করোনা ও পরিযায়ী শ্রমিক : মিডিয়ার আন্তরিকতা, সরকারের নিষ্ঠুরতা ও বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা ইতিহাসে লেখা থাকবে

মিঠু প্রামাণিক

প্রথম করোনা ভাইরাসের কথা জানা যায় চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। নিউমোনিয়া অসুখের মতো কিন্তু নিউমোনিয়ার ওষুধে সেরে উঠছে না। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯। তারপর সেই উহান শহরের অসুখ নানা দেশ ঘুরে ভারতের বিমানে চেপে ভারতবর্ষেও পৌঁছল। আমরা করোনা আক্রান্ত হতে শুরু করলাম। গ্লোবাল ইকনমির গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা আমরা। ভারতবর্ষের প্রথম করোনা ধরা পড়ে ৩০ জানুয়ারি ২০২০ তে। আর প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ৯ মার্চ। এর মধ্যে ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) করোনা রোগকে প্যান্ডেমিক বা অতিমারী বলে ঘোষণা করেছে। এর অর্থ পৃথিবীর সব দেশে করোনা নিশ্চিত থাবা বসাবে। চীনদেশে করোনার থাবায় কারখানা ও শহর উচ্ছন্নে যাচ্ছে। পৃথিবীময় আতঙ্ক। এদিকে আমরা ভারতীয়রা আশু অতিমারীর চিকিৎসার জন্য আগাম কোনো ব্যবস্থাই দাবি করলাম না। (আচ্ছা, এখনো করছি না কেন?) উল্টে ১৩ মার্চ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হল, না, করোনা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি ব্যাপার নয়। যেদিন দেশে করোনা আক্রান্ত ৮১ জন, সেই ২২ মার্চ জনতা কার্ফু মেনে চললাম। ২৪ মার্চ ঘোষণা হল, ২৫ মার্চ থেকে সারা দেশে লকডাউন শুরু হবে। সবাই গৃহে অন্তরীণ থাকবে। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশে ২২ মার্চ বিজেপি কংগ্রেস সরকার ফেলে নিজেদের সরকার গড়ল, অভিযোগ, টাকা দিয়ে কংগ্রেসের ২১ এমপি-কে কিনে নিয়ে। ট্রাম্পকে নিয়ে আমেদাবাদের মোতেরা স্টেডিয়ামে সওয়া লক্ষ লোক নিয়ে সমাবেশ হয়েছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি। এর মাঝে অনেক তীর্থস্থানে লোক পিলপিল করেছে। যদিও মিডিয়াতে বেশি করে এল ১৫ মার্চ থেকে ১৮ মার্চ অবদি দিল্লিতে চলা তবলিগী জামাতের কথা। যা ঘটেছিল লকডাউন ঘোষণার ছয় দিন আগে। চিৎকার করে ভারতীয় মিডিয়া, সরকার, বিজেপি পার্টি ভক্তকুল বলে উঠেছিল, তবলিগী জামাতিরাই করোনা সারা দেশে ছড়িয়েছে। থানায় এফআইআর। জেল। বিচারসভা চলতে থাকল। এটা ঠিকই, দায়িত্ব কেউ এড়াতে পারে না। জামাতিরা না, বড়ো বড়ো বিখ্যাত মন্দির কর্তৃপক্ষ না, ভারত সরকারও না। এসব ঘটনা রঙ চড়িয়ে মিডিয়া ড্রয়িং রুমে পৌঁছে দিল। হঠাৎ গা ছমছম গৃহবন্দী দশায় দিন এগোল। পৃথিবী জুড়ে থ্রিলার সিনেমা। যেন ঘরে বসে বড়ো পর্দায় দেখছি। এই প্রথম সিনেমা দেখার সাথে যেন অভিনয়ে আমিও আছি।

কিন্তু ২৪ মার্চ সবার জীবনে এমন হলো না। দেশের ৫ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক হঠাৎ সব অর্থে অনাথ হয়ে গেল। পরিযায়ী শব্দটিতে একটা প্রকৃতির কোলের স্পর্শ আছে ও নিরাপত্তা আছে। তাই আমি হঠাৎ সাময়িকভাবে দেশহীন হয়ে যাওয়া বা প্রবাসী শব্দটাই লিখব।

দেশহীনতাই বটে। এক কথায়, এক নিমেষে নোট বন্দীর মতো ঘর বন্দী থাকার নির্দেশ। ঠিক ঐ মুহুর্তেই ঘর-ই হারিয়ে ফেলল পাঁচ কোটি মানুষ। কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল। রোজগার শূণ্য। রাস্তায় গাড়ি চলছে না। ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হলো ২৩ মার্চ মধ্যরাত্রি থেকে। মালিকরা একটাকাও শ্রমিকদের দিল না। হয়ত মাসের আর কয়দিন গেলেই পুরো টাকা পাওয়া যেত। স-ব, সব আত্মসাৎ করল মালিকরা। কারখানার পাশে বা নির্মাণ শিল্পের পাশের বস্তিতে থেকে আর খাবার জুটল না। পাশের দোকানও বন্ধ। যারা দল বেধে ভাড়া বাড়িতে ছিল, তাদের বাড়ির মালিক ভাড়া চাইল। হঠাৎ দেশহীনরা ভাড়া দিতে পারল না। মালিকরা জল সরবরাহ বন্ধ করে দিল, বিদ্যুৎ লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল। এর পরও প্রবাসী শ্রমিকরা কী করবে, কিছু একটা ভাবছিল। কিন্তু বেশি ভাবতে হল না।

মোটামুটি ২৭ মার্চ মালিকের ভাড়া করা পুলিশ এসে পিটিয়েই তাদের ছাদহীন করে রাস্তায় নামিয়ে দিল। ব্রিজের নীচে, রেলস্টেশনে খালিপেটে ২৭ মার্চ থেকে রাজপথে প্রবাসী শ্রমিকের ঢল নামল। শিশুর কোমল নগ্ন পা হাজার মাইল রাজপথের তপ্ত পিচে হেঁটে পুড়তে লাগল। বেঁকে গেল। ঢলে পড়ল মৃত্যুর শীতল স্নেহছায়ায়। ১২০০ মাইল সাইকেল চালালো পনেরো বছরের জ্যোতিকুমারী। মৃত্যু — খিদেয় মৃত্যু, ট্রাক উল্টে মৃত্যু, রাস্তায় গাড়িতে পিষে মৃত্যু। ৮ মে ঔরঙ্গাবাদে রেলস্টেশনের কাছে রেললাইনে একটি মাল ট্রেন ১৬ জন ক্লান্ত শ্রমিককে থেতলে কেটে তালগোল পাকিয়ে দিল। পাশের পরে রইল পূর্ণিমা চাঁদের মতো গোল গোল রুটি। ওটা সাধারণ রুটি নয়। সারা ভারতবর্ষকে শত শত প্রশ্ন করতে লাগল। এই ষোলোজন মহারাষ্ট্রের জলনা-তে প্রাইভেট স্টিল কোম্পানিতে কাজ করতে কেন গিয়েছিল? ২৪ মার্চের পর থেকে কেন ওরা একটাও টাকা পায়নি? লকডাইনের ৪৪ দিন বাদে মধ্যপ্রদেশে নিজেদের বাড়ীর দিকে রেললাইন ধরে কেন এগোল?

যারা বিদেশে থাকে তাদের সরকার হাওয়াই জাহাজে করে নিয়ে এল। সেটা খুবই ভালো কাজ। এর পোশাকী নাম বন্দে-ভারত-মিশন। প্রথম পর্বের উড়ানে স্বল্প ভাড়ায় সত্যিকারের প্রবাসীরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে ঘরে পৌঁছল সাত-ই মে। আর ষোল জন শ্রমিক (নাকি তাদের বিদেশী ভাবে ভারতবর্ষ) ট্রেনে কাটা পড়ল ৮ মে। দিলীপ ঘোষ বলল, সুপ্রিম কোর্ট, বুদ্ধিজীবী-ভক্তরা বলল, কেন লাইনে ঘুমাতে গেল। লাইন কি ঘুমানোর জায়গা?

এসময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কী করছিল? সোসাল ডিসট্যান্সিং অমান্য করার জন্য অভুক্ত ক্লান্ত শ্রমিকদের যাত্রাপথে পুলিশ মোতায়েন করছিল। মূল রাস্তা, আন্তঃরাজ্য বর্ডার সব পুলিশের নজরদারীতে ছিল। পাঁচ কোটি শ্রমিক কী করবে? ২৯ মার্চ স্বরষ্ট্রমন্ত্রক নির্দেশ জারি করেছিল —

“সমস্ত নিয়োগকর্তা, সে শিল্প হোক বা দোকানপাট বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই হোক — নির্ধারিত তারিখে কোনো ছাড় ছাড়াই তাদের কর্মস্থলগুলিতে সকল শ্রমিকদের মজুরি প্রদান করতে হবে।”

এতে আরো বলা হয়, “অভিবাসী যে কেউ যেখানেই ভাড়া বাড়িতে আছে সেখানে বাড়ির মালিকরা এক মাসের জন্য বাড়ি ভাড়া নিতে পারবে না।” যদি বাড়ির মালিক বাড়ি খালি করে দিতে বলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার তার নিজের আইনে একরকম হুকুম করছে, অন্যদিকে কারখানা মালিক, ভাড়াবাড়ি মালিক, আর পুলিশ মিলে ঠিক উল্টো প্রয়োগ করল। ফলে ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ যারা তৈরি করবে, তারাই রাস্তায়, বিনা খাবারে। বিনা জলে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। শিশুর মুখে খাবার তুলে না দিতে পেরে মা বাবা শুধুই কেঁদেছে। এক সময় চোখের সব জল শুকিয়ে গেছে।

সরকারের নির্দেশ কী ঝুটা? যার ওপর ভরসা রাখা যায় না? ভরসা না রেখে শ্রমিকরা কেন শুরু করেছিল নিরুদ্দেশের যাত্রা? সেটা কি ঠিক ছিল? তাদের কি ধৈর্য ধরা উচিত ছিল না? ২৯ মার্চ আদেশ জারির পর কোনো শ্রমিক টাকা পায়নি। উল্টে ৪ জুন সমস্ত মিল মালিকরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হল। তাদের বক্তব্য ছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশ বেআইনি। ১৫ মে সুপ্রিমকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েই দিয়েছিল। ১২ জুন সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল, “আমরা নির্দেশ দিচ্ছি, চাকুরিদাতা-দের ওপর কোনো জোরাজুরি করা চলবে না জি মিডিয়া, নম্রতা আগ্রওয়াল, ১২ জুন)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশ নিয়ে যে সব শ্রমিক সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল, তারা খালি হাতে ফিরল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকও নতুন নির্দেশ জারি করে আগের নির্দেশ বাতিল করে দিল।

“ওসব ফেক নিউজ স্যার” — কেন্দ্র সরকার জানালো সুপ্রিম কোর্টকে

শ্রমিকরা রাস্তায়। সুপ্রিম কোর্টে গেল শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিকদের অবর্ণনীয় কষ্ট লাঘব করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট কিছু করুক। সংবিধানের সর্বোচ্চ রক্ষাকর্তা হিসেবে এত বড়ো মানব সংকট দেখে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। হায় ভারতবর্ষ! ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল, শ্রমিকদের জন্য ভারত সরকার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে? সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জবাব দিল, সরকারের ব্যবস্থা খুবই ভালো মানের। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। সুপ্রিম কোর্ট জানতে চাইল, তাহলে যে মিডিয়াতে দেখাচ্ছে, রাস্তায় শ্রমিক ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে, মরছে — এসব কী? সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জবাবে বললেন, ওসব ফেক নিউজ স্যার। ব্যাপারটা সুপ্রিম কোর্টকে তুষার মেহতা বুঝিয়ে বললেন, দেখুন স্যর, কেভিন কার্টার বলে একজন দক্ষিণ আমেরিকান ফটো জার্নালিস্ট ছিলেন। সুদানে গিয়ে ক্ষুধার্ত প্রায় মৃত শিশুর ছবি তুলেছেন। পেছনে শকুন, অপেক্ষারত। শিশুটি মারা গেলেই ঠুকরে খাবে। ছবিটির নাম দিলেন, The vulture and the little girl. ফিচার ফটোগ্রাফটির জন্য পুলিতজার পুরষ্কার পেলেন। ১৯৯৩ সাল। তখন ওর বয়স ৩৩ বছর। উনি শেষে আত্মহত্যা করেন। কেন জানেন স্যার? একজন কেভিনকে বলেছিল, আচ্ছা কেভিন, ওখানে কটা শকুন ছিল? কেভিন উত্তর করলেন, কেন? একটা শকুন ছিল। প্রশ্নকর্তা জবাব দিলেন, না। ওখানে দুটো শকুন ছিল। একটা শকুনের হাতে ক্যামেরা ছিল। কেভিন সৎ ছিলেন, তাই সে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু ক্যামেরা হাতে ভারতীয় শকুনরা মরবে না। এরা লকডাউনের সুযোগে শ্রমিকদের ব্যবহার করে ফেক নিউজ করছে। ব্রেকিং নিউজ বিক্রি করবে। এদের কথা বিশ্বাস করবেন না স্যর। ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার কথায় সন্তুষ্ট হলেন। এবং ভারত সরকারের পক্ষে রায় দিলেন। ফেক নিউজ আটকাবার রাস্তায় শ্রমিক প্রকৃত অর্থেই ফেক হয়ে রইল। ২ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র দপ্তর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উল্লেখ সহ সমস্ত রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে নির্দেশ পাঠালো, যেন শ্রমিকদের নিয়ে একটিও ফেক নিউজ প্রকাশিত না হতে পারে।

কিন্তু পাঁচ কোটি শ্রমিকের ধারাবাহিক ট্র্যাজেডি আটকানো গেল না। সরকারের চরম মিথ্যাচার নিয়ে মুখ খুলল All India Working News Cameramen Association (WNCA). তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, সরকার পরিবেশিত খবরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারেন না। বরং তারা সবসময় খবর সরবরাহকারীকেই আক্রমণ শানান। এটা অনৈতিক।

সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে, এবং বিচারপতি এল নাগেশ্বর রাও-কে বলেছিলেন, শ্রমিক সংক্রান্ত ফেক নিউজগুলিই অতিমারী প্রতিরোধের প্রধান অন্তরায়। দেশের কোথাও স্বাস্থ সরঞ্জামের খামতি নেই। রোগীর বেডের অভাব নেই। টেস্টিং কিট যথেষ্ট। শুধু শ্রমিকদের ঘরে ফেরার নিউজগুলিই সমস্যা। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলল,

“No electronic/print media/webportal or social media shall print/publish/telecast anything on covid-19 pandemic without first ascertaining factual position from dedicated mechanism created by The Union Government for the purpose of regular dissemination of status of steps taken on ground by govt. across India.”
{কোনো ইলেকট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়া, বা ওয়েবপোর্টাল বা সোসাল মিডিয়া প্রদর্শন বা ছাপানো বা প্রকাশ করতে পারতে পারবে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত এমন কোনো খবর, যা ভারত সরকারের যে সম্প্রচার ব্যবস্থা আছে যাতে বিভিন্ন সরকারগুলো কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার খবর প্রকাশিত হয়, তার থেকে তথ্য যাচাই করেনি।}

২৪ মে থেকে ১৪ মার্চ অবদি কত প্রবাসী শ্রমিক মারা গেল? Thejesh G N, Kanika Sharma, এবং Aman মিলে The Wire পোর্টালে একটি মৃত্যুর খতিয়ান তৈরি করেছেন। হিমশৈলের চূড়া হলেও একটি আঁচ পাওয়া যাবে এতে।

কারণ সমূহমোট মৃত্যু
অর্থাভাবের জন্য অনাহারে (ঘরেই)৫৮ জন
রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে, খাবারের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে২৯ জন
বাড়ি ফেরার রাস্তায় পুলিশের পিটুনিতে মৃত্যু১২ জন
বয়স্ক এবং আশঙ্কাজনক রুগী, যাদের চিকিৎসা দরকার ছিল৪২ জন
রাস্তায় চলাচল আটকে দেওয়াতে আত্মহত্যা৯১ জন
ট্রেন ও রাজপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু৮৯ জন

এছাড়া লকডাউনে অন্যান্য কারণে মৃত্যু নিম্নের সারণিতে বর্ণনা করা হল।

নেশার দ্রব্য না পেয়ে আত্মহত্যা৪৬ জন
অপরাধ মূলক কাজ (সাম্প্রদায়িক নয়)১৪ জন
যাদের নির্দিষ্ট শ্রেণীতে ফেলা যায় না৪৩ জন

জনস্বার্থ মামলার বহুল প্রচলন হয়েছিল ইন্দিরা আমলে জরুরি অবস্থার পর। এই অস্ত্রে পাঁচ কোটি মানুষের হৃদয় বিদারক কষ্ট লাঘবের একাধিক আবেদন নিবেদন বিভিন্ন হাইকোর্টে চলতে থাকল। ১৫ মে আবার সুপ্রিম কোর্ট-এ আবার জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে একটি শুনানি হল। এখানে সুপ্রিম কোর্টের কাছে কী চাওয়া হয়েছিল? National Disaster Management Act 2005 আইন জারি আছে। এখন ভারতবর্ষের প্রত্যেক জেলাশাসক চাইলেই স্বাধীনভাবে সকল শ্রমিকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থাও করতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট যেন আর্টিকল ৩২ অনুসারে এই মর্মে একটি নির্দেশ জারি করে। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলে দিল, না, এই মর্মে কোনো নির্দেশ তারা জারি করবে না। আদালতের পক্ষে চলমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে মানুষের চলাচল পর্যবেক্ষণ করা বা থামানো অসম্ভব। বরং রাজ্য সরকারগুলো অভিবাসী শ্রমিকদের দায়ভার নিক (টাইমস নাও, ১৫ মে ২০২০)।

১৫ মে যখন সুপ্রিম কোর্ট দেশের শ্রমিকদের সাংবিধানিক সুরক্ষা বলয় দিতে এগিয়ে এল না, তখন, ১৬ মে শুক্রবার মাদ্রাজ হাইকোর্ট শ্রমিকদের পক্ষে আবেগঘন সমবেদনা শোনালো। কোর্টে সাধারণতঃ এরকম হয় না। “গত একমাস ধরে মিডিয়াতে প্রদর্শিত অভিবাসী শ্রমিকদের করুন অবস্থা দেখে কেউ আর অশ্রু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এটা মানবিক ট্র্যাজেডি ছাড়া আর কিছু নয়।

“অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে এই সমস্ত ব্যক্তি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অবহেলিত ছিল। হৃদয়বিদারক কাহিনীগুলি প্রিন্টের পাশাপাশি ভিজুয়াল মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। তারা ছোটো ছোটো বাচ্চাদের মাথায় নিয়ে, সাথে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য নিজ নিজ দেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

“সরকার এই শ্রমিকদের সহায়তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনও খবর পাওয়া গেছে, যে কিছু লোক ক্ষুধার কারণে মারা গেছে। ৮ মে রেলপথে ঘুমন্ত অবস্থায় মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশে ভ্রমণরত অবস্থায় ষোলোজন শ্রমিক মারা গেলেও সরকার কোনো সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়নি।

“এটি কেবল নেটিভ স্টেটেরই কর্তব্য নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও দায়িত্ব সে যেন অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের যত্ন নেবার কাজ করে। ভারত একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এবং সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে সুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। প্রবাসী শ্রমিকরা একসাথে মাসখানেক ধরে শত শত মাইল হাঁটছে এবং রাস্তার ধারে প্রাণ হারাচ্ছে দেখে দুঃখ হয়।”

আবার ২৫ মে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র উকিলরা মিলে যৌথভাবে প্রধান বিচারপতির কাছে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। সেখানে আবেদন রাখা হয়, খুব দ্রুততায় শ্রমিকদের পাশে না দাঁড়ালে দেশে স্বাধীনতার পর সব থেকে বড়ো মানবিক ট্র্যাজেডি দেখতে হবে। সংবিধানের সমস্ত ধারা উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেন সিনিয়র উকিলগণ।

লকডাউনের ৬২ দিন পর ২৫ মে সুপ্রিম কোর্ট একটু নড়েচড়ে বসে। ২৬ মে মঙ্গলবার সর্বোচ্চ কোর্টের তিনজন বিচারপতি বলেন, “There have been inadequacies and certain laps on the part of the central and state governments in dealing with the migrant workers crisis during the lockdown.” {লকডাউনে অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি যা যা পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।}
“The court admitted that the crisis is even continuing today with large section of migrant workers still stranded on roads, highways, stations, and state borders.” {বিচারালয় স্বীকার করছে যে সঙ্কট এখনও চলছে এবং একটা বড়ো অংশের অভিবাসী শ্রমিক এখনো রাস্তায়, বড়ো সড়কে, স্টেশনে এবং রাজ্যের সীমানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।}

সুপ্রিম কোর্টের এই বেঞ্চের যিনি প্রধান, অশোক ভূষণ, তিনি লিখিতভাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে নির্দেশ দেন —

“Adequate transport arrangement, food and shelters are immediately to be provided by the Centre and the State governments free of cost. …”
{অবিলম্বে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার, থাকার জায়গা, এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে বিনা পয়সায়}

এছাড়া সলিসিটর জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ২৮ মে তারিখের মধ্যে যেন কেন্দ্র সরকার কোর্টকে জানায়, তারা কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্ট লাঘবে।

২৮ মে-র শুনানিতে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সুপ্রিম কোর্টকে জানান, এটা একটা বেনজির ঘটনা। সেই মতো সরকারও নজিরবিহীন বৃহৎ ব্যবস্থা করেছে। ১ মে থেকে ২৮ মে অবদি মোট ৯৭ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিককে তাদের নিজ ভিটায় পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে। বাকি চার কোটি প্রবাসী শ্রমিকের কী হল? এ প্রশ্ন করা থেকে সুপ্রিম কোর্ট নিজেদের বিরত রাখলো।

সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয়, এক, যদি আটকে থাকা প্রবাসী শ্রমিকরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়, তাহলে রাষ্ট্র তাদের আটকাতে পারবে না। দুই, আর যদি কোনো প্রবাসী শ্রমিক নিজের রাজ্যে ফিরে যায়, তাহলে কোনো রাজ্য-সরকার বলতে পারবে না, যে, তাকে তার নিজের রাজ্যে ঢুকতে দেব না। তিন, সরকারকে ইচ্ছুক প্রবাসী শ্রমিকদের একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নিজ নিজ রাজ্যে পৌঁছে দেবার পরিকল্পনা করতে হবে। পরিবহণের সুব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত শ্রমিকের খাবার জল সহ সমস্ত প্রয়োজন সরকারকে মেটাতে হবে।

৯ জুন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সমস্ত শ্রমিকদের নিজ নিজ গৃহে পৌঁছে দিতে হবে। যারা সরকারি অব্যবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে শত শত মাইল হেঁটে বা সাইকেলে রওয়ানা দিয়েছিলেন, সরকার তাদের ওপর আইনের ধারা ৫১ তে মামলা দিয়েছে, সেই মামলা বা গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নিতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর পুলিশ যে পাশবিক অত্যাচার করেছে, তা বন্ধ করতে হবে। এই রায় তিনজন বিচারপতির বেঞ্চের, যেখানে ছিলেন বিচারপতি অশোক ভূষণ, বিচারপতি এস কে কল, এবং বিচারপতি এম আর শ।

আবার আমরা ফেক নিউজ-এ ফিরে যাই। যারা এই শ্রমিকদের খবর করল, তাদের ধরপাকড় চলছে এখন। সলিসিটর জেনারেল ২৬ মে সুপ্রিম কোর্টে মাদ্রাজ হাইকোর্ট যে ১৫ মে তে পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অনুযোগ করেছেন — “মাদ্রাজ হাইকোর্ট কেন সমান্তরাল সরকার চালাতে চাইছে?” সাংবাদিকদের অবস্থা মাদ্রাজ হাইকোর্টের ঊর্ধে নয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে ভারত সরকার। রাইট এন্ড রিস্ক অ্যানালিসিস গ্রুপ দিল্লির একটি সামাজিক সংঠন। সংগঠনটির ডিরেক্টর সুহাস-চাকমা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন এই নিয়ে। তাতে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন, সাংবাদিকদের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে ২০২০ অবদি সংবাদ পরিবেশনার জন্য শারীরিকভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অন্ততঃ ১০ জন সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছেন। গণ ধোলাই, পুলিশ দিয়ে পেটানো ইত্যাদি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্ততঃ ৫৫ জন সাংবাদিক।

দেখাই যাচ্ছে, মার্চ এপ্রিল মে জুন — প্রায় সাড়ে তিন মাসে কোটি কোটি শ্রমিক মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে নিজ ভিটায় ফিরেছে। সে সময় দেশের সব ধরনের অভিভাবকরা তাদের দুর্দশা শুধু বাড়িয়েছে। যারা তাদের দুঃখকষ্ট কমানোর জন্য খবর করেছে, তাদের আজ করুন পরিণতি হচ্ছে। সরকার, সরকারি পার্টি — আড়াই মাস ধরে পাঁচ কোটি শ্রমিকের মৃত্যু সমান যন্ত্রণাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার ষড়যন্ত্র করে গেছে। ইতিহাসে সব লেখা থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *