একটি অতিমারি (?), টিকা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য

সৌভিক ঘোষ, ১৭ ফেব্রুয়ারি

SARS Covid19 অতিমারির সূচনার পর এক বছরের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। কমবেশি সকলেরই পরিচিত জনকে অতিমারির শিকার হতে হয়েছে, সুস্থ হয়েছেন অনেকে, নিতান্তই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন অনেক মানুষ। ব্যক্তিগত স্তরে প্রতিটি মৃত্যু দুঃখের। আবার ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা থেকে সামাজিক কোন প্রক্রিয়ার বিচার করাই কার্যত অসম্ভব। সামাজিক সমস্যা বা প্রক্রিয়ার আলোচনাকেও তাই এই ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা থেকে বিচার করলে চলবে না।

গত এক বছরে অতিমারির অনিবার্যতার অনেক আলোচনা সত্ত্বেও একথাই মেনে নিতে হবে যে এই ধরনের কোন বিপর্যয়ের জন্য সাধারণ মানুষ তো নয়ই, কোন দেশে কোন সরকারই প্রস্তুত ছিল না। নানা দেশ তার বাস্তবতা সামলে নানা ভাবে এই একবছরে এগিয়েছে। বড় দেশের নানা ছোট অঞ্চলে মানুষ তাদের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে অতিমারি মোকাবিলার নানা পথ বেছে নিয়েছে। ভুল করেছে, শিখেছে। আবার পৃথিবীজোড়া সব দেশই যেহেতু অতিমারির কবলে এসেছে তাই বিশ্বায়িত দুনিয়ার বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নক্সাও খুঁজে পাওয়া যাবে এই ভরসায় কিছু বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

নতুন ভাইরাস ও একটি অতিমারি

করোনা ভাইরাস বিজ্ঞানে নতুন নয়, সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা যে সব ভাইরাস থেকে হয় তার একটা অংশও এই প্রজাতির। আমরা যে বিশেষ ভাইরাস নিয়ে আলোচনা করছি সেটি একটি বিশেষ ভাইরাস SARS-CoV-2। অনুমান করা হয় কোন প্রাণীদেহ থেকে মিউটেশনের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের ভেতর ছড়ান শুরু করে।

২০১৯ সনের ডিসেম্বরে চিনের উহানে যার প্রথম আবির্ভাব ও শেষ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে যার সংক্রমণ হতে থাকে। ২০২০-র মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা সংক্রমণকে অতিমারি ঘোষণা করে (Wikipedia, 2021)। বলা হয় যে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নতুন এই ভাইরাসকে চিনতে না পারায় মারাত্মক ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণের মুখে আমরা কার্যত অসহায়। অনেকটা একই কারণে নতুন ভাইরাস জনিত অসুস্থতার কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। আশ্বাস হিসেবে পড়ে থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই আশ্বাস যে ভাইরাসটির মারণ ক্ষমতা কম, প্রতি ১০০ জনে মৃত্যুর সম্ভাবনা মোটামুটি ৩.৪ জনের।

গত একবছর ধরে তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হিসেবে থাকে ভাইরাসের ছোঁয়া এড়িয়ে চলার চেষ্টা, তা সাবান স্যানিটাইজার ও মাস্ক ব্যবহার করেই হোক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে। গত এক বছরে সারা পৃথিবী তাই নানা সময়ে অভূতপূর্ব ‘লক-ডাউন’-এর সাক্ষী হয়ে রয়েছে। ভারতে গত একবছর পড়ুয়ারা স্কুল-কলেজের মুখ দেখেনি। এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০৮ মিলিয়ন মানুষের কোভিড হয়েছে, মারা গিয়েছেন প্রায় ২.৩৫ মিলিয়ন মানুষ।

অতিমারির আতঙ্ক, বিজ্ঞান ও গণমাধ্যম

অতিমারির প্রথম পর্যায়ের প্রায় ছমাস পৃথিবীজোড়া এক অদ্ভুত আতঙ্কের পরিবেশ ছিল। প্রায় সমস্ত গণমাধ্যম প্রতিদিন প্রতি ঘন্টায় সারা পৃথিবীতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর লাইভ পরিসংখ্যান দিয়ে চলেছিল। সাথে চলছিল নানা বিশেষজ্ঞের চোখে পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং যারা প্রায় সকলেই ‘শেষের সে দিন ভয়ংকর’ গোছের ভবিষ্যৎবাণী করছিলেন। প্রায় সব বাজার চলতি সেলফ হেল্প বইতেও যে কথাটা বারবার বলা হয় সেটা হল মানুষের মস্তিষ্ক যা জানে না তাই নিয়ে সবচাইতে খারাপ সম্ভাবনাগুলোই কল্পনা করে, বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ মহলের গত এক বছরের সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতেও আমরা তাই দেখেছি। যেখানে সংক্রমণের অবিশ্বাস্য দ্রুততার বারংবার আলোচনা সত্ত্বেও বাস্তবে পরিস্থিতি ঠিক ততটা ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি।

আগের অনুচ্ছেদের সংখ্যাগুলোকে তাই খানিকটা বিশ্লেষণ করা দরকার। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের মোট মানুষ এক বছরে সংক্রমিত হয়েছেন। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর যে সংখ্যায় মৃত্যু হয় তার ৩ শতাংশের মত মানুষ করোনায় মারা গিয়েছেন। একটা তুলনা দেওয়া যায়, ২০১৮ সনে ৯.৬ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শুধু মাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ। এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান মানুষের সামনে প্রতিদিন উঠে আসে না। এই প্রথম কোন অসুখের লাইভ পরিসংখ্যান মানুষের সামনে রিয়েলিটি শো-এর মত তুলে ধরা হল।

পরিসংখ্যানের আর একটি সমস্যা ছিল বিজ্ঞানের কাছে নতুন কোন ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে প্রাথমিক ভাবে অনেক দ্বন্দ্ব থাকে। যেমন করোনা নিয়ে মৃত ও করোনার কারণে মৃত এই দুয়ের মাঝের সীমারেখায় ধোঁয়াশা বিজ্ঞানীদের এখনও আছে। এই প্রথম কোন অসুখের জন্য কোন উপসর্গ নেই এমন মানুষের পরীক্ষা করা হল, ভাইরাসের চিহ্ন মিললে নাম উঠল সংক্রমিত তালিকায়। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞান নিশ্চিতভাবে জানে যে শরীরে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের উপস্থিতি মানেই রোগের সংক্রমণ নয়। ফলত সামনে এলো এক নতুন শ্রেণী ‘অ্যাসিমটমেটিক’ রোগী। এদের অধিকাংশই ডাক্তারি পরিভাষায় অসুস্থ ছিলেন না। প্রায় কোন বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ না থাকলেও গণমাধ্যমগুলি ঢালাও প্রচার করে গেল যে ‘অ্যাসিমটমেটিক’ বা উপসর্গ-হীন রোগীরাই মূলত নিঃশব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছেন মারণ রোগ। পরের দিকে নানা গবেষণা দাবি করেছে যে এরা প্রায় কখনই করোনা ছড়াচ্ছিলেন না।

নতুন ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা নিয়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছে। যেমন অতিমারির শুরুতেই ঘটনাচক্রে ‘ডায়মন্ড প্রিন্সেস’ নামে একটি জাহাজে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় তাকে আলাদা করে রাখা হয়। এই জাহাজের যাত্রী ও কর্মীরা বেশ কিছুদিন কার্যত সংক্রমিতদের খুব কাছাকাছি থেকে যেতে বাধ্য হন। বিজ্ঞানীরা প্রায় পরীক্ষাগারে তৈরি মডেল পেয়ে যান গবেষণার জন্য। তা সত্ত্বেও মাত্র দু শতাংশ যাত্রীর শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়। অথচ জাহাজের লোকদের গড় বয়স ছিল ৫৮ আর বিজ্ঞানীরা শুরু থেকেই বলে আসছেন যে বেশি বয়সীদের জন্য করোনার মারণ ক্ষমতাও বেশি। দাবি করেন যে বিশ্বের গড় আয়ু হিসেব করলে জাহাজের পরিসংখ্যান অনুযায়ী করোনায় মৃত্যুর সম্ভাবনা শতকরা ০.০৫ থেকে ০.২ (Ioannidis, 2020)।

গণমাধ্যমগুলি বারবার এই আতঙ্ক-নির্মাণ কে একটা সামাজিক কর্তব্য হিসেবে দেখিয়ে এসেছে। লোকে ভয় পেলে সচেতন হয়ে শারীরিক দূরত্ব ( কোন আশ্চর্য জনক কারণে বারবার সামাজিক দূরত্ব বলা হয়েছে) বজায় রাখবে, এটাই ছিল সাফাই। খুব সাধারণ যুক্তি থেকেই দেখা যায় যে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এইরকম দূরত্ববিধি বা আচরণবিধি মেনে চলা সমাজের ৯০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে কার্যত অসম্ভব ছিল, বাস্তবেও হয় নি। এমনকি উন্নত দেশগুলতেও মানুষ আচরণবিধি মেনে চলতে পারে নি। বরং নানা পর্যায়ে আক্রান্ত বা তার পরিবারকে কম বেশি সামাজিক বয়কটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। লক-ডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। একবছর পরেও যাদের অধিকাংশই আগের জীবনে ফিরতে পারেন নি। সমাজের সবচাইতে নিচের তলার মানুষ, যাদের ভেতর করোনা সংক্রমণের মাত্রা অবিশ্বাস্য রকমের কম, সবচাইতে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

এই আতঙ্ক নির্মাণ কি কাঙ্ক্ষিত ছিল? বিজ্ঞানের প্রায় কোন সমর্থন ছাড়াই মাসের পর মাস কেন বেঁচে রইল এই পরিবেশ যা থেকে এক বছর পরও বেড়িয়ে আসা গেল না। অথচ বিশ্বব্যাপী সংক্রমন ক্রমশ কমেছে অনেকদিন ধরে। চিকিৎসার অভিজ্ঞতা যত বেড়েছে মৃত্যুহারও কমে এসেছে। ইতালির ভয়াবহ মৃত্যুহারের পেছনে অনেকেই প্রাথমিক আতঙ্কজনিত ভুল সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন। করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত ভবিষ্যৎবাণীর অধিকাংশই ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, প্রায় সব সময় বাস্তব পরিস্থিতি যা আশংকা করা হয়েছিল তার চাইতে অনেক ভাল হয়েছে। সাংখ্য-বিজ্ঞানের ওপর তৈরি করা প্রায় সব মডেলেই অনেক সমস্যা লুকিয়ে থাকে, যেমনটা প্রায়ই নির্বাচনী সমীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে আমরা দেখে থাকি, এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকা সত্ত্বেও বহু বিজ্ঞানী ও চিকিৎসককেই এই পর্যায়ে প্রায় তাদের প্রায় নিশ্চিত ভবিষ্যৎবাণী করতে দেখা গিয়েছে।

অতিমারি নিয়ন্ত্রণে টিকার দ্রুততম আবিষ্কার

আগের করোনা ভাইরাসগুলো থেকে যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে তাতে রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ আবিষ্কার করা সহজ নয়। অতিমারি সাধারণত একটা পর্যায়ে নিজেই বিদায় নেয় কারণ একটা পরিমাণ মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার কারণে তাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। মোটামুটি ৬০ শতাংশ মানুষের এই ক্ষমতা অর্জিত হয়ে গেলে সংক্রমণ কমে আসে। একেই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলা হয়। কৃত্রিমভাবে টিকা-করনের মাধ্যমে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি করা গেলে অতিমারি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

এই টিকা আবিষ্কার করা সময় সাপেক্ষ। টিকা তৈরির প্রতি ধাপে অনেক দিন ধরে তার গুনাগুণ পরীক্ষা করতে হয়। এই সময়টা কমিয়ে আনার কোন পদ্ধতি আদতে বিজ্ঞানের জানা নেই। একটা টিকার তিন বছরে কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে সেটা তো কোন ভাবেই একমাসে জানা সম্ভব নয়। গোদা বাংলায় ব্যাপারটা খানিকটা এইরকম। তা ছাড়াও প্রতি ধাপেই তথ্য সংগ্রহ ও সাংখ্য বিজ্ঞানের সাহায্যে যাচাইয়ের প্রক্রিয়া চালাতে হয়, সময় লাগে। দেখা গিয়েছে আগে যে সব টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে সবগুলোতেই আট-দশ বছর বা আরও বেশি সময় লেগেছে। অনেক অসুখের টিকা, যেমন স্প্যানিশ ফ্লু যা অতিমারির আকার নিয়েছিল, করাই যায় নি। এমন একটা অবস্থাতেও পৃথিবীর প্রায় সব দেশ বছর খানেকের ভেতর নতুন অসুখের টিকা বাজারে নিয়ে আসার অবিশ্বাস্য লক্ষ্য স্থির করে নিল।

বিজ্ঞানের দিক থেকে এবার সুবিধে ছিল না তা নয়। প্রথমত টিকা কাজ করে মানুষের ইমিউনিটি সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে আর ইমিউনিটি সিস্টেম ভাইরাস চেনে নানা মার্কার থেকে। করোনা জাতের ভাইরাস যেহেতু নতুন নয় তাই সাম্প্রতিক ভাইরাসটার কোন না কোন অংশকে চেনার কাজে ব্যবহার করে টিকা আবিষ্কার করার কথা ভাবা হয়।

দ্বিতীয়ত টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এতদিনের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগে। আর এবারে পৃথিবীর প্রায় সবকটি দেশ সমান্তরাল ভাবে সম্ভাব্য পথগুলি যাচাই করে দেখছিল। ফলত আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারলাম বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একাধিক টিকা নানা দেশে ছাড়পত্র পেতে শুরু করল। টিকা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই সাফল্য অভাবনীয়। একটা বড় কারণ হল টিকা-র সম্পূর্ণ নতুন mRNA টেকনোলজি (Forni, Guido and Mantovani, 2021)। সাধারণত টিকা তৈরির জন্য পরীক্ষাগারে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কর্ষণ (culture) দরকার হয়। যেগুলো পরবর্তী ধাপে টিকা তৈরিতে কাজে লাগে। এই পদ্ধতি খুব সময় সাপেক্ষ। এই প্রথম টিকা তৈরি হল mRNA ব্যবহার করে। Pfizer ও Moderna যারা প্রথম টিকা বাজারে আনে তারা এই নতুন পদ্ধতিতেই টিকা তৈরি করেছে। এখানে ভাইরাসে মেসেঞ্জার আর এন এ-র একটা অংশ শরীরে ঢুকিয়ে দিলে শরীরেই সেই বিশেষ ভাইরাসকে চেনার মত প্রোটিনে শরীরেই তৈরি হতে থাকে ফলে শরীরও প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে থাকে। টিকা তৈরির টেকনোলজিতে এটা সম্ভবত এই পর্বে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি।

তা সত্ত্বেও খুব দ্রুত টিকা তৈরির ফলে নানা তথ্যের একটা ঘাটতি রয়েই গিয়েছে। ভারতে ইতিমধ্যে দুটি টিকা ছাড়পত্র পেয়েছে যদিও প্রাথমিক ভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে যুক্তরাই এই টিকা নিতে পারছেন। ভারত বায়টেকের তৈরি Covaxin কোন রকম efficacy data প্রকাশ না করেই ছাড়পত্র পায় যা নিয়ে অনেক বিতর্ক দানা বাঁধে। আরেকটি ভ্যাক্সিন Covishield-এর efficacy data-ও ভারতের বাইরে করা ট্রায়াল থেকে পাওয়া। অঞ্চলভেদে নানা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের বিপুল তারতম্য থাকা সত্ত্বেও কেন ভারতে ট্রায়াল করার আগেই টিকার ছাড়পত্র মিলল?

টিকার বিজ্ঞান

করোনা টিকা কতখানি কার্যকর হবে তা নিয়ে যে ধোঁয়াশা, যত সময় যাবে তা কেটে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে করোনা টিকা সংক্রমণ আটকাতে পারে না। এমনকি টিকা নিয়েছেন এমন মানুষের করোনা হলে তিনি করোনা ছড়াবেন না তেমনও নয়, অন্তত তার সপক্ষে কোন তথ্য। টিকা শুধু অসুখের তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে, মৃত্যুর সম্ভাবনা সেক্ষেত্রে অনেকটাই কমে যাবে। অর্থাৎ যেমন পোলিও টিকা করে থাকে তেমন স্টেরাইল ইমিউনিটি এই টিকা তৈরি করে না।

আবার বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ভাবে জানেন না যে সবকটি ভাইরাল স্ট্রেইনের ওপর টিকা একই রকম কাজ করবে কিনা। খুব দ্রুত ট্রায়াল শেষ করার কারণে সব বয়সের ও পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষ টিকা নিয়ে সমান সুরক্ষা পাবেন কিনা বলার মত পর্যাপ্ত তথ্যও হাতে নেই। ধরেই নেওয়া যেতে পারে করোনা ভাইরাসের সাথে আমাদের বহুদিন থাকতে হবে। আগেই বলা হয়েছে যে করোনা প্রজাতির ভাইরাস সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য দায়ী। এই ফ্লু-র টিকা নিয়ে বিজ্ঞান অনেক দিন ধরেই একটা দোলাচলে আছে। ফ্লুর যে টিকা দেওয়া হয় তার কার্যকারিতা খুব ভাল সময়ে ৫০ শতাংশ, খারাপ সময়ে ৩০ শতাংশরও নীচে। প্রতিবছর টিকা নিয়েই তেমন লাভ হয় না। কারণ কি?

টিকার কাজ হল ইমিউনিটি তৈরি করা। কিন্তু শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভাইরাস কে চিনবে কি করে? চিনবে কিছু নির্দিষ্ট চিহ্ন থেকে যেমন তার প্রোটিন খোলস। এর সুবিধাজনক দিক হল চেনার মত কোন একটি চিহ্নের ভিত্তিতেই টিকা তৈরি করা যায়, পুরো ভাইরাসের মডেল দরকার হয় না। যেমন কিছু করোনা টিকা তৈরি হয়েছে তার স্পাইক প্রোটিন কে চিহ্ন হিসেবে নিয়ে। গবেষণা এমনও আশা দেখিয়েছে যে নতুন ভাইরাসটা সম্পূর্ণ আলাদা হলেও বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু কোন না কোন রকমের করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে কোন না কোন সময়ে এসেছে তাই নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধেও শুরুতে যেমন ভাবা হয়েছিল আমরা তত টা অসহায় নই। হয়ত সে কারণেই অতিমারির প্রকোপ নানা দেশে নানা রকম (Doshi, 2020)।

যাই হোক, অসুবিধেটা হল যে একই কারণে ভাইরাস নানা ভাবে ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে পারে, খানিকটা ছদ্মবেশ নেবার মত। ফ্লু-র ভাইরাস ঠিক এই কাজটাই করে থাকে আর একই কান্ড যে করোনা ভাইরাসের বেলায় ঘটবে না তা বলার মত যথেষ্ট তথ্যও আমাদের হাতে নেই। বিশেষত যে টিকাগুলি ভাইরাসের একটা বিশেষ সনাক্তকরণ চিহ্নের ওপর ভিত্তি করে বানান, যেমন mRNA টিকাগুলো, সেগুলো নতুন নতুন ভাইরাল স্ট্রেইনের মোকাবিলা কতটা সফল ভাবে করবে তা নিশ্চিত করে বলার উপায় বিজ্ঞানে নেই। আমরা আশা করতে পারি মাত্র।

টিকার অর্থনীতি নিয়ে দুচারটে কথা

পাস্তুরের প্রথম টিকা আবিষ্কার করার যুগে টিকা আবিষ্কার নিতান্তই একটি বৈজ্ঞানিক ঘটনা ছিল। এখন ওষুধ, টিকা এই সব বড় শিল্প, বড় পুঁজির নিবেশ ক্ষেত্র। বস্তুত বহু অসুখের টিকা আবিষ্কার হওয়া বা না হওয়ার পেছনে সহজ সরল মুনাফা আর লগ্নির অর্থনীতি জড়িয়ে থাকে। কিছুদিন আগেই আরও অন্তত দুটি করোনা ভাইরাস জনিত অসুখে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। MERS SARS । এগুলোর কোনটাই SARS-CoV-2 র মত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েনি, তাই অতিমারির পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যদিও মারণ ক্ষমতা এদের বহুগুণ বেশি ছিল। এদের কোনটারই টিকা এখনও বাজারে আসেনি।

বস্তুত বড় কোম্পানিগুলির টিকা আবিষ্কারের ওপর লগ্নি করার অনীহা বহুদিনের। টিকা আবিষ্কার ঝুঁকিপূর্ণ, সময় কত লাগবে আগে থেকে জানা থাকে না, টিকা আদৌ আবিষ্কার করা যাবে কিনা তার নিশ্চয়তা থাকে না। সাধারণত জনসংখ্যা বেশি হয় বলে গরীব দেশগুলোতে টিকা বেশি লাগে, অথচ চড়া দাম পাওয়া যায় না। ওষুধের মত টিকা বারবার ব্যবহার করতে হয় না তাই একই ক্রেতা থেকে বারবার মুনাফা করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ লাভ হয় সাময়িক ও অনিশ্চিত তাই প্রতিদিন বা বারবার ব্যবহার হয় এমন ওষুধের ওপর লগ্নি করার প্রবণতা ফার্মা কোম্পানিগুলোর অনেক বেশি।

অতিমারির প্রথম পর্যায়ে বিজ্ঞানী, ডাক্তারদের অনেকেই অভিযোগ তুলেছিলেন যে SARS, MERS ইত্যাদির টিকা নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে না দিলে নতুন ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার অনেক সহজ হত কারণ এটিও একটি করোনা ভাইরাস। এবার তাহলে এতগুলি কোম্পানি টিকা আবিষ্কার করার এবং এত দ্রুত বাজারজাত করার ঝুঁকি নিতে পারল কি করে?

উন্নত দেশগুলি, বিশেষত ইউরোপ, আমেরিকা যখন অতিমারির সংক্রমণ রুখতে ব্যর্থ হয় তখন অনেক দেশেই সরকার প্রশ্নের মুখে পরে। এই অবস্থায় পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে তাদের হাতে পরে থাকে যত দ্রুত সম্ভব টিকা নিয়ে আসা। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প “Operation Wrap Speed” তৈরি করেন সবচাইতে দ্রুত টিকা আবিষ্কারের লক্ষ্যে। ফলত বিরাট অঙ্কের টাকা সরকারের তরফে টিকা গবেষণায় লগ্নি করা হয়। তার ওপর আগে থেকেই বিরাট সংখ্যার টিকা কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলিকে একরকম নিশ্চিত মুনাফার আশ্বাস দেওয়া হয়। ১ নং টেবিলে বেশ কয়েকটি টিকা ও তাদের নিশ্চিত বরাতের একটা হিসেব দেওয়া হল। এই অবস্থায় কোম্পানিগুলোর কাছে মুনাফা ছাড়াও বাজারের আস্থা ফিরে পাওয়ার একটা অভাবনীয় সুযোগ তৈরি হয়। ওষুধ শিল্পের বড় পুঁজির বিরুদ্ধে একটা পুরনো অভিযোগ হল মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বিরাট মুনাফা করা। আরও নির্দিষ্টভাবে দেখলেও বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রায়শই বিরাট অঙ্কের জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছে। ২০০৯ সালে এরকম কারণে Pfizer কেই ২.৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। সরকারের দেওয়া বিপুল আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়াও টিকা তৈরির কাজে কোম্পানিগুলো সরকারি খরচে করা গবেষণার সবরকম সাহায্য পেয়েছে যেমন Oxford এর AstraZeneca টিকাটি। এই যৌথ উদ্যোগে যে টিকা তৈরি হল তার সত্ত্ব কেন পুরোপুরি কোম্পানিগুলো পেয়ে গেল? যেমন Moderna গত বছর ২.৫ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকে পেয়েছে। Pfizer এর সহযোগী BioNTech ৪৪০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পেয়েছে। উপরন্তু শেষ পর্যায়ের Clinical trial চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রায় ২ বিলিয়ন টিকার অগ্রিম বরাত দিয়ে আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। তার পরও এই টিকা দুটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৫.২৫/১৯.৫০ ডলারে বিক্রি হবে। বিশ্বের অন্যত্র এই টিকাই ২৫/৩৭ ডলারে বিক্রি হবে যদিও ১৫.২৫/১৯.৫০ ডলারে বিক্রি করলেও আনুমানিক ৬০-৮০ শতাংশ লাভ থেকে যায় (Buranyi, 2020)। অক্সফোর্ডের চুক্তি অনুযায়ী AstraZeneca-র টিকা অবশ্য মুনাফা ছাড়াই বেচতে হবে, কিন্তু সে চুক্তির মেয়াদ জুলাই, ২০২১ পর্যন্ত।

VaccinePre-order (Billion)
Astra Zeneca (oxford)3.29
Johonson & Johonson1.27
Novvax1.38
Pfizer1.28
Sanofi/GSK1.23
Moderna0.78
টেবল 1টিকা তৈরিতে সরকারি আর্থিক সাহায্য

অতিমারিকালে বাজার অর্থনীতি

অতিমারির সময় এক অভূতপূর্ব সঙ্কট সামনে আসে। প্রায় এক বছর ধরে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার যে উপায় সর্বত্র কম বেশি নেওয়া হয় তা হল শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভীর এড়িয়ে চলা এবং সোজা কথায় খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতেই থাকা। প্রভাব পরে সর্বত্র। একদিকে যেমন মাসের পর মাস পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়, আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন বন্ধ থাকে তেমনি দূরত্ববিধি মানতে গিয়ে কলকারখানা চালানোর সমস্যা দেখা দেয়। পর্যটন, বিনোদন শিল্প সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাসের পর মাস হোটেল, রেস্তোরাঁ, সিনেমাহল, বিনোদন পার্ক বন্ধ রাখা হয়, বন্ধ থাকে শপিং মল। চাহিদা ও যোগান দুদিকেই সঙ্কট তৈরি হয়। ফলে বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারান, লক-ডাউনের সময় ভারতবর্ষে আমরা দেখি লাখে লাখে শ্রমিক মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সবচাইতে গরীব মানুষ যারা প্রতিদিনের রোজগারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকেন তারা সবচাইতে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

শিল্পের ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে ছোট ও মাঝারি শিল্পের। প্রায় সমস্ত বিভাগকেই এই পর্যায়ে কম বেশি অনলাইন কাজ করতে বাধ্য হতে হয় ফলে Google, Amazon জাতীয় একরকম Monopoly কোম্পানিগুলোর লাভ হয় অনেক। ২০২০ সালে প্রায় সব দেশের GDP ধাক্কা খায়, অথচ বিশ্বজোড়া শেয়ার বাজার ১২-১৩ শতাংশ হারে বাড়ে। বড় ফার্মা কোম্পানির শেয়ারের দাম অনেক ক্ষেত্রেই টিকা বাজারে আনার প্রত্যাশাকে মাথায় রেখে বেড়েছে কয়েকগুণ নানা দেশে নানা স্তরে শ্রম-আইন ব্যবসার সুবিধে অনুযায়ী বদলে নেওয়া হয়। অর্থাৎ নীচের তলার মানুষ যখন নিজের শেষ সঞ্চয় শেষ করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল, তখন গত কয়েকবছরের ভেতর সবচাইতে বেশি হারে বাড়ছিল লগ্নিকারির সম্পদ।

গত একবছরে অতিমারি এক বিপুল আর্থিক অসমতা তৈরি করেছে। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলি শুধু আর্থিক সংকটে পড়েছে তাই নয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদিতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়েছে। যেমন ভারতের মত দেশে একটা বড় অংশের মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। মেয়েদের স্কুলশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের এই প্রবণতা কমিয়ে আনার ব্যাপারে সদর্থক ভূমিকা ছিল। বছরভর উপার্জনের অনিশ্চয়তা আর বন্ধ স্কুল ব্যবস্থা বহু মেয়ের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত করে তুলেছে। এসবের পাশাপাশি পুঁজির জন্য অতিমারির আতঙ্কের ডামাডোলে আইন কানুন বদলে বড় পুঁজির বিনিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করছে। যেমন পরিবর্তিত কৃষি আইন আমাদের দেশে বড় পুঁজির জন্য কৃষিপণ্যের বিরাট বাজার সহজলভ্য করে দিতে চাইছে। ভারতের মত দেশে সস্তায় টিকা তৈরির একটা সম্ভাবনা আছে, এখানে টিকার মানুষের ওপর ট্রায়াল করা যায় অপেক্ষাকৃত সহজে ও কম খরচে। তাই এই দেশগুলো ঝুঁকতে চাইছে টিকা শিল্পের দিকে।

শেষকথা

সমাজ বিজ্ঞানে সাদা কালোর মাঝে অনেকটা ধুসর জায়গা থাকে। করোনার টিকা-করন নিয়ে কোন চক্রান্ত তত্ত্ব (conspiracy theory) নিয়ে আসা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আবার একথাও সত্যি যে বিজ্ঞানের নাম করে গণমাধ্যমগুলো যা পরিবেশন করছে তা সবসময় বিজ্ঞান নয়। কোভিডের মৃত্যুহার এর ব্যাপারেই ফিরে আশা যাক। উপসর্গের দিক থেকে সাধারণ সর্দি কাশির সাথে কোভিডের অনেক মিল, ভয়ের একটা কারণ যেমন তার খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়া তেমনি মূল উৎস হল সাধারণ ফ্লু-এর তুলনায় অনেক বেশি মৃত্যুহার। বারবার যা ২-৩ শতাংশ দাবি করা হয়েছে। Standford এর বিজ্ঞানী John P. A. Ioannidis-র সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজরে আসে –

১। কোভিড-এর প্রাথমিক মৃত্যুহার নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। একটা বড় অংশের মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়েছে অতিমারির আকস্মিকতা জনিত ভুল। যেমন প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও সেখানে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া। ভুল ওষুধ যেমন হাইড্রক্সি – ক্লোরোকুইনের ব্যাবহার ইত্যাদি। কোভিড-এর মারণ হার নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা কঠিন কিন্তু খুব সম্ভবত তা ০.০৫ থেকে ০.২ শতাংশের ভেতর (Ioannidis, 2020)।

২। লক-ডাউন জাতীয় মারাত্মক সামাজিক নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছেন, যাচ্ছেন ও যাবেন তা অতিমারির মৃত্যুকে ছাপিয়ে যেতে পারে (Ioannidis, 2020)।

৩। অতিমারি সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত ভবিষ্যৎবাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এদের প্রায় সবগুলিই অতিমারির প্রভাবকে অনেকগুণ বেশি ভয়াবহ অনুমান করেছিল। এর কারণ হিসেবে Ioannidis বলছেন প্রাথমিক ভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ত্রুটি, অতিমারির প্রভাবকে একরকম সমসত্ত্ব অনুমান করা যা বাস্তবে একদমই হয়নি, ইত্যাদি (Ioannidis et al., 2020)।

বাস্তবে এই ত্রুটিগুলো বিজ্ঞানের খুব প্রাথমিক প্রতিপাদ্য। সাংখ্য-বিজ্ঞানের যেকোনো প্রয়োগের এই অনিশ্চয়তাগুলো থেকে আর অনেক ক্ষেত্রে বিশেষত আর্থসামাজিক পরিসরে ও জীববিজ্ঞানে এগুলোর সবকটিকে সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব নয়। বর্তমান গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলি মূলে রয়েছেন এক বিচ্ছিন্ন মনোযোগ আকর্ষণের অর্থনীতি। খবর শুধু পরিবেশন করলে চলে না তাকে ‘সেন্সেশনালাইজ’ করতে হয়। কাজেই যখন দেখা যায় যে অতিমারির আতঙ্ক বহুলাংশে এই নীতির প্রত্যক্ষ ফসল এবং বহুদিন তাকে ধরে রাখার খানিকটা সচেতন চেষ্টা করা হয়েছে তখন আড়ালে কোন সচেতন উদ্দেশ্য থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কিছুদিন আগে দিল্লীতে যে সেরলজিকাল সার্ভে হয়েছিল তাতে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের শরীরে কোভিড অ্যান্টিবডি পাওয়া গিয়েছে যা হার্ড ইমিউনিটির জন্য যথেষ্ট। সংক্রমণের হার পুরো দেশেই যেভাবে কমে এসেছে তাতে অন্যান্য নানা অঞ্চলেই একই ঘটনাই হয়ে থাকতে পারে। এমনকি সাম্প্রতিক গবেষণা এই ইঙ্গিতও দেয় যে SARS Cov-19 অতিমারি মোকাবিলায় বহুস্তরীয় ইমিউনিটি সিস্টেমের অন্য একটি স্তর টি-সেল সম্ভবত অপ্রত্যাশিত রকমের কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে। সাধারণ ফ্লু সংক্রমণের এই টি-সেলের স্মৃতি (Memory) কাজে লাগছে সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে আনতে। সেক্ষেত্রে অনেক কম সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হলেও হার্ড ইমিউনিটি পেয়ে যাচ্ছে কোন এলাকার মানুষ (Lourenço et al., 2020)।

সেক্ষেত্রে এত দ্রুত ঢালাও টিকা-করণের কারণ নিয়ে সন্দেহ হতেই পারে। টিকা ওষুধ নয় যা অসুস্থ মানুষকে সারিয়ে তোলার জন্য দেওয়া হয়, টিকা সুস্থ মানুষকে দেওয়া হয় দ্রুত হার্ড ইমিউনিটি তৈরির জন্য। যদি সাধারণ ভাবে হার্ড ইমিউনিটি থেকেই থাকে তবে নানা তথ্য-ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি এতগুলি টিকাকে এমনকি গাইডলাইন বদলেও ছাড়পত্র কেন দেওয়া হল? এত দ্রুত টিকা নিয়ে আসা ও সারা পৃথিবীতে নান যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা পৌঁছে দেবার জন্য বড় পুঁজির প্রশংসা প্রাপ্য। আবার মনে রাখতে হবে, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর Stein বিশ্বজোড়া বড় পুঁজির ওষুধ বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখে বলেছেন “ There are more people who want to do good and make a return than there are people who want only to do good” (Avishai, 2020)।

Avishai, B. (2020, August 15). The case for a coronavirus-vaccine bond. The New Yorker.

Buranyi, S. (2020). Pharma companies fooling you? Virus may be an incredible PR coup for an industry trying to rescue its image. New York Times.

Doshi, P. (2020). Covid-19: Do many people have pre-existing immunity? The BMJ, 370. https://doi.org/10.1136/bmj.m3563

Forni, Guido and Mantovani, A. (2021). COVID-19 vaccines: where we stand and challenges ahead. Cell Death & Differentiation, 1–14.

Ioannidis, J. P. A. (2020). Global perspective of COVID-19 epidemiology for a full-cycle pandemic. In European Journal of Clinical Investigation (Vol. 50, Issue 12). https://doi.org/10.1111/eci.13423

Ioannidis, J. P. A., Cripps, S., & Tanner, M. A. (2020). Forecasting for COVID-19 has failed. International Journal of Forecasting. https://doi.org/10.1016/j.ijforecast.2020.08.004

Lourenço, J., Pinotti, F., Thompson, C., & Gupta, S. (2020). The impact of host resistance on cumulative mortality and the threshold of herd immunity for SARS-CoV-2. In medRxiv. https://doi.org/10.1101/2020.07.15.20154294

Wikipedia. (n.d.). COVID-19 pandemic in India. https://en.wikipedia.org/wiki/COVID-19_pandemic_in_India



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *