সৌভিক ঘোষ, ৩১ জানুয়ারি
সোশ্যাল মিডিয়া তার ভাল মন্দ নানা দিকের সাথে সমালোচনার এক অভূতপূর্ব পরিসর নিয়ে এসেছে। ক্ষমতাবান মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের যৌক্তিক-অযৌক্তিক সমালোচনা সমাজে চিরকালই হয়ে আসছে। আগে এই সমালোচনা বসার ঘরে, চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় বিনোদনের অংশ ছিল। তখন এইসব সমালোচনা চারপাশের পরিচিতির গণ্ডিতে সীমিত থাকত, সমালোচনা নিয়ে আলোচনা দু-তিন দিন চলে ঝিমিয়ে পড়ত। এখন সমালোচনার ময়দান ফেসবুক, টুইটারের মত সামাজিক মাধ্যম যেখানে গোটা দেশ, এমনকি গোটা পৃথিবী অংশ নিতে পারে।
ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে পড়ে যখন সমালোচনা হয় আদালত বা বিচার ব্যবস্থার। তখন ‘আদালত অবমাননা’ নামের একটা বিষয় এসে পড়ে, মামলা হয়। ২০২০ সালের ৩১-এ আগস্ট বিতর্কিত টুইটার পোস্টের জন্য আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ কে শীর্ষ আদালত প্রতীকী ১ টাকা জরিমানা করে (অনাদায়ে তিন মাসের জেল)। তার পর থেকে এটর্নি জেনারেলের কাছে অন্তত ১৮ টি আবেদন জমা পড়েছে আদালত অবমাননার মামলা করার অনুমতি চেয়ে [১]। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা প্রত্যেকেই একরকম অর্থে সেলেব্রিটি। সামাজিক মাধ্যমে এদের কথা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছয়। ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আদালত/বিচারবিভাগ-এর অবস্থান বাকিগুলোর চাইতে কিছু বিষয়ে একদমই আলাদা। একদিকে যেমন বিচারপতিরা শুধুমাত্র সংবিধান ও আইনের নিরিখেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এব্যাপারে তাদের কাউকে জবাবদিহি করার দায় নেই এবং সেই জন্যই সবরকম সাংবিধানিক সুরক্ষা তারা পেয়ে থাকেন, তেমনি আবার রায় দেওয়ার বাইরে শীর্ষ আদালতেরও বাস্তবে কোন ক্ষমতা নেই। রায় বলবত করার ব্যাপারে তাদের সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় আমলাতন্ত্র, পুলিশ বা সরকারের ওপর। এমনকি বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের জন্যও আদালতকে মূলত নির্ভর করতে হয় তদন্তকারী সংস্থার ওপর। বিপুল ক্ষমতাবান বিচারবিভাগ তাই অন্য ক্ষমতার কেন্দ্রগুলির ওপর ভীষণ রকম নির্ভরশীল।
আরেকটি স্তরে তেমনি বিচারব্যবস্থা নির্ভরশীল তার প্রতি জনসাধারণের আস্থার ওপর। আইনি ব্যবস্থায় যদি মানুষের আস্থাই না থাকে তবে তার ক্ষমতা কার্যত আর কিছুই থাকে না। ‘আদালত অবমাননা’ সংক্রান্ত আইনগুলি এই বিষয়টিকে মনে রেখেই তৈরি। আদালতকে নিজের মান্যতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। আদালতের রায় অগ্রাহ্য করে অবমাননা করার দায় সাধারণ নাগরিকের নেই কারণ তাকে রায় মানানোর দায়িত্ব আমলাতন্ত্র বা পুলিশ প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত। কিন্তু যে কেউ আদালতের রায়ের সমালোচনা করে ‘আদালত অবমাননা’ মামলার শিকার হতেই পারেন কেননা আগেই বলা হয়েছে বিচার ব্যবস্থার ওপর প্রশ্নাতীত আস্থাই তার ক্ষমতার উৎস, এমনকি অস্তিত্বের কারণ। ‘আদালত অবমাননা’ কোন ব্যক্তি বিচারপতির অবমাননার প্রশ্ন নয়, বিচার ব্যবস্থার অবমাননার প্রশ্ন।
যুক্তির একটা বৃত্ত তখন তৈরি হয় যখন একই সাথে একথাও মনে আসে যে গণতন্ত্র প্রশ্নাতীত ক্ষমতার অধিকারী প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ক্ষমতার মূল উৎসই সেখানে জনতা, নাগরিক। তাই বারবার ‘আদালত অবমাননা’ আর অভিব্যক্তির স্বাধীনতা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা অনড় অবস্থা তৈরি করে। তত্ত্বগত ভাবে এই দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলার জন্য বিচারব্যবস্থার প্রশ্নাতীত ক্ষমতা সীমিত আছে তথ্য, প্রমাণ, আইন, ইত্যাদির একটা সীমিত গণ্ডীর ভেতর। মানুষের চিন্তা, অনুভব, বিশ্বাস এমনকি সাধারণ ন্যায় নীতি বোধ থেকে বিচারপতি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। আইন নিজেই নিজের ক্ষমতার সীমানাও বেঁধে দেয়। আবার যেকোনো তত্ত্বের মতই বাস্তবে এই সীমানার দুই পাশে খানিকটা বিতর্কিত অঞ্চল তৈরি হয়, রায় নিয়ে প্রশ্ন, প্রশ্ন নিয়ে আদালত অবমাননার দ্বন্দ্ব ঘুরেফিরে আসে। সাম্প্রতিক কালে টুইট বিতর্কে জড়িয়ে হলফ-নামা দিয়েছেন ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান’ কুণাল কামড়া। আদতে আদালত অবমাননার মামলায় আবেদনকারীর তার বিবেচনায় আদালতের অবমাননা হয়েছে এমন ঘটনা আদালতের সামনে শুধু তুলে ধরার কথা। বাস্তবে আবেদনকারীরা অনেকেই আবেদনের কথা গণমাধ্যমে প্রচার করে বিষয়টিকে অন্য মাত্রা দিয়ে ফেলছেন। নানা মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ চলছে, পক্ষে বিপক্ষে আরও নানা মন্তব্য সামনে এসে ‘আদালত অবমাননার’ মূল তাৎপর্যটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কামড়ার টুইট ও তার হলফ-নামার অনুবাদ (মূল হলফ-নামা [২]) নীচে দেওয়া হল। (অনুবাদকের ব্যাখ্যার দায় এড়াতে টুইটগুলির অনুবাদ করা হল না।)
কুনাল কামড়ার বিতর্কিত টুইট:
1. The Supreme Court of this country is the most Supreme joke of this country
2 .The pace at which the Supreme Court operates in matters of “National Interests” it’s time we replace Mahatma Gandhi’s photo with Harish Salve’s photo…
3. DY Chandrachud is a flight attendant serving champagne to first class passengers after they’re fast tracked through, while commoners don’t know if they’ll ever be boarded or seated, let alone served.
4. All lawyers with a spine must stop the use of the prefix “Hon’ble” while referring to the Supreme Court or its judges. Honour has left the building long back..
কুনাল কামড়ার হলফ-নামার মূল অংশের অনুবাদ:
আমি, কুণাল কামড়া, পিতা শ্রী নরেশ ডি. কামড়া, বয়স ৩২, … মুম্বাই ৪০০০১৬ এর অধিবাসী ও বর্তমানে নতুন দিল্লীর বাসিন্দা, একনিষ্ঠ ও নিশ্চিত ভাবে হলফ করে জানাচ্ছি যে
১। ওপরে বর্ণিত ‘কন্টেম্পট পিটিশনের’ আমি উত্তরদাতা। মামলার সমস্ত ঘটনা ও পরিস্থিতির সাথে পরিচিত হওয়ার দরুন আমি এই হলফ-নামা পেশ করার যোগ্য।
২। ‘কন্টেম্পট পিটিশনের’ সব বক্তব্য বুঝে নিয়ে আমি নিচের তাৎক্ষণিক হলফ-নামা পেশ করছি।
৩। আমার কিছু টুইট যাদের রসিকতা বলে মনে হয় নি এমন কিছু ব্যক্তি আমার বিচার ও শাস্তির আবেদন করেছেন এই মর্মে যে আমি মহামান্য আদালতের অবমাননা করেছি।
৪। রসিকতার সমর্থনে কিছু বলার কোন কারণ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। রসিকতা যিনি করেন তিনি তার নিজের উপলব্ধি থেকে করেন যাতে তাঁর উপলব্ধির সাথে যাদের উপলব্ধি মেলে তারা হাসতে পারেন। কোন রসিকতা যাদের হাস্যকর মনে হয় না তাদের অধিকাংশই নির্বিকার থাকেন; তারা রসিকতাগুলোকে উপেক্ষা করে থাকেন যেমন জননেতারা তাদের সমালোচকদের উপেক্ষা করে থাকেন। একটা রসিকতার জীবনকাল এই পর্যন্তই। এই নজর কাড়ার অর্থনীতির সত্যি হল এই যে কোন সমালোচনা বা ব্যাঙ্গের প্রতি যত বেশি মনোযোগ দেওয়া হয় ততই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
৫। আমার কাজে আমি রসিকতার এই নীতি মেনে চলি যে তা যেন নিপীড়িত-কে স্বস্তি দেয় আর যার আরামে রয়েছেন তাদের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। উদাহারন স্বরূপ সেই রসিকতাটির কথা মনে করুন “প্রত্যেক সফল ভারতীয় ব্যবসায়ীর পেছনে আছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক”। রসিকতাটি পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে খানিকটা বরং ভোঁতাই করে আর ক্ষতিগ্রস্তকে খানিকটা স্বস্তি দেয়, সেইসব ক্ষতিগ্রস্তকে নাগরিক ও পরিবার যারা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারছেন না। উল্টোদিকে লাভবানরা নিজেদের দামী চেয়ারে বসে খানিকটা অস্বস্তিতে পরেন যদিও এরা জানেন যে একটা রসিকতা থেকে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না।
৬। আমার টুইটগুলো আমাদের গণতন্ত্রের শীর্ষ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে করা নয়। বরং এটাই হাস্যকর যে আবেদনকারীর দেশের মানুষের ওপর আস্থা এত খুব কম। আমার টুইট দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান আদালতের ভিত্তি নড়িয়ে দিতে পারে এমন দাবি আমার ক্ষমতার অতিরঞ্জন। শীর্ষ আদালত যেমন তার প্রতি মানুষের আস্থার সম্মান করে (আর অপরাধমূলক অবমাননার বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে রক্ষা করতে চায়), তেমনি মানুষের ওপর শীর্ষ আদালতের এটুকু আস্থা থাকা উচিৎ যে তারা টুইটারের কয়েকটা রসিকতার ওপর ভিত্তি করে শীর্ষ আদালতের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌছবে না। বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনতার আস্থা বিচারব্যবস্থার নিজের কাজের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে, কোন সমালোচনা বা আলোচনা থেকে নয়।
৭। গণতন্ত্রে কোন ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে ভাবা পরিযায়ীদের দেশ জোড়া, বাজে ভাবে পরিকল্পনা করে করা, লক-ডাউনের ভেতর নিজের দায়িত্বে বাড়ি ফিরে যেতে বলার সমার্থক: অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক। আমাদের সাংবিধানিক আদালতের বিচারপতিরা দেশের সবচাইতে ক্ষমতাবান মানুষদের অংশ। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও জীবনের ওপর এদের অসামান্য ক্ষমতা বিস্তৃত; এদের দপ্তর ও মেয়াদ সবরকম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য সাংবিধানিক প্রতিরক্ষা পেয়ে থাকে। আমার বিশ্বাস যে বিচারবিভাগও অন্য সাংবিধানিক দপ্তরগুলির মতই রসিকতা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে জানে। কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা বিচারপতিরা ব্যাঙ্গ-কৌতুকের শিকার হতে পারেন এই ভয়ে নিজের কাজ করতে পারবেন না, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
৮। অশ্রদ্ধা ও অতিশয়োক্তি রসিকতার অপরিহার্য উপকরণ। একজন, যিনি রসিকতা করছেন, তিনি তার নিজস্ব ও অনন্য ভঙ্গীতে আমজনতার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। আমি যে ভাষা ও শৈলী ব্যাবহার করি তা অবমাননার উদ্দেশ্যে নয় মানুষের মনোযোগ সেইসব সমস্যার দিকে আকর্ষণ করার জন্য যেগুলো আমি আমজনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সেই সব সমস্যা যেগুলো নিয়ে অনেক গুরুগম্ভীর আলোচনা আমজনতার সামনেই অনেক প্রাজ্ঞ মানুষ করেছেন।
৯। রসিকতায় শিল্পী তার রসিকতার ভিত্তি দীর্ঘ, পরিশীলিত প্রবন্ধকারে বা সংযত গদ্যে পরিবেশনার বিলাসিতা করতে পারে না। আইনের আঙিনায় সংক্ষিপ্ততা হয়ত খুব পরিচিত শব্দ নয় কিন্তু তা রসিকতার প্রাণস্বরূপ (আর টুইটার-এরও যেখানে ২৮০ অক্ষরের সীমাবদ্ধতা আছে)। আবেদনকারীদের থেকে রসিকতা সংক্রান্ত পরামর্শ আমি খুশি মনে নিতে পারি তবে প্রাথমিক ভাবে তাদের রসিকতার মানসিকতাটুকু থাকতে হবে।
১০। আমি মনে করি দেশে একটা অ-সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ক্রমশ বেড়ে চলেছে, যেখানে কোন কথাকে অপমান সূচক ভাবে নেবার প্রবণতাকে একরকম মৌলিক অধিকারের মত করে দেখা হয় আর ব্যাপারটাকে প্রায় জনপ্রিয় ‘ইনডোর স্পোর্টসের’ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। আমরা অভিব্যক্তির স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেখছি যেখানে মনোয়ার ফারুকির মত কমেডিয়ানকে সেই রসিকতার জন্য জেলে যেতে হয় যা তিনি করেনিই নি, বা যেখানে স্কুল-পড়ুয়াদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে জেরা করা হয়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি আশা করি এই আদালত বাক-স্বাধীনতা আর অভিব্যক্তির স্বাধীনতাকে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে তুলে ধরবে আর এই ধারণাকে মান্যতা দেবে যে অপমানিত বোধ করার সম্ভাবনাও এই স্বাধীনতার সাথেই অনিবার্য ভাবে জড়িয়ে থাকে। ক্ষমতাবান মানুষ ও প্রতিষ্ঠান যদি এইভাবে তিরস্কার বা সমালোচনার প্রতি অ-সহিষ্ণু হয়ে পড়েন তাহলে দেশের শিল্পী-সমাজকে জেলে পচতে হবে আর স্তাবকের দল ফুলে ফেঁপে উঠবে। আদালত যদি মনে করে আমি আমার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছি আর অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় তবে প্রতি ১৫-ই আগস্ট আমি আমার কাশ্মীরি বন্ধুদের মতই ‘শুভ স্বাধীনতা দিবসে’ পোস্টকার্ড পাঠাব।
১১। পরিশেষে বলি যে অনেক আদালতের, অনেক বিষয়ে, অনেক সিদ্ধান্তের সাথে আমি সহমত নাই হতে পারি কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি যে এই বেঞ্চ আমায় যে সিদ্ধান্ত জানাবে আমি তাই হাসিমুখে মেনে নেব। আমি এই বেঞ্চ ও শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্তের কোনরকম নিন্দা করবো না কারণ তাহলে সত্যিই আদালতের অবমাননা করা হবে।
তথ্যসুত্র:
[১] https://www.barandbench.com/columns/litigation-columns/contempt-of-court-supreme-court-prashant-bhushan-attorney-general-consent
[২] https://www.livelaw.in/pdf_upload/kunalkamraaffidavitsupremecourtcontempt-388301.pdf