বিজেপির কারণ (৩) : স্বজাতের বাসনা


শমীক সরকার

গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল বিজয়ের পেছনে কী কী কারণ আছে, তাই নিয়ে কিন্তু এই লেখাগুলো নয়। সেই নিয়ে কিছু লেখা লেখা হবে, ‘বিজেপির বিজয়ের কারণ’ নাম দিয়ে। এই লেখাগুলো শিরোনামেই পরিষ্কার — বিজেপির কারণ। অর্থাৎ মানুষ কেন বিজেপির দিকে ঝুঁকছে, সেটা। শুধু ভোট দিচ্ছে — এমন নয়।

সেই কারণ খতিয়ে দেখতে দেখতেই বোঝা গেল — ভারতবর্ষের জাত-ব্যবস্থা — যা একসময় একটা বড়ো অংশের আঞ্চলিক দল এবং সত্তর দশক থেকে জনতা দলের রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে ছিল — তা এখন পুরোটাই বিজেপির খেলার সাথিতে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার সময় জাত-ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারতবর্ষের দুটিই জাত — বড়লোক আর গরীব। উনার পার্টি এবং রাজনীতি কিন্তু এই জাত-ব্যবস্থা থেকেই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে। তার রিটার্ন যদি উনি না দেন, তাহলে বিপদ আছে।

বিজেপির সবচেয়ে শক্তিশালী এবং মতাদর্শগত ভিত্তি হল ব্রাহ্মণ ও কায়স্ত সহ অগ্রবর্তী জাত। সিএসডিএস-এর একটি সমীক্ষা কয়েক বছর আগে দেখিয়েছিল, বিজেপির ক্যাডার এবং নেতারা মূলতঃ এই ব্রাহ্মণ এবং কায়স্ত জাতের থেকে উঠে আসা। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ-বানিয়া-রাজপুত-কায়স্থ-দের মধ্যে বিজেপির সমর্থন চল্লিশ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬১ শতাংশের পৌঁছে গেছে। স্পষ্টতঃই বোঝা যায় — এই অংশের মধ্যে বিজেপি-র রাজনীতি একটি স্থায়ী ভিত্তি পেয়েছে।

অগ্রবর্তী জাতগুলির মধ্যে বাকি থাকে কৃষক-জাত গুলি — পতিদার, মারাঠা, জাঠ — ইত্যাদিরা। কয়েকবছর ধরেই কৃষির দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার কারণে এই কৃষক জাতগুলি সরকারি চাকরি এবং উচ্চশিক্ষায় নিজেদের জাতের জন্য সংরক্ষণের দাবি তুলছে। কৃষি ভারতবর্ষের সমস্ত ক্ষেত্রে মধ্যে সবচেয়ে কম বৃদ্ধির ক্ষেত্র, অতএব কৃষিতে যারা থাকবে, তারা অন্যান্য পেশায় যারা আছে, তাদের তুলনায় গরীব হবে। ফলতঃ জমির মালিক এবং অগ্রবর্তী এই কৃষক-জাত সমূহ গ্রামীন অর্থনীতিতে গরীবতর হচ্ছে — স্রেফ কৃষিতে থাকার কারণে। নিজেদের জাতের উন্নতির জন্য তারা মহারাষ্ট্রে মারাঠা আন্দোলন, গুজরাটে পতিদার আন্দোলন এবং উত্তর ভারতে জাঠ আন্দোলন করেছে। সমস্ত আন্দোলনগুলোই গণ-আন্দোলন রূপে হয়েছে এবং সময়ে সময়ে হিংস্র-ও হয়ে উঠেছে। এই সমস্ত আন্দোলন প্রথমদিকে বিজেপি বিরোধী থাকলেও ক্রমে আস্তে আস্তে বিজেপি সংবিধানের তোয়াক্কা না করে ‘অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া বর্গ’-এর (ইবিসি) সংরক্ষণের নামে এদের দশ শতাংশ সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করে। মহারাষ্ট্র, গুজরাট ইত্যাদি রাজ্যে আলাদাভাবে সংরক্ষণের কথা ঘোষিত হলেও লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে কেন্দ্রীয়ভাবে এই সংরক্ষণের ঘোষণা করে এবং রেল সহ অন্যান্য পরীক্ষার জন্য ফর্মে এই মর্মে একটি কলাম-ও রাখে। কিন্তু এই অগ্রবর্তী কৃষক-জাতগুলির সংরক্ষণের ব্যবস্থা কি ‘বিজেপির বিজয়ের কারণ’-এর মধ্যে ঢুকবে না? তা কি ‘বিজেপি-র কারণ’-এর মধ্যে আসবে? এইসব প্রশ্নের পরে উত্তর দেওয়া যাবে। আপাতত এই লোকসভা নির্বাচনে অন্যান্য জাতগুলির সমর্থন কতটা বিজেপির দিকে গেছে, তার তথ্যগুলি নেওয়া যাক। নিচের ছবিটি সিএসডিএস-এর সমীক্ষা রিপোর্টের ওপর সঞ্জয় কুমার — প্রণব গুপ্ত -র লাইভমিন্ট পত্রিকার ওয়েবসাইটে ৩ জুন ছাপা হওয়া প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।

সিএসডিএস এর সমীক্ষা অনুসারে বিজেপির সমর্থন। লাইভমিন্ট পত্রিকার ওয়েবসাইটে ৩ জুন প্রকাশিত। জনসংখ্যার হিসেবে ওবিসি নিম্নবর্গগুলি মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশের মতো। এই বর্গটি সবচেয়ে বড়। তারপরেই আছে তপশিলি জাতগুলির আয়তন — প্রায় ১৭ শতাংশ। জাঠ মারাঠা পতিদার-রা বড়ো জমির মালিক চাষি — মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের মতো। অপরদিকে ব্রাহ্মণ কায়স্থ বানিয়া রাজপুত দের যে অগ্রবর্তী বর্গ — জনসংখ্যার তার আয়তন ৮ শতাংশের মতো। ওবিসি উচ্চবর্গ-ও জমির মালিক চাষি, মাঝারি মাপের জমির মালিক। জনসংখ্যায় এদের আয়তন ১৩ শতাংশের কাছাকাছি। তপশিলি উপজাতি তথা আদিবাসীদের আয়তন জনসংখ্যার ৯ শতাংশের মতো। চিত্রটি ঈষৎ সম্পাদিত (জনসংখ্যার বাকি ১৩ শতাংশ মুসলিম, আদের বিজেপি-কে ভোটের হারের কলামটি অপ্রাসঙ্গিক বলে বাদ দেওয়া হয়েছে)

বেশ কিছুদিন ধরেই জাত-রাজনীতিতে ওবিসি বা ‘অন্যান্য পশ্চাদপদ বর্গ’ এর অন্তর্গত যারা তারা বিজেপির একটি শক্তপোক্ত ঘাঁটি। সিএসডিএস ওবিসি-কে দুই ভাগে ভাগ করেছে। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি ওবিসি বলে বলা হয়, মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট মোতাবেক, যদিও এনএসএস এর সমীক্ষা এবং ২০১১ সালের জাত-জনগণনা উভয়তেই পাওয়া যায় – এই সংখ্যা ৪১ শতাংশের মতো। কেন্দ্রীয়ভাবে ওবিসি সংরক্ষণ ২৭ শতাংশের মতো। এই ওবিসি ক্যাটেগরির মধ্যে কিছু জাত-এর (যেমন, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে যাদব এবং কুর্মীরা, পশ্চিমবঙ্গ বিহার ওড়িশায় মাহিষ্য-রা, কর্ণাটকে ভোক্কালিগা-রা) জনসংখ্যা ওবিসি জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। কিন্তু গ্রামীন অর্থনীতিতে এদের জোর বেশি, কৃষিজমির মালিকানা এদের বাকি ওবিসি-র অন্তর্গত জাতগুলির তুলনায় অনেক বেশি। এদের ওবিসি উচ্চবর্গ ধরা হয়। এবং বাধিয়া লোহার কেওয়াত ইত্যাদি যে জাতগুলি ওবিসি জনসংখ্যার সিংহভাগ বা দুই তৃতীয়াংশ, কিন্তু জমির মালাকানা খুবই কম — তাদের ধরা হয় ওবিসি নিম্নবর্গ হিসেবে।

ওবিসি সংরক্ষণের রাজনীতি সত্তর দশক থেকে শুরু হয়েছে। প্রথমবারের জন্য যখন কেন্দ্রে অকংগ্রেসী সরকার তৈরি হয়, ১৯৭৭ সালের মোরারজী দেশাই-এর নেতৃত্বাধীন জনতা সরকার, সেই সরকারে নানাভাবে অংশীদার ছিল এখনকার বিজেপির পূর্বসূরীরা। তখনই তপশিলী জাতি এবং উপজাতি বাদ দিয়েও মূলতঃ কৃষক যে জাতগুলি ছিল তাদের উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করার জন্য তৈরি হয় মণ্ডল কমিশন। ফের নয়ের দশকে কংগ্রেস সরকারের পতনের মাধ্যমে জনতা সরকার আসলে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসে এবং ওবিসি সংরক্ষণের জমি প্রস্তুত হয়। ফলতঃ ওবিসি রাজনীতিতে বিজেপির রাজনৈতিক পূর্বসূরীরা অনেকদিনই হাত পাকিয়েছে।

ওবিসি নিম্নবর্গ

এই ওবিসিদের মধ্যে যারা নিম্নবর্গ — ওবিসি সংরক্ষণের সুফল তারা পায়নি, পেয়েছে ওবিসিদের মধ্যে যারা উচ্চবর্গ, কেবল তারাই। তথ্যভিত্তিক না হলেও ওবিসি-র অন্তর্গত জাতগুলির মধ্যে ধারনা এমনই। এই ধারনা সম্প্রতি ভাষা পেয়েছে জাস্টিস রোহিনী কমিটির রিপোর্টের মধ্যে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ওবিসি-দের মধ্যেও যারা নিম্নবর্গ — তাদের চিহ্নিত করার জন্য জাস্টির রোহিনীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করে। সেই কমিটি বিস্তারিত সমীক্ষার জন্য প্রচুর ফান্ড দাবি করে, এবং সেই সমীক্ষা না করেই এইবারের লোকসভা নির্বাচন চলাকালীনই ঘোষণা করে দেয় — ওবিসিদের মধ্যেও যারা নিম্নবর্গ — তাদের পৃথক সংরক্ষণ প্রয়োজন ওবিসি সংরক্ষণের মধ্যেই। কমিটির দাবি অনুসারে — কুর্মী যাদব ইত্যাদি কয়েকটি উচ্চবর্গের জাত বাদ দিলে ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় পড়ে এরকম প্রায় ১৯০০ জাত আছে, যারা এতদিনকার ওবিসি সংরক্ষণের ৩ শতাংশ মাত্র হয়ে থেকেছে। ফলতঃ এই ওবিসি নিম্নবর্গ ১৯০০ জাতের সংরক্ষণ চাই — ৮-১০ শতাংশ।

ওবিসি সংরক্ষণের মধ্যে থেকে যে রাজনৈতিক, চাকরি-বাকরি এবং উচ্চশিক্ষায় একটা বড় অংশ বাদ গেছে, সুবিধা নিয়েছে ওবিসি-দের মধ্যের কিছু শক্তিশালী জমিওয়ালা কৃষক জাত — তার একটি সুন্দর পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ভারতীয় সামাজিক পার্টির আর কে সাইঁ এর একটি বক্তব্যে। হরিয়ানার এমএলএ এবং এমপি-দের পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেছিলেন,

কৃষির সঙ্গে জড়িত সমস্ত জাতগুলো সুবিধা পেয়েছে। যাদব, কুর্মী, মেও, গুজ্জর — সবাই সুফল ভোগ করেছে এবং আমরা কিছু পাইনি। হরিয়ানাতে ১৮ জন ওবিসি এমএলএ আছে। তাদের মধ্যে যাদব, কুর্মী, মেও, গুজ্জর আছে ১৫ জন। এই জাতগুলির মধ্যে থেকে মোট ৩ জন এমপি-ও আছে। হরিয়ানার মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ এই জাতগুলির অন্তর্গত। এছাড়া ওবিসি-র মধ্যে পড়ে এরকম আরো ৬৭ টি জাত আছে, এবং তারা হরিয়ানার মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ। কিন্তু হরিয়ানার ৯০ জন এমএলএ র মধ্যে এরা মাত্র ৩ জন। এদের মধ্যে থেকে একজনও এমপি নেই।

এইবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই ওবিসি-দের মধ্যে যে নিম্নবর্গ — তাদের মধ্যে নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করে ফেলার সুবিধা পেয়েছে। রোহিনী কমিটি গঠন, রোহিনী কমিটির সুপারিশ, এবং তারও আগে মন্ডল কমিশন এবং ওবিসি সংরক্ষণের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকা এবং যেহেতু মণ্ডল কমিশন ও ওবিসি সংরক্ষণ লাগু করেছিল জনতা সরকারগুলি যেখানে সংঘ পরিবারের প্রতিনিধিরা নেতৃত্বে ছিল না, আশেপাশে ছিল, তাই ন্যায়বিচার হয়নি — এই বাচন তৈরি করে ওবিসি নিম্নবর্গের মধ্যে জমি পেয়েছে বিজেপি। যে স্বজাতের বাসনা রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল পূর্বতন জনতা সরকারগুলির আমলে — সেখানে সমালোচনামূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

প্রসঙ্গতঃ, আমাদের দেশে প্রথম জাত-জনগণনা হয় ১৯৩১ সালে। পরে ১৯৫১ সালে আরেকটি জাত-জনগণনা হয়, কিন্তু তার ফল প্রকাশ করা হয়নি। তারপর ২০১১ সালে লালু-মুলায়ম-মায়াবতীদের চাপাচাপিতে মনমোহন সিং এর সরকার আবার জাত জনগণনা করে। এই জাত-জনগণনাটি হয়েছিল সম্পূর্ণ পেপারলেস বা কাগজকলম না নিয়ে এবং অডিও রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে। এতে মানুষকে গণনাকারীদের কাছে তাদের জাত বলতে বলা হয়েছিল। পরে এই জাত-জনগণার কাঁচা তথ্য পাঠানো হয় রাজ্যগুলির কাছে, কারণ দেখা যায়, এই গণনায় প্রচুর ভুল রয়েছে, সংখ্যায় তা দশ লক্ষেরও বেশি। রাজ্যগুলি সেই ভুলগুলি সংশোধন করে পাঠানোর পরও দেখা যায় লক্ষাধিক ভুল রয়ে গেছে। ২০১৫ সালে এই জাত-জনগণনার রিপোর্ট আংশিক প্রকাশিত হয়, তাতে অর্থনৈতিক নানা তথ্য দেওয়া হলেও জাত সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ সরলভাবে বললে, জাত-জনগণনার রিপোর্ট চেপে দেওয়া হয়। বিহার উত্তরপ্রদেশের মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলি এই তথ্য প্রকাশ্যে আনার জন্য সরকারকে চাপ দেয় — কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই তথ্য প্রকাশ করেনি। উল্টোদিকে এই বিজেপি সরকারই কিন্তু ২০২১ সালের জনগণনায় জাত-কে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে। যদিও ২০১১ সালের জনগণনায় জাত-কে অন্তর্ভুক্ত করার তারা বিরোধিতা করেছিল।

আদিবাসীদের মধ্যে বিজেপির সমর্থন দীর্ঘদিনের। একইসাথে তপশিলি জাতি বলে যারা পরিচিত সেই সমস্ত জাতগুলির মধ্যেও বিজেপির ভিত্তি তৈরি হয়েছে। আদিবাসী এবং তপশিলিদের মধ্যে বিজেপির ভিত্তি নিয়ে আলোচনা আগেও বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে। মূলতঃ হিন্দু মূলস্রোতে ঢুকে পড়ার বাসনাকে পুঁজি করে বিজেপি ভিত্তিস্থাপন করেছে এদের মধ্যে, এরকমই ভাবা হয়। আদিবাসী এবং তপশিলি জাতির বিভিন্ন জাতসমূহের স্বজাতীয় বাসনা যদিও আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে নানাভাবে। আশা করা যায়, আগামীদিনে সেই বাসনা ‘হিন্দু মূলস্রোতে ঢুকে পড়া’র বাসনাকে অতিক্রম করতে পারবে।

স্বজাত রাজনীতি কীভাবে বিজেপি করেছে, তা ফুটে ওঠে উত্তরপ্রদেশের কনৌজ-এ নরেন্দ্র মোদির একটি ভাষণের অংশে —

“আমার জাত এতই ছোটো এতই ছোটো যে গ্রামে গ্রামে এক ঘর করেও হয়ত পাওয়া যাবে না। আর আমি তো পশ্চাদপদ না, অতি পশ্চাদপদ ঘরে জন্মেছি।

আত্মপরিচয়ের রাজনীতি

আমাদের মনে হয়েছে, এই বিজেপির নানা ধরনের জাতভিত্তিক সমর্থনের একটা বড় কারণ মানুষের স্বজাতের বাসনা। জাত কথাটার মধ্যেই আছে আত্মপরিচয়ের একটি ঠিকানা — যা জন্মগত। আমাদের দেশে জাত-এর একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি রয়েছে। জাতের ওপর আমাদের নিজেদের কোনো হাত নেই, তা জন্মগত পাওনা। জন্মগত-কে পেরিয়ে যাওয়া যেমন জীবনের ধর্ম, তেমনি জন্মগত-র আবেগও খুব স্বাভাবিক মানবধর্ম — কারণ বোধবুদ্ধি হবার আগে অবদি মানুষ ওই জন্মগত পরিমণ্ডলেই তার শৈশব এবং কৈশোর অতিবাহিত করে — এক অসহায়তার মধ্যে ওম পায় সেই জন্মগত পরিমণ্ডল থেকেই। আমাদের শিক্ষার মধ্যে বেশিরভাগটাই সমাজ থেকে, বিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও। সেই সামাজিক শিক্ষার অনেকটাই আমাদের হয় ওই জন্মগত পরিমণ্ডলে। তাই স্বজাত-এর প্রতি যে আবেগনির্ভর টান থাকে এবং থেকে যায় তা অনস্বীকার্য। তারপর বড় হবার মধ্যে দিয়ে মানুষ তার জন্মগত পরিমণ্ডলের সীমাবদ্ধতা চিনতে পারে, তাকে অতিক্রম করতে চায়। এই টানাপোড়েন থাকে জীবনভর।

বিজেপি-র রাজনীতি আত্মপরিচয়-নির্ভর। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ রাজনৈতিক আদর্শ যখন সর্বমঙ্গলের পথে হাঁটে — তখন বিজেপি উল্লেখযোগ্যভাবে আত্মপরিচয়ের ওপর দাঁড়িয়ে তার রাজনীতিকে সাজানোর চেষ্টা করেছে। এই আত্মপরিচয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাত। আমি কে? — এই প্রশ্নের উত্তরে যা আসে। নিজের সংস্কৃতি, নিজের পাড়া, নিজের চারপাশ, নিজের শৈশব কৈশোরের ওপর দাঁড়িয়ে যে রাজনীতি এইই বিশ্বায়ন-উত্তর পৃথিবীতে সংস্কৃতির প্রাচুর্য্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার জমি দেয় — তার সহিষ্ণু এবং অপরের প্রতি আত্মীয়তা ভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক প্রকাশের অনুপস্থিতিতে বা দুর্বলতায় — বিজেপির বিদ্বেষের রাজনীতির মধ্যেই সে আজ আশ্রয় খুঁজেছে।

চাই সমতার প্রেক্ষাপট

এর প্রতিরোধ যদি করতে হয়, তাহলে মানুষের স্বজাতের বাসনা-কে মর্যাদা দিতে হবে। আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বিদ্বেষের প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে কানাগলি, কিন্তু আত্মপরিচয়ের রাজনীতি অপরের প্রতি আত্মীয়তা ও সহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটেও হতে পারে। এই প্রেক্ষাপট নির্মাণে সবচেয়ে সাহায্য করতে পারে ইকুইটি বা সার্বিক সমতার ধারনা। সমতা আর সমানতা এক নয়। সমানতা-তে মনে করা হয় প্রতিটি মানুষ সমান এবং কাউকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত না। কিন্তু সমতার ধারনা সে কথা বলে না। সমতার দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান নয়। মানুষ তার কৌম ও সামাজিক উৎসের কারণে নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে থাকে। সেই প্রতিবন্ধকতার মূল কারণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজ-বিত্ত-ব্যবসা-সুপরিবেশ-অবকাশ-ভ্রমণ ইত্যাদির যে জগৎ — সেই জগৎ সমান নয় — সেই জগৎ বা দুনিয়া — সেখানে আগে যারা ঢুকেছে তারাই তৈরি করেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের সুযোগসুবিধার কথা ভেবেই তৈরি করেছে। প্রয়োজন সেই জগৎগুলিতে বাকিদের বিশেষ সুবিধার মধ্যে দিয়ে ঢোকা নিশ্চিত করা এবং একইসাথে এই জগৎগুলির হালচালও বদলানো যাতে তা সেখানে আগে যারা ঢুকে পড়েছিল, তাদের বাগানবাড়ি না হয়ে থাকে আর। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমাদের বাংলা মাধ্যমের বইগুলিতে যে বাংলা ভাষায় লেখা থাকে সেটা শান্তিপুরী বা কলকাতার বাংলা ভাষা — সেটাই মান্য বাংলা ভাষা। তার কারণ বাংলায় লেখাপড়ার জগৎ ছিল এই গাঙ্গেয় বঙ্গের শহরবাসীর দখলে। কিন্তু এই ভাষার পাঠ্যপুস্তকে উত্তরবঙ্গের একজন বাংলাভাষী সমস্যায় পড়ে, এমনকি দক্ষিণবঙ্গের গ্রামবাংলার শিক্ষার্থীও সমস্যায় পড়ে, কারণ তার জন্মগত কারণে যে চেনা শব্দভাণ্ডার তার থেকে মান্য বাংলায় যে পাঠ্যপুস্তক, তার শব্দরাজি অনেকটাই আলাদা। সমতার ধারনা, যে সমস্ত বাংলাভাষীর মাতৃভাষা লিখ্য বা মান্য বাংলা নয় — পড়াশুনা বা চাকরিবাকরিতে তাদের আলাদা সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করবে, কারণ বিজাতীয় ভাষায় শিক্ষালাভের প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হয়েছে তাকে। একইসাথে, সমতার ধারনা, পাঠ্যপুস্তকেও মান্য বাংলা শব্দের ব্যবহার কমিয়ে গ্রামবাংলার ভাষা এবং বাংলার প্রান্তের শব্দভাণ্ডার বাড়ানোর কথা বলবে। এইরকম।

নিচে একটি সমতার ইস্তাহার দেওয়া রইল : —

সমতার ইস্তাহার

(খসড়া)

সমতা আর সমানতা এক নয়। নিচের ছবিতে এই দুই-এর মধ্যে ফারাক স্পষ্ট। আমরা সমানতার বদলে সমতাভিত্তিক কিছু ব্যবস্থা চাইছি।

১) বর্তমান ভারতে সমতা নেই। জাত-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণী-বর্ণ-জাতিসত্ত্বা-ভৌগলিক অবস্থান ইত্যাদি ভেদ-এ কারোর বেশি সম্পদ তো কারোর কম। কারোর শিক্ষার হার বেশি তো কারোর কম। কারোর চাকরি বেশি, ব্যবসা বেশি। কারো কম। কারো স্বাস্থ্য ভালো, কারো মন্দ। ফলতঃ আমরা সমতার ইস্তাহার তৈরিতে বাধ্য হচ্ছি। এই ইস্তাহার একটি উদ্দেশ্য নিয়ে, তা হল এই যে অসমতা — তার অবসান।

২) ভেদাভেদ নানা প্রকার। ভেদাভেদ বরাবর বিদ্বেষও আছে ষোলো আনা। তাই ভেদাভেদগুলি এড়িয়ে যাওয়া ঠিক না। আমরা মনে করি, ভেদাভেদগুলি একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান নিয়ে তখনই চলতে পারবে, যখন অসমতা ঘুঁচে গিয়ে সমতা আসবে। নচেৎ পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষ অনিবার্য, তাই সমতার ইস্তাহার এই পারস্পরিক বিদ্বেষ কাটানোরও একটা উপায়।

৩) ধর্মের দিক দিয়ে দেখলে ভারতে প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বলে নিজেদের পরিচয় দেন। দেখা যায়, শিক্ষা স্বাস্থ্য সব দিক দিয়েই হিন্দুরা এগিয়ে মুসলমানদের তুলনায়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায়। তাই মুসলিমদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, রোজগার, ব্যবসা, বাসস্থান ইত্যাদি উন্নয়ন সূচকে অমুসলিমদের সমপর্যায়ে আনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (সংরক্ষণ, ইনসেনটিভ ইত্যাদি) নিতে হবে। মুসলিমদের মধ্যে অপরাধের হার বেশি। তা কমাতেও সাহায্য করবে এই বিশেষ ব্যবস্থা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও উক্ত বিশেষ ব্যবস্থা চাই।

৪) লিঙ্গের দিক দিয়ে পুরুষ ও মহিলার (এবং অন্যান্য লিঙ্গের) ফারাক উল্লেখযোগ্য। সেই ফারাক সমস্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক পরিসর এবং সমস্ত জায়গায় ঘোঁচাতে হবে। এবং তার জন্য মেয়েদের দিকে টেনে নানা ব্যবস্থা করতে হবে।

৫) জাতের দিক দিয়ে এসসি এসটি ওবিসি রিজার্ভেশনের একটা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এইসমস্ত ক্যাটেগরির মধ্যে পড়ে যে বিপুল সংখ্যক জাত, যাদের সাব-কাস্ট বলা হয়, তার মধ্যে দিয়ে যেন ভাবা হয় এসসি একটা জাত, আর তার অন্তর্গত কোনো একটা জাত হল এসসি-র সাব কাস্ট। এই ধারনা ভুল। এসসি, এসটি, ওবিসি এগুলো অফিসিয়াল বা সরকারি নাম মাত্র। আসল জাত হল, কুর্মী, মাহাতো, সাঁওতাল, লোধা, শবর, জাঠ, পতিদার ইত্যাদি। এসসি, এসটি, ওবিসি নামক সরকারি বন্ধনী দিয়ে নয়, জাতকে তার নিজস্ব জাত হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সংখ্যাগত অনুপাতে সুবিধার (সংরক্ষণ, ইনসেনটিভ ইত্যাদি) বন্দোবস্ত করতে হবে শিক্ষা, চাকরি, রাজনীতি সহ সর্বত্র।

৬) ফেডারেলিজমকে উন্নয়নের নিরিখে পুনঃসংজ্ঞায়ন করতে হবে। একটি রাজ্য যদি অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় উন্নয়নের সূচকগুলিতে পিছিয়ে থাকে অনেকটাই, তাহলে সেই রাজ্য দুর্বল হতে বাধ্য। ফেডারেলিজম-এর পূর্বশর্ত রাজ্যগুলির মধ্যে উন্নয়ন সূচকের সমতা। সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

৭) শিক্ষা, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকা নির্ধারক। ফলতঃ উন্নয়নের এই নিরিখগুলিতে ভাষাগত অসমতা, যা কি না বৈষম্যের রূপে আসে – এই ভাষাগত অসমতা দূরীকরণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৮) সমস্ত সামগ্রিক স্বার্থের কাজ – যেমন পরিবেশ রক্ষা, জৈব চাষ, শরীরচর্চা, বৃক্ষরোপণ, ত্রাণকার্য — এগুলোতে সরকার ও মানুষের সংগঠনগুলি কাজ করে। এই সমস্ত কাজ এবং উদ্যোগে জাত-লিঙ্গ-শ্রেণী-ধর্ম-ভাষা-জাতি ইত্যাদি ভিত্তিক সমতামূলক অংশগ্রহণ চাই। এগুলির সুফল ভোগও সমতার আদর্শের ভিত্তিতে হতে হবে।

৯) সম্পদের অসম বন্টন এবং এই অসাম্যের বেড়ে চলা আমাদের দেশের এক সমস্যা। হয়ত গোটা পৃথিবীরই। পুঁজিবাদের কারণে এই অসাম্য বেড়েই চলেছে, অর্থনীতিবিদরা তাই দেখাচ্ছেন। সেই সমস্যার নিরসনে এখানেও সমতার আদর্শের প্রয়োজন। বড়লোকদের কাছ থেকে সরাসরি টাকা নিয়ে গরীবদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। এবং এই পুনর্বন্টন চলতেই থাকবে, যতদিন বিত্তবন্টনে অসাম্য থাকবে।

১০) চাকরির বেতনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বেতন এবং সর্বনিম্ন বেতনের মধ্যে তফাতও বড্ড বেশি। এক্ষেত্রেও সমতা প্রয়োজন। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সাপেক্ষে বেতনের কমবেশি হতে পারে, কিন্তু সর্বোচ্চ বেতন কখনো সর্বনিম্ন বেতনের তিন-চার গুণের বেশি হওয়া চলবে না।

১১) এই ইস্তাহারে উন্নয়নের সূচক বলতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, ব্যবসা, বিত্ত, ক্রয়ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, যোগাযোগের ক্ষমতা, সুপরিবেশ, অবকাশ, ভ্রমণ ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে।

১২) এই ইস্তাহার একটি অস্থায়ী কর্মসূচী। এটা কোনো সংগঠনের কর্মসূচী নয়। কোনো কার্যক্রমও নয়। সাধারণ ইস্তাহার। অনেকটা নুনের মতো। আমাদের চারপাশের নানা কর্মউদ্যোগের স্বাদ বদল করার ক্ষমতা রাখে এই ইস্তাহার, কিন্তু তা করতে গিয়ে এ সেই কর্মউদ্যোগগুলির মধ্যে নিজের কেলাসিত রূপটি বিসর্জন দেয়, নিজে আলাদা অস্তিত্বে থাকে না। এই ইস্তাহার নিজে কখনোই কোনো কেলাসিত রূপ হয়ে উঠবে না। এই ইস্তাহার মাঝে মাঝে পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন হতে পারে। আপাতত একটা ফেসবুক পেজ-এ এই ইস্তাহারটি থাকতে পারে এবং এই ইস্তাহারের উপযোগী নানা তথ্য সম্বলিত প্রচার সমীক্ষা কথোপকথনের জন্য মাসে একদিন করে কয়েক ঘন্টার জন্য বসা যেতে পারে, ইচ্ছুকদের নিয়ে। এটুকুই তার সংগঠন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *