন্ত্রাংশ দিয়েই ১০০ শতাংশ পেমেন্ট পেয়ে যায়। তাদের আর দায়িত্ব থাকে না। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে টিঁকে থাকার জন্য খুব কম ডিজাইন ভ্যালু দিয়ে যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়, যাতে টেস্টিং এ মার্জিনালি বেরিয়ে গেলেই হলো।

মার্জিনাল ডিজাইনে সাধারণত: ফাঁকি দেওয়া হয় ম্যাটেরিয়াল ও থিকনেস বা পুরুত্বে। কিন্তু ডিজাইনগুলোকে এত রাশি রাশি কাগজপত্র দিয়ে ব্যাক আপ দেওয়া হয় যে ডিজাইনের ফাঁকিটা ধরা যায় না।

তাছাড়া এখন খুব কম সময়ে বয়লার ইউনিট তৈরি করা হয়। একজন আহত শ্রমিক বলেছে, যে বয়লার ইউনিট তৈরি করতে ৪-৫ বছর সময় লাগে তা ২ বছরের মধ্যে কমিশনিং করা হয়েছে। বয়লারটা নাকি ভালো করে তৈরিই হয়নি। আমাদের দেশে এই সংস্কৃতিটা এনেছে বিদেশি কোম্পানিগুলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোরিয়ান বা জাপানি কোম্পানিগুলো। দেশি কোম্পানিগুলো দেরি করে বলে তাদের বরাত দেয় না বিদ্যুৎ কর্পোরেটরা। এই চটজলদি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিঁকে উঠতে না পেরে বহু দেশি কোম্পানি উঠে গেছে গত ২০ বছরে। সব জায়গাতেই চটজলদি, এবং উঞ্চাহারের শ্রমিকদের কথা অনুযায়ী, এনটিপিসি-র বড়ো কর্তারা দ্রুত প্রমোশন পাবে দ্রুত প্ল্যান্ট কমিশনিং হলে, সেদিকে তাকিয়ে সেফটির বা নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণে অবহেলা করা হয়। এগুলো যে ক্রিমিনাল নেগলিজেন্স, অপরাধমূলক অবহেলা, তা বোঝা যায় ব্লাস্ট হয়ে এত লোক মারা গেলে। উঞ্চাহারের ক্ষেত্রে সম্ভবত: বয়লারটা বানিয়েছিল ভেল। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য কী?

৪) এত জন শ্রমিকই বা বয়লার চালু অবস্থায় ছাই সরানোর কাজে লিপ্ত হলো কোন আক্কেলে? খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এদের বেশিরভাগই কন্ট্রাক্ট লেবার। এদের কাজটির ঝুঁকি নিয়ে কোনো আগাম পরিচয় ছিল কি? এক্ষেত্রে অন্ততঃ তিনটি কন্ট্রাক্টরের লোক ওই সময় কাজ করছিল আশেপাশে। অনেক সময় যে কোম্পানিকে হয়ত বরাত দেওয়া হলো ওই ঝুঁকিপূর্ণ কাজের, সে কন্ট্রাক্ট বা সাবকন্ট্রাক্টে দিয়ে দিল আরেকজনকে, এইভাবে শেষমেশ যে কন্ট্রাক্টর তার লেবারকে কাজে লাগালো, সে হয়ত খাতায় কলমে ওই কাজটার বরাতই পায়নি। এমনকি যে কন্ট্রাক্টর নানা হাত ঘুরে কাজটি পেল, সে নিজেও হয়ত জানে না কাজটিতে ঝুঁকি কতটা। ফলে সম্পূর্ণ অসুরক্ষিত অবস্থায় এবং বিপদ না জেনে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক টি কাজ করছে। এই বন্দোবস্তগুলো বহাল তবিয়তে ইন্ডাস্ট্রিতে চলে এটা ধরে নিয়ে যে, কোনো অ্যাকসিডেন্ট হবে না। শ্রমিকদের ব্যক্তিগতভাবে কোনো ইন্সিওরেন্সও থাকে না। গ্রুপ ইন্সিওরেন্স করা থাকে।

শ্রমিকদের খুব কম বেতনও এই অবস্থাটাকে আরো সঙিন করে। দৈনিক ভাস্কর-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে মৃত এক শ্রমিকের (অরবিন্দ) এক আত্মীয়ের এর কথায়, “অরবিন্দরা তিন ভাই। অরবিন্দ সবচেয়ে বড়ো। আগামী বছর ওর বিয়ে হবার কথা ছিল। অরবিন্দ দেওয়ালিতেও বাড়ি যায়নি। পরিবারকে জানিয়েছিল, পয়সা এককাট্টা করে একেবারে পরের বছরই বাড়ি ফিরবে।” ফলতঃ একটু বেশি পয়সার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে রাজি হয়ে যায় শ্রমিকরা।

৫) উঞ্চাহার প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ কোথায় বিক্রি করবে এনটিপিসি? ইউপিতে এনটিপিসির বিদ্যুৎ কেন্দ্র লাগোয়া অঞ্চলে বছর দশেক আগেও ৭-৮ ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকত না। তাই জন্য এক কপি জেরক্সের দাম ছিল ৫ টাকা। ইন্টারনেট সার্ফিং এর রেট ছিল ঘন্টায় ৫০ টাকা, যা কলকাতায় ছিল তখন ১০-১৫ টাকা। ইউপি নির্বাচনে বিদ্যুৎ একটা বড় ইস্যু ছিল। মায়াবতী ১৭-১৮ ঘন্টা বিদ্যুৎ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু গ্রামীন অবস্থার কি উন্নতি হয়েছে? নাকি বেশিরভাগ বিদ্যুৎ সাপ্লাই হয়েছে নগরে, নগরোন্নয়নে?

৬) কেন্দ্রীয় সরকার যে তদন্ত কমিটি করেছে, তার হেড এনটিপিসির এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান। স্বাভাবিকভাবেই এই কমিটি এনটিপিসিকে বাঁচাবে। যদিও দাবি উঠেছে বিচারবিভাগীয় তদন্তের। কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে মৃত পিছু ২ লাখ, গুরুতর আহত পিছু ৫০ হাজার, আহত পিছু ২০ হাজার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিল। শ্রমিকরা বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। পরে কেন্দ্রীয় বিদ্যুতমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ক্ষতিপূরণটা খুব কম হয়েছে, তিনি এক ধাক্কায় ক্ষতিপূরণের পরিমান ১০ থেকে ২০ গুণ করে দেন। শ্রমিক বিক্ষোভ উঠে যায়। ফলে, তদন্তেও আর কোনো সিস্টেমিক গাফিলতি প্রকাশিত হবে কিনা তা ঘোর সন্দেহ।

৭) দুর্ঘটনাকে টেকনিক্যাল ফল্ট হিসেবে কেন নথিভুক্ত করা হবে, কেন ম্যানেজমেন্টের ফল্ট বলে নথিভুক্ত করা হবে না? শাট ডাউন না করে ছাই পরিষ্কারের কাজে লেবার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল যে ম্যানেজমেন্ট, তাকে কেন গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে না? মারুতি কারখানার এক ম্যানেজমেন্ট স্টাফকে মারার দায়ে যদি পাঁচশো শ্রমিকের বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ দেওয়া যেতে পারে, তাহলে ৩৫ জন শ্রমিক মারার দায়ে কেন এনটিপিসি ম্যানেজমেন্টকে মার্ডার চার্জ দেওয়া হবে না?

বেশিরভাগ ভোটেই নেতা নেত্রীরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড বৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে হাততালি কুড়োন। সেই হাততালির আড়ালে থেকে যায় অপরাধগুলি। যে অপরাধগুলি অপরাধ বলে স্বীকৃতিই পায় না, বিচার তো দূর অস্ত।

 

 

 

 

 

 

 

 

Save

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *