দিল্লি অবরোধ থেকে কৃষকদের “ভারত বনধ্‌” : কীভাবে নতুন কৃষি আইন পাঞ্জাব হরিয়ানা তথা দেশের সম্পন্ন কৃষক সম্প্রদায়ের ধ্বংস ডেকে আনছে?

সজল ঘোষ

কী কারণে পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষক সম্প্রদায় অবরোধ ও বনধ্‌ করে চলেছে ?

সেপ্টেম্বর মাসে মোদী সরকার তিনটে চাষ সংক্রান্ত বিল পাশ করায় সংসদে, প্রায় জোর জবরদস্তি করে। সেই তিনটি আইনে কৃষিপণ্যের ব্যবসা বাণিজ্য সরাসরি কর্পোরেটদের (আদানি, আম্বানি) হাতে তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। পঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষক সম্প্রদায় নিজেরাই কৃষিপণ্যের ব্যবসা ও বাণিজ্য চালায়। তাদের এই ফসল উৎপাদন এবং তার বিক্রি বাটা-র গোটা বন্দোবস্তটা ভেঙে চুরে তা কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিলে তাদের চাষবাসের মাধ্যমেই ঘটা সচ্ছ্বলতা ধ্বংস হবে — তাই এই তিনটি আইনের বিরোধিতায় আন্দোলন করছে পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিরা। গত দু-মাস ধরে পঞ্জাবে রেল অবরোধ করে রাখা সত্ত্বেও কেন্দ্রের মোদী সরকার তাদের দাবিতে কর্ণপাত করেনি। তাই তারা আজ প্রায় দু-সপ্তাহ হয়ে গেল দিল্লি অবরোধ করেছে সদলবলে। কিন্তু তবুও মোদী সরকার তাদের দাবি, “কৃষি আইনগুলি বাতিল করো” — তা মানতে চাইছে না। নানা টালবাহানা করছে কথা বলার নাম করে। সেই কারণে আন্দোলনরত কৃষকরা আজ ভারত বনধ ডেকেছে। এই বনধ সমর্থন করছে সংসদীয় বিরোধী-রা।

কী সেই তিনটি আইন, যেগুলির বিরোধিতা করছে চাষিরা ?

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনার লকডাউনের সুযোগ নিয়ে কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের মৃগয়াভূমিতে পরিণত করতে চেয়ে তিনটি অর্ডিন্যান্স আনে কেন্দ্রের বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন সরকার। সেই তিনটি বিলের নাম, অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংযোজনী ২০২০ বা The Essential Commodities (Amendment) Ordinance, 2020; দাম নিশ্চিন্তি ও কৃষি পরিষেবার চাষি (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তি অর্ডিন্যান্স ২০২০ বা  The Farmers (Empowerment And Protection) Agreement On Price Assurance And Farm Services Ordinance, 2020; এবং চাষির ফসলের ব্যবসা ও বাণিজ্য (অগ্রগতি ও সুবিধা) অর্ডিন্যান্স ২০২০ বা The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Ordinance, 2020। এই তিনটি অর্ডিন্যান্সই লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন শুরু হতেই আইন হিসেবে পেশ হয় ও পাশ হয় সেপ্টেম্বর মাসে। আমরা বলার সুবিধার্থে প্রথমটিকে ‘অত্যাবশ্যক পণ্য সংযোজনী আইন ২০২০’, দ্বিতীয়টিকে ‘চুক্তি-চাষ আইন ২০২০’ এবং তৃতীয়টিকে ‘ফসল বাণিজ্য আইন ২০২০’ বলে অভিহিত করব।

এই তিনটে আইনে পুঁজিপতি ও কোম্পানি (আদানি, আম্বানি ইত্যাদি) –রা কী কী সুবিধা পাবে? চাষির কী ক্ষতি হবে?

প্রথমতঃ ‘অত্যাবশ্যক পণ্য সংযোজনী আইন ২০২০’ -তে আলু, পেঁয়াজ, ডাল, তৈলবীজ সহ বেশিরভাগ কৃষিজ ফসলকে অত্যাবশ্যক পণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই সব পণ্য এখন থেকে ইচ্ছেমতো মজুত করা যাবে। এমনকি পচনশীল নয় এমন ফসলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ না হওয়া অবদি মজুত করলেও সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বলাই বাহুল্য, এই সুযোগটা সবচেয়ে ভালোভাবে নিতে পারবে সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী তথা কোম্পানি-রাই। ইচ্ছেমতো মজুত করে, তারপর দাম বেড়ে গেলে তখন বেশি দামে কৃষিজ পণ্যগুলো ছাড়বে। যেমন, এখন সর্ষের তেলের দাম খুব বেশি। পেঁয়াজ ও আলুর দাম খুব বেশি। ডিমেরও দাম অস্বাভাবিক। এবং এইসব জিনিসের দাম কমছেই না। কোনোবার এরকম হয় না। নিশ্চয়ই এই আইনের সুযোগ নিয়ে বড়ো ব্যবসায়ীরা মুনাফা করছে। এই রকম মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।

দ্বিতীয়তঃ ‘চুক্তি চাষ আইন ২০২০’ অনুযায়ী, চাষির ফসলের কী দাম দেবে, তার পাঁচ বছরের আগাম চুক্তি করতে পারে কোম্পানি। এই চুক্তিতে চাষিকে বোকা বানাবে কোম্পানি, এবং নিজে খুব লাভ করবে। যেমন, হয়ত এই বছর যা দাম ফসলের তার চেয়ে একটু বেশি দর দিয়ে সে চুক্তি করে নিল চাষির সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য। চাষিও দেখল, দাম একটু বেশি পাচ্ছি, করেই নিই চুক্তি। এবার মুদ্রাস্ফীতির নিয়মেই পাঁচ বছরে দাম বাড়বে ফসলের, কিন্তু চাষি যেহেতু চুক্তিবদ্ধ, সে কারণে সে সেই কম দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হবে কোম্পানির কাছে।

তৃতীয়তঃ ‘চুক্তি চাষ আইন ২০২০’ অনুযায়ী, কোনো কৃষি পরিষেবা সংস্থা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে চাষি ও কোম্পানির চুক্তির মধ্যে ঢুকতে পারে। এর মাধ্যমে কোম্পানি নিজদের পোষা ফড়ে বা দালাল-দের নিয়োগ করবে চাষির ফসলের লেবার সাপ্লাই থেকে শুরু করে ফসল বহন করা অব্দি। “কম্বো-অফার” বলে চালিয়ে আসলে দুই হাতে চাষির কাছ থেকে লাভ চুষে নিয়ে চাষিকে ছিবড়ে করবে কোম্পানি। আইন বলছে, আগে ফসল পাবে কোম্পানি, তারপর পেমেন্ট দেবে। ফলতঃ, যদি কোনো গণ্ডগোল হয়, এবং কোম্পানি যদি ফসল না নেয়, তাহলে চাষি চুক্তি থাকলেও দাম পাবে না। তাছাড়া কোনো দৈবদুর্বিপাকে যদি ফসল খারাপ হয় বা নষ্ট হয়, তাহলে গুণাগার দিতে হবে চাষিকে, কারণ ফসলের মান কেমন হতে হবে, তাও নির্দিষ্ট করা থাকবে চুক্তিতে। আর, যদি গণ্ডগোল আরো বেশি দূর গড়ায়, তাহলে গ্রামের পঞ্চায়েতের কিছু করার থাকবে না, এসডিও অফিসে দু-মাস মামলা মোকদ্দমা চলবে। বলাই বাহুল্য, চাষি এসডিও অফিসে গিয়েই পৌঁছতে পারবে না। যদি গিয়ে পৌঁছয়ও, তাহলেও কোম্পানির টাকার সঙ্গে পারবে না। কোম্পানিই সেই মামলা জিতবে টাকার জোরে উকিল লাগিয়ে। যদি মারপিট বাধে, তাহলে খুব বেশি হলে মার খাবে কোম্পানির কোনো এক কম মাইনের ঠিকে কর্মচারি হয়ত, বা সেরকম কারোর চাকরি যাবে। কোম্পানির কিচ্ছু হবে না। কারণ কোম্পানি চলে লিমিটেড লায়াবিলিটি আইনে, বড়োসরো কোনো অপরাধ করলেও কোম্পানির কোনো শাস্তি হয় না। কিন্তু চাষির জেল থেকে ফাঁসি সবই হতে পারে। কারণ সে মানুষ। এইভাবে চাষি-কোম্পানি চুক্তিতে সবসময় লাভবান হবে কোম্পানি। ক্ষতি হবে চাষির।

চতুর্থতঃ ‘ফসল বাণিজ্য আইন ২০২০’ অনুযায়ী, সরকারি মাণ্ডি এড়িয়ে কোম্পানি নিজেই ফসলের ট্রেডিং সেন্টার খুলতে পারে। এই রাজ্যের ফসল অন্য রাজ্যে বিক্রিও করা যেতে পারে। এর ফলে কোম্পানি টাকার জোরে সরকারি মাণ্ডি তুলে দেবে, যেমনভাবে মোবাইল সংযোগ প্রায় বিনে পয়সায় দিয়ে বিএসএনএল তুলে দিল জিও। এখন বিএসএনএল টিম টিম করছে, আর সেই সুযোগে দাম বাড়াচ্ছে জিও সহ অন্যরা। এইভাবেই একবার সরকারি মাণ্ডি তুলে দিতে পারলে তারপর খুব কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করবে নিরুপায় চাষিকে। ফলে সরকারের গালভরা ‘ন্যুনতম সহায়ক মূল্য’, যা এখনই খুব একটা কার্যকরী নয়, তা একেবারে উঠে যাবে।

নতুন আইনে চাষির কোনো লাভ নেই।

কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গে চাষিকে শোষণ করে ফড়ে, দালাল, ব্যবসায়ী, মাণ্ডির কর্মচারিরা। নতুন আইনে তাদের জায়গায় কোম্পানি এলে কি চাষির শোষণের মাত্রা একটু কমবে না?

না। বাড়বে। কারণ ফড়ে, দালাল, ব্যবসায়ী, হিমঘর মালিক, মিলমালিক-এর যা টাকার খাঁই, তার চেয়ে কোম্পানির টাকার খাঁই অনেক বেশি। কারণ, কোম্পানির ওপর দিকের ম্যানেজমেন্টের বেতন অনেক বেশি, মাসে লক্ষাধিক টাকা। তাছাড়া, কোম্পানিকে শেয়ারের দাম ধরে রাখতে গেলে আরো বেশি আরো বেশি মুনাফা করে চলতে হয়। সেই বিপুল পরিমাণ লাভ তো সে আর পণ্যের বাজার থেকে তুলতে পারবে না পুরোটা, কত আর জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে! তাকে সেই বিপুল মুনাফার বেশিরভাগটাই তুলতে হবে চাষিকে চুষে। যে শোষণের পরিমাণ ফড়ে, দালাল, ব্যবসায়ী, হিমঘর মালিক, মিল মালিকের চেয়ে অনেক বেশি হবে। তাছাড়া, ক্ষুদ্র চাষির পক্ষে সম্ভব নয় ফড়ে, দালাল, সার ব্যবসায়ীকে এড়ানো। বিপদে পড়লে তাকে হাত পাততে হয় এদের কাছেই। এরাই তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। ফলে ছোটো চাষির এদের দ্বারা শোষণ থাকবেই। তার সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হবে কোম্পানি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *