করোনা ও টিকা : টিকাভাঙা সংক্রমণ অতিমারিকে দীর্ঘায়িত করছে কি? — এই প্রশ্নটির আলোচনা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছে গবেষণাপত্রগুলি

অনির্বাণ সাহা

এখন করোনার যে সমস্ত টিকা সারা বিশ্ব জুড়ে চলছে, সেগুলি সবই প্রায় দুটি ডোজ-এর, যাদের মধ্যের ব্যবধান মাস খানেকের মতো। এই টিকা তৈরি হতে চার পাঁচ বছর লাগার কথা, কিন্তু এক বছরের মধ্যে টিকাগুলি তৈরি করে ফেলা হয়েছে, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় বলে ধন্য ধন্য হয়েছে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলেছে, এগুলি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে এখনও এবং এই টিকা ব্যবহারে বিপদ হতে পারে। সে সমস্ত বিপদের সম্ভবনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রীয় এবং অতিরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি এই আধাখ্যাঁচড়া টিকাগুলিকে জরুরি প্রয়োগের ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। গত বছরের শেষের দিক থেকেই টিকা দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ইজরায়েল এবং ব্রিটেন এই কাজে সবচেয়ে এগিয়ে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও পিছিয়ে নেই।

এসবের মধ্যেই মাস তিনেক আগে থেকে একটি কথা ঘন ঘন উচ্চারিত হতে শুরু করেছে — টিকাভাঙা সংক্রমণ বা ভ্যাক্সিন ব্রেকথ্রু ইনফেকশন। দুটি ডোজ নেবার দু-সপ্তাহ পর থেকে যদি গ্রহীতার সংক্রমণ হয় তাকে বলে টিকাভাঙা সংক্রমণ। সংজ্ঞা এটা, কিন্তু টিকাভাঙা সংক্রমণের যে কায়দা, তাতে টিকা নেবার পরে সংক্রমিত হলে সেটাকেই টিকাভাঙা সংক্রমণ বলা যেতে পারে। আমরা প্রথম ডোজ নেবার পর সংক্রমণ হলে সেটাকে আংশিক টিকাভাঙা সংক্রমণ এবং দ্বিতীয় ডোজ নেবার পর সংক্রমণ হলে সেটাকে টিকাভাঙা সংক্রমণ বলব।

যাই হোক, টিকা নেওয়া সত্ত্বেও অনেকেই সংক্রমিত হচ্ছে। প্রথমে বলা হচ্ছিল, টিকার কার্যকরীতা শুরু হবে দ্বিতীয় ডোজ নেবার দু-সপ্তাহ পর থেকে। ফলে তার আগে টিকাগ্রহীতা সংক্রমিত হলে তাকে টিকার ব্যর্থতা বা টিকাভাঙা সংক্রমণ বলা যাবে না। দেখা গেল, না, টিকাভাঙা সংক্রমণ বাস্তব। তখন প্রতিষ্ঠানগুলির তরফে বেশ কয়েকটি অজুহাত দেওয়া হল। ১) টিকাগুলির পরীক্ষাগার-কার্যকরীতা (এফিকেসি) এবং বাস্তব-কার্যকরীতা (এফিসিয়েন্সি) — দুটিই একশ’ শতাংশ নয়, তার কম। ফলে টিকাভাঙা সংক্রমণ হতেই পারে। টিকা যে একশ’ শতাংশ কার্যকরী হবে, এটা প্রত্যাশার বাহুল্য। ইউটোপিয়া। ২) টিকাগুলি ভাইরাসের আদি রূপটির বিরুদ্ধে কার্যকর কি না, তারই পরীক্ষা হয়েছে শুধু। কিন্তু এখন এই আরএনএ ভাইরাসটি বদলাচ্ছে এবং তার নতুনতর রূপভেদ তৈরি করছে। ৩) টিকাগুলি সংক্রমণ কমাবে এবং সংক্রমিত হলেও অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সম্ভবনা কমাবে। ৪) টিকাগুলি অতিমারিকে সংক্ষেপিত করবে সামগ্রিকভাবে সংক্রমণে লাগাম টেনে; এবং সংক্রমণে লাগাম দেওয়া হলে তার মাধ্যমে বেশি ছোঁয়াচে ও বেশি শক্তিশালী রূপভেদ তৈরি আটকাবে । ৫) টিকা থেকে পাওয়া প্রত্যক্ষ অনাক্রম্যতা বা অ্যান্টিবডি প্রতিরোধ ভাঙলেও টিকা থেকে পাওয়া অপ্রত্যক্ষ অনাক্রম্যতা (স্মৃতি কোষ জনিত) রক্ষাকবচের কাজ করবে।

বলাই বাহুল্য, এগুলি সবই মূলতঃ অনুমান ভিত্তিক এবং কিছু প্রাথমিক প্রমাণ ভিত্তিক। যেমন, টিকাগুলি সংক্রমণ কমাবে এবং সংক্রমিত হলেও অসুস্থতা ও মৃত্যুর সম্ভবনা কমাবে — এগুলি যে জনস্বাস্থ্য সমীক্ষা ভিত্তিক গবেষণার ওপর দাঁড়িয়ে বলা হল — তা অনেকটাই টিকাগুলির তাড়াহুড়োতে করা তৃতীয় দফার মহড়া-র মতো। কতদিন পর্যন্ত এই ‘কমাবে’, তা উহ্য রইল, কারণ বেশিরভাগ জনস্বাস্থ্য সমীক্ষাই করা হল দ্বিতীয় টিকা নেবার পর খুব বেশি হলে একমাস পর্যন্ত সময়সীমা পর্যবেক্ষণ করে। বেশিরভাগ গবেষণাই প্রচুর অনুমানের আশ্রয় নিল। যেমন, টিকা নেবার পর সংক্রমিত হচ্ছে কি না তা সক্রিয়ভাবে ফলো-আপ করা হল না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুলনা টানার জন্য কোনো সমবৈশিষ্ট্যের বা কোহর্ট পর্যবেক্ষণ হল না যারা টিকা নেয়নি তাদের সঙ্গে ইত্যাদি। ধরে নেওয়া হল — ছোঁয়াচে ও শক্তিশালী রূপভেদ তৈরি হবে কেবলমাত্র সংক্রমণ চলতে থাকলে — এই সরলরৈখিক সম্পর্ক; ফলে প্রাথমিকভাবে সংক্রমণ কমানোই লক্ষ্য — তা হলেই রূপভেদ তৈরি আটকাবে। আর পাবলিককে বলা হল, টিকা নিলে সংক্রমণের সম্ভবনা কমবে, সংক্রমিত হলেও গুরুতর অসুস্থ হবার সম্ভবনা বা মৃত্যুর সম্ভবনা কমবে। ফলে মিডিয়ার মাধ্যমে জনপরিসরে টিকা এল নিজেকে বা নিজেদের বাঁচানোর একটা উপায় হিসেবে, ব্যক্তিগত করোনা-প্রতিষেধক হিসেবে। মানুষ এই ব্যক্তিগত করোনা-প্রতিষেধক হিসেবে প্রচুর হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক বড়ি খাচ্ছিল, ভিটামিন বা মিনারেল ট্যাবলেট খাচ্ছিল। টিকা এল সেরকমই একটা কিন্তু অনেক বেশি কার্যকরী একটা ইঞ্জেকশন হিসেবে। কে না জানে, ওষুধে-এ কাজ না দিলে ইঞ্জেকশন নিতে হয়!

করোনা (২০১৯) ভাইরাসের রূপভেদ

এখানে, ভাইরাসের রূপভেদ কীভাবে তৈরি হয় সে নিয়ে প্রাথমিক একটা জানাবোঝা থাকা প্রয়োজন। করোনা বা এই ধরনের রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড ভিত্তিক ভাইরাসগুলি বেশ দ্রুত নিজেদের প্রচুর প্রতিলিপি তৈরি করে তার প্রতিপালক বা হোস্টের কোষের মধ্যে। আবার ওই কোষগুলির মধ্যে ঢোকার সময় থেকেই প্রতিপালকের শরীর নানা রকম ভাইরাস-বিরোধী নিঃসরণ শুরু করে। সেগুলিকে ভাইরাস প্রতিহত করতে থাকে এবং একইসাথে নিজের প্রতিলিপিও গঠন করতে থাকে। ভাইরাস এইভাবে তার দেহের জিনসারণী-র প্রতিলিপি গঠনের সময় কিছু না কিছু ভুল করতে থাকে। জিন তৈরি হয় প্রোটিন দিয়ে। ২০১৯ সালের কোভিড ভাইরাসটির (আদি উহান ভাইরাস) এই জিন-সারণীটিকে, যা প্রায় তিরিশ হাজারের মতো রাসায়নিক একক (নিউক্লিওটাইড) দিয়ে তৈরি, তাকে কাঠামোগত এবং কার্যগতভাবে কিছু মোটাদাগের ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, ওপেন রিডিং ফ্রেম, স্পাইক (এস), এনভেলোপ (ই), মেমব্রেন (এম), নিউক্লিওক্যাপসিড (এন)। এগুলিকে আলাদা আলাদা প্রোটিন বলা যেতে পারে। স্পাইক আবার কাঠামোগতভাবে দুই ভাগ যাদের মধ্যে একটি জোড় (ক্লিভেজ) -এর জায়গা থাকে। এগুলি নিয়ে আবার পরে আরেকটু আলোচনা করা যাবে, যদিও এখানে খুবই ওপর ওপর আলোচনা করা হচ্ছে। আদতে এগুলি খুবই জটিল প্রক্রিয়া, এমনকি বর্ণনা হিসেবেই।

এই গোটা কাঠামোটিকে প্রতিলিপি করতে গিয়েই ভুলভাল করে পরিব্যক্তি বা মিউটেশন বয়ে আনে ভাইরাস। অবশ্য এই কোভিড-২ ভাইরাসটি প্রতিলিপি করার পর একবার চেক করে যে ঠিকঠাক হল কি না, অনেকটা প্রুফ রিডিং-এর মতো, সেই জন্য এর পরিব্যক্তি-র হার সাধারণ ফ্লু ভাইরাস, যে কি না চেক করে না এইভাবে, তার চেয়ে একটু কম। এই হিসেবগুলো অবশ্য অতিমারির শুরুতেই পাওয়া সম্ভব ছিল না, কিছুদিন যাওয়ার পর যখন সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আনবিক পরিবর্তনগুলি চেহারা নিয়ে হাজির হতে শুরু করল, পরিভাষায় ফাইলোডায়নামিক থ্রেশহোল্ড পেরোলো গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, তখনই সম্ভব হল এইসব হিসেব পাওয়া (Duchene et al 2020)। প্রথম যে পরিব্যক্তি-টির সন্ধান পাওয়া গেল, সেটা D614G। এই যে D614G — এখানে ডি এবং জি হল অ্যামিনো অ্যাসিডের সংক্ষিপ্ত নাম, যথাক্রমে অ্যাস্পারটিক অ্যাসিড ও গ্লাইসিন। আর 614 হল জিনসারণীর প্রোটিনের কাঠামোগত একক অ্যামিনো অ্যাসিডের স্থানাঙ্ক। অর্থাৎ কোভিড-২ ভাইরাসের প্রথম পরিব্যক্তি যেটা পাওয়া গেল জিনসারণীর স্পাইক বা গজাল অংশের প্রোটিনকাঠামোর একক স্থানাঙ্ক ৬১৪ -তে অ্যাস্পারটিক অ্যাসিডের বদলে গ্লাইসিন আসা। শুধু যে একটি অ্যাসিডের পরিবর্তে আরেকটি আসে (সাবস্টিটিউশন বা প্রতিস্থাপন) তা নয়, অনেক সময় স্থানাঙ্কটি মুছেও (ডিলিশন বা অপনয়ন) যায় পরিব্যক্তিতে। যাই হোক, এই ৬১৪ স্থানাঙ্কে প্রতিস্থাপনটি দেখতে পাওয়া গেল যখন, সেটা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দেখা গেল, তাই বলা হচ্ছে পাওয়া গেল। জীববিজ্ঞানের গবেষণায় বা জীববিজ্ঞানে এই আলাদাভাবে দেখা পাওয়া এবং তার গঠনগত বর্ণনা, এই দুটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যাই হোক, এটি ভাইরাসটিকে প্রতিপালকের শরীরের কোষের ওপর আরও ভালোভাবে গেঁড়ে বসতে সহায়তা করল। দেখা গেল, এই পরিব্যক্তি থাকা ভাইরাসের শ্বাসনালীতে প্রতিলিপি তৈরি করার হারও বেশি (আরটিপিসিআর টেস্ট-এ সিটি ভ্যালু কম দিয়ে বোঝা গেল)। উহানের বন্য ভাইরাসটির এতাবৎ সারা দুনিয়ায় যত ভ্যারিয়েন্ট বা রূপভেদ পাওয়া গেছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই এই প্রাথমিক পরিব্যক্তিটি মিলেছে। অর্থাৎ, বোঝা গেল, ভাইরাসের যে সমস্ত রূপভেদে এই গেঁড়ে বসার পরিব্যক্তিটি নেই, সেগুলি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্ততঃ মানুষের শরীরে সংক্রমণের থেকে। এই পরিব্যক্তিগুলির নানা সমাহার নিয়ে তৈরি হল আদি ভাইরাসটির নানা সন্তানসন্ততি। সেই সন্তানসন্ততিদের মধ্যে সামান্য কিছু বাঁচল এবং প্রতিপালক জগতে (মনুষ্যসমাজে) ছড়িয়ে পড়তে পারল ভালোভাবে। সাধারণভাবে ভাইরাসের সন্তানসন্ততীদেরই ভ্যারিয়েন্ট বা রূপভেদ বলা হয়। ২০২১ এর এপ্রিল মাস অবদি সার্স-কোভ-২ বা কোভিড-২ বা কোভিড-১৯ বা আদি উহান ভাইরাসটির জিনসারণীর শুধু গজাল বা স্পাইক প্রোটিন অংশের ১২৭৩ টি অ্যামিনো অ্যাসিড স্থানাঙ্কে পরিব্যক্তি ও ভাইরাসটির সওয়া চার লক্ষ সন্তানসন্ততিদের জিনসারণী ডেটাবেস-এ সেই স্থানাঙ্কগুলির পরিব্যক্তিগুলির পরিমাণ একটি চার্ট-এ দেওয়া হল (ছবি – ১)। চার্ট-টি Harvey et al 2021; https://doi.org/10.1038/s41579-021-00573-0 থেকে নেওয়া যা ১ জুন প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, ১২৭৩ টির মধ্যে ১২৬৭ টি স্থানাঙ্কে মোট ৫১০৬ টি প্রতিস্থাপন পরিব্যক্তি। এছাড়াও আছে অপনয়ন পরিব্যক্তি।

ছবি -১ : Harvey et al 2021; https://doi.org/10.1038/s41579-021-00573-0 থেকে নেওয়া যা ১ জুন প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, মূল সার্স-কোভ-২ (২০১৯ এ চিনের উহান-এ পাওয়া) ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিডের ১২৭৩ টি স্থানাঙ্কেরর মধ্যে ১২৬৭ টি স্থানাঙ্কে মোট ৫১০৬ টি প্রতিস্থাপন পরিব্যক্তি। এছাড়াও আছে অপনয়ন পরিব্যক্তি।

ভাইরাসের জিনের কোন পরিব্যক্তিটি নির্বাচিত হবে, তা ঠিক হয় নানা স্তরে। প্রাথমিক স্তর হল হোস্ট বা প্রতিপালকের কোষ এবং দেহ। যেহেতু কোষে ঢোকার সময় থেকেই ভাইরাসবিরোধী কার্যকলাপ শুরু হয়ে যায় প্রতিপালকের শরীরে এবং কোষে, তাই সেই ভাইরাসবিরোধী কার্যকলাপের হাত থেকে বেঁচে যায় যে ভাইরাস-প্রতিলিপিগুলি সেগুলি প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়। তাই কোন পরিব্যক্তিটি টিঁকে যাবে তা নির্বাচনে প্রতিপালকের শরীরের প্রতিরোধী কার্যকলাপের ভূমিকা রয়েছে। পরিব্যক্তি নির্বাচনের প্রাথমিক স্তর যদি হয় প্রতিপালকের কোষ এবং দেহ, তাহলে দ্বিতীয় স্তর হল এক প্রতিপালক দেহের থেকে আরেক প্রতিপালকের দেহের মধ্যে ছড়ানোর প্রক্রিয়া। তা যে সমস্ত পরিব্যক্তিগুলি ভাইরাসটিকে প্রতিপালকের কোষের ওপর গেঁড়ে বসতে সাহায্য করে, প্রতিপালকের দেহের প্রতিক্রিয়া হজম করে নিতে সাহায্য করে, প্রতিপালক কোষে বেশি প্রতিলিপি গঠনে সাহায্য করে, সেগুলির টিঁকে থাকার সম্ভবনা বেশি এই প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে। এছাড়াও আছে পরিব্যক্তি নির্বাচনে নানা বাইরের হস্তক্ষেপ, যেমন, পরিবেশ ইত্যাদি বা আমাদের মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউনের মাধ্যমে প্রতিপালক থেকে প্রতিপালকে ছড়ানোয় হস্তক্ষেপ প্রভৃতি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুরে একগুচ্ছ অপনয়ন পরিব্যক্তি দেখা যায় বেশ কিছু সার্স-কোভ-২ ভাইরাস-জিনসারণীতে, ওপেন রিডিং ফ্রেম অংশে; এই পরিব্যক্তির ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ মৃদুতর হচ্ছে বলে দেখা যায়; কিন্তু সিঙ্গাপুরে কড়া লকডাউনে এই পরিব্যক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

যাই হোক, প্রতিপালকের শরীরের মধ্যে ভাইরাসবিরোধী কার্যকলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই নির্বাচনে, এবং তা শুধু কোষের মধ্যের সহজাত প্রতিক্রিয়া নয়, আমাদের শরীরের আগাম প্রতিরোধ ক্ষমতা বা সংক্রমণ পূর্ববর্তী অনাক্রম্যতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পরিব্যক্তি নির্বাচনে। তাই প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অনাক্রম্যতার রকমফের যেমন শরীরের সাধারণ কাঠামোর ওপর বা সুস্থতার ওপর নির্ভর করে, তেমনি নির্ভর করে একই ধরনের ভাইরাসের (এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের পুরনো সংস্করণগুলি যা বহুদিন ধরে রয়েছে আমাদের মনুষ্যজগতে) দ্বারা সংক্রমিত হবার বহু পুরনো অভিজ্ঞতাজনিত স্মৃতির ওপর। আবার তা নির্ভর করে এই নয়া করোনা ভাইরাসেরই পুরনো সংক্রমণের অভিজ্ঞতাজনিত স্মৃতি এবং থেকে যাওয়া প্রত্যক্ষ অনাক্রম্যতা বা অ্যান্টিবডির ওপর। টিকার মাধ্যমে ওই পুরনো সংক্রমণের অভিজ্ঞতার একটি নকল তৈরি করা হয় শরীরে। টিকা বানানো হয় ভাইরাসের শরীরের এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দিয়ে। প্রতিপালকের শরীরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে (বা মুখ দিয়ে) ভাইরাসের সেই শরীরাংশের একটি প্যাকেজ ঢুকিয়ে প্রতিপালকের শরীরে একটি নকল অভিজ্ঞতা তৈরি করা হয়। তাতে প্রতিপালকের শরীরে ভাইরাসের সেই শরীরাংশের প্রত্যক্ষ অনাক্রম্যতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, এবং স্মৃতি কোষও তৈরি হতে পারে। তবে সবরকমের ভাইরাসের সংক্রমণের অভিজ্ঞতাজনিত স্মৃতির প্রতিক্রিয়া একইরকম হয় না। যেমন, হাম অসুখটির ক্ষেত্রে ভাইরাসটির একবার আমাদের দেহে সংক্রমণ হলে সাধারণতঃ সারাজীবন আর সংক্রমণ হয় না, এমনই অনাক্রম্যতা তৈরি হয়ে যায় শরীরে। ফলে এর টিকা তৈরিও সহজ। আবার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার সংক্রমণ বেশি অভিঘাত তৈরি করে শরীরে, অর্থাৎ সেক্ষেত্রে প্রথম সংক্রমণের অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি সংক্রমণের ভয়াবহতা বাড়ায়। তাই এর টিকা তৈরি করা যায় না। আবার এইডস রোগের ক্ষেত্রে একজন প্রতিপালকের শরীরের মধ্যেই ভাইরাসটির এমন বেশি হারে অনাক্রম্যতা-এড়ানো পরিব্যক্তি হতে থাকে যে কিছুতেই তাকে সেই শরীরের মধ্যে থেকে কাবু করা বা বের করা যায় না। তাই এইডসের টিকাও হয়নি।

আমরা ভাইরাসের রূপভেদের মধ্যে পরিব্যক্তি বা ভাইরাসের শরীরাংশের অদলবদলের আলোচনা থেকে চলে এলাম প্রতিপালকের শরীরে ভাইরাসের অভিঘাতের অদলবদল-এর আলোচনায়। ভাইরাসের রূপভেদ-এর এই দুটি আলাদা দিক-এ ভাইরাস গবেষণা আলোকপাত করে — প্রথমটিকে বলে জেনোটাইপ, পরেরটিকে বলে ফেনোটাইপ। ফেনোটাইপের মধ্যে পড়বে রূপভেদটি কতটা ছোঁয়াচে (ট্রান্সমিশন), কতটা শক্তিশালী (ভিরুলেন্স), আরটিপিসিআর টেস্ট এড়িয়ে যেতে পারে কি না, প্রতিপালককে কতটা কাবু করে ইত্যাদি। রূপভেদের জেনোটাইপ ল্যাবরেটরিতে জিনোমিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষেণের মাধ্যমে অনেকটাই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব। কিন্তু ফেনোটাইপ বলতে গেলে জনস্বাস্থ্য সমীক্ষা এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে সংখ্যাতত্ত্বভিত্তিক আন্দাজ-এর বেশি নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।

ভাইরাসের এই জাতিগতিতত্ত্ব বা ফাইলোডায়নামিক্স নিয়ে চমৎকার প্রাথমিক আলোচনা পাওয়া যাবে Grenfell et al 2004 এ। ঘোড়ার ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ওপর করা গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফল বিশ্লেষণ করে একজন প্রতিপালকের শরীরের মধ্যে ভাইরাসের জাতিগতিতত্ত্বের একটি কাঠামোও দেওয়া আছে ওই প্রবন্ধে — ক) প্রতিপালকের শরীরে আংশিক অনাক্রম্যতা থাকাকালীন সংক্রমিত হলে শরীরের মধ্যে ভাইরাসটির সবচেয়ে বেশি বিবর্তন হয় এবং তা খুব দ্রুতও হয়। খ) একদম নতুন সংক্রমণে শরীরের মধ্যে যেহেতু ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রথমদিকে কোনো আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থাই থাকে না (কোষের মধ্যেকার সহজাত প্রতিক্রিয়া ছাড়া), তাই তখন প্রতিপালকের শরীরের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিলিপি প্রচুর সংখ্যায় হলেও অনাক্রম্যতার চাপ কম থাকায় বিবর্তন কম হয়। যখন অর্জিত অনাক্রম্যতা বাড়তে শুরু করে ততদিনে শরীরে ভাইরাসের সংখ্যা যায় কমে, ফলে তুলনায় অনেক কম বিবর্তন হয় ভাইরাসটির। গ) অপরদিকে, প্রতিপালক ভালোমতো অনাক্রম্যতা অর্জন করে ফেললে তার অর্জিত অনাক্রম্যতা (পরিভাষায় অ্যাডাপটিভ ইমিউনিটি : অ্যান্টিবডি, বি এবং টি স্মৃতি কোষ গঠন) এবং সহজাত (পরিভাষায় ইনেট ইমিউনিটি) প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে সংক্রমণ খুব কম হয় ও শরীরে ভাইরাসের প্রতিলিপি গঠনও খুব কম হয়; ফলে এক্ষেত্রে প্রতিপালকটির শরীরের মধ্যে ভাইরাসটির বিবর্তন খুব কম হয় এবং যতটুকু হয় তা দেরিতে হয়। অর্থাৎ, প্রতিপালকের আংশিক অনাক্রম্যতা থাকাকালীন সংক্রমণ প্রতিপালকের শরীরের মধ্যে ভাইরাসের বিবর্তনের পক্ষে সবচেয়ে সহায়ক।

উদ্বেগজনক রূপভেদ

যাই হোক, জানুয়ারি মাস থেকেই জনস্বাস্থ্য ও জিনোমিক গবেষণাপত্রগুলিতে দেখা যেতে শুরু করল, বেশি ছোঁয়াচে এবং বেশি শক্তিশালী রূপভেদগুলি সারা পৃথিবীজুড়ে বেড়ে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটেনে প্রথম পাওয়া ‘আলফা’ রূপভেদ দেখা গেল বেশি শক্তিশালী এবং বেশি ছোঁয়াচে — আদি উহান ভাইরাসের তুলনায়, এবং এই রূপভেদটি ব্রিটেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েলে আসা প্রাথমিক রূপভেদগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিতে গিয়েছে। এখানে আবার এক বার বলে নেওয়া যাক, আদি উহান ভাইরাসটি ছিল বন্য, মানুষের মধ্যে ছড়ানো শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যেই সে কিছু প্রাথমিক পরিব্যক্তি তৈরি করেছিল, যাতে সে মানুষের শ্বাস-অঙ্গের কোষগুলির ওপর গেঁড়ে বসতে পারে, বেশি প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে শ্বাস-অঙ্গে ঢুকে পড়ার পর। দেখা গেল, এই আলফা রূপভেদ, বা ব্রাজিলে প্রথম পাওয়া গামা রূপভেদ বা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম পাওয়া বিটা রূপভেদ — এগুলি সবই ঐ প্রাথমিক পরিব্যক্তি যুক্ত রূপভেদগুলির চাইতে বেশি ছোঁয়াচে এবং বেশি শক্তিশালী। এদের মধ্যে আলফা ও গামা রূপভেদ দুটি প্রাথমিক রূপভেদগুলিকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিয়ে যথাক্রমে ব্রিটেন-ইজরায়েল-ইউএসএ ও লাতিন আমেরিকায় মূল রূপভেদের মর্যাদা অর্জন করল। কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী বিটা রূপভেদ দক্ষিণ আফ্রিকায় জাঁকিয়ে বসলেও এইসব দেশগুলিতে আলফা ও গামার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠল না, হয়ত ওগুলোর তুলনায় একটু কম ছোঁয়াচে বলে। ভারতে প্রথম পাওয়া ডেল্টা রূপভেদ এপ্রিল-মে মাসে ভারতে এবং মে-জুন মাসে সারা পৃথিবী জুড়ে অন্য সমস্ত রূপভেদগুলিকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিতে লাগল। উল্লেখ্য, এই ডেল্টা রূপভেদও বেশি ছোঁয়াচে এবং বেশি শক্তিশালী।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই জিনোমিক গবেষণাপত্রগুলিতে দেখা যেতে লাগল, এই বেশি ছোঁয়াচে ও বেশি শক্তিশালী রূপভেদগুলি (পরিভাষায় ভ্যারিয়েন্টস অফ কনসার্ন বা উদ্বেগজনক রূপভেদ) প্রাকৃতিক সংক্রমণ থেকে পাওয়া অনাক্রম্যতা বা টিকা থেকে পাওয়া অনাক্রম্যতা — দুটিকেই ভেঙে ফেলছে। এই ফলাফলের ধারা অব্যাহত রয়েছে এখনও পর্যন্ত। প্রসঙ্গতঃ, আরো দেখা গেল যে “অ্যান্টিবডি ককটেল” নামক যে চিকিৎসা পদ্ধতি বা থেরাপি করোনা রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার হতে শুরু হয়েছিল, তাকেও ভেঙে ফেলছে। মোটামুটি প্রায় সমস্ত গবেষণাতেই দেখা যেতে লাগল, বিটা রূপভেদ সবচেয়ে বেশি ভাঙছে অনাক্রম্যতাকে। আলফা ও গামা রূপভেদ মোটামুটি সমানভাবেই ভাঙছে। ডেল্টা রূপভেদ বিটা রূপভেদের চেয়ে কম ভাঙছে, কিন্তু আলফা ও গামা রূপভেদের চেয়ে বেশি ভাঙছে। এছাড়াও দেখা গেল, জিনোমিক ও জনস্বাস্থ্য সমীক্ষা গবেষণা — দুটোতেই, প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজ-এর মাঝে এই ভাঙার মাত্রা বেশি, দ্বিতীয় ডোজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরে ভাঙার মাত্রার চেয়ে। সাধারণ জনমানসেও কৌতুহল তৈরি হল এই টিকা-এড়ানো রূপভেদ নিয়ে (সঙ্গের ভ্যাক্সিন-এস্কেপ শব্দবন্ধের গুগল সার্চ ট্রেন্ড এর রেখাচিত্র রইল — ছবি -২ )।

ছবি – ২ : ভ্যাক্সিন-এস্কেপ শব্দবন্ধের গুগল সার্চ ট্রেন্ড এর গত এক বছরের রেখাচিত্র

২০২০ র ডিসেম্বর মাস থেকে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং ইজরায়েলে টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হয়। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য এবং ইজরায়েলের টিকাকরণ কর্মসূচী সবচেয়ে দ্রুত এবং সফল বলে ঘোষিত হয়। ভারতে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। আজ ছ-সাত মাস পর, আমরা এই টিকাভাঙা সংক্রমণের জিনোমিক ও জনস্বাস্থ্য গবেষণার ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়ে, টিকাকরণ বিষয়টাকেই প্রশ্ন করা উচিত বলে মনে করছি। কারণ, সবচেয়ে সফল যুক্তরাজ্য এবং ইজরায়েলে ফের সংক্রমণ বৃদ্ধি শুরু হয়েছে (ছবি – ৩) ।

ছবি – ৩ : ইজরায়েল এবং যুক্তরাজ্যে সম্প্রতি ফের মাথা চাড়া দিয়েছে সংক্রমণ, মোট জনসংখ্যার অন্ততঃ চল্লিশ-ষাট শতাংশ-কে টিকার দুটি ডোজ দেবার পরও।

এখানে কতগুলি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ টিকাকরণ বিষয়টিকেই পর্যালোচনা করার জন্য। সেগুলোতে আসছি। তার আগে বলা দরকার, কেন টিকাকরণ বিষয়টিকেই সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। প্রথমতঃ চলতি টিকাগুলি সবই পরীক্ষামূলক পর্যায়ের, ফলে এগুলির ফাঁকফোকর প্রচুর। এবং এই ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়া রূপভেদগুলি এই ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়া রপ্ত করে নিতে পারে, পরিভাষায় যাকে বলে ইমিউনিটি এসকেপ ভ্যারিয়েন্ট বা অনাক্রম্যতা-এড়ানো রূপভেদ। দ্বিতীয়তঃ অতিমারির মুখে গণটিকাকরণের ফলে এই অনাক্রম্যতা এড়ানো রূপভেদের বাড়বৃদ্ধি হয়ে যেতে পারে বলে কিছু বিজ্ঞানী সতর্ক করছিলেন ক্রমাগত। যাই হোক, যে প্রশ্নগুলি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সময় টিকাকরণ বিষয়টিকেই পর্যালোচনা করার জন্য, সেগুলি হল — ১) বেশি ছোঁয়াচে ও বেশি শক্তিশালী, অর্থাৎ, উদ্বেগজনক রূপভেদগুলি প্রাকৃতিক সংক্রমণের ফলে পাওয়া অনাক্রম্যতা এবং টিকা থেকে পাওয়া অনাক্রম্যতার মধ্যে কোনটাকে বেশি ভাঙছে। ২) বেশি ছোঁয়াচে ও বেশি শক্তিশালী রূপভেদগুলি অন্যান্য রূপভেদগুলিকে হারিয়ে মূল রূপভেদ-এ পৌঁছে গেল – এর সঙ্গে টিকাকরণের কোনো আন্তঃসম্পর্ক আছে কি না। ৩) প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজের মধ্যের সময়ে আংশিক টিকাভাঙা সংক্রমণ এবং দ্বিতীয় ডোজের পর পূর্ণাঙ্গ টিকাভাঙা সংক্রমণ রূপভেদগুলির মধ্যে নির্বাচনী পক্ষপাত আমদানি করছে কি না।

হালের গবেষণাপত্র পর্যালোচনা

আমরা এবার কয়েকটি গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করতে শুরু করব।

৬ এপ্রিল একটি হেফাজতখানা বা আর্কাইভে প্রকাশিত হওয়া ইসরায়েলের একটি গবেষণাপত্র (Kustin et al 2021; https://doi.org/10.1101/2021.04.06.21254882) দেখায়, অন্যান্য রূপভেদগুলির চেয়ে উদ্বেগজনক আলফা রূপভেদ-এ সংক্রমিত হবার হার টিকাগ্রহীতার (ফাইজার) বেশি, যারা টিকা নেয়নি তাদের তুলনায়। প্রথম ডোজ-এবং দ্বিতীয় ডোজ-এর মধ্যিখানের সময়টাতে অনেক বেশি, দ্বিতীয় ডোজ-এর পর সামান্য বেশি। এবং এই ফারাকের সঙ্গে বয়সের কোনও সম্পর্ক নেই। প্রসঙ্গতঃ, এতে প্রথম ডোজ এর পর দু-সপ্তাহ গত হলে তবে তাকে প্রথম ডোজ নেওয়া বলে ধরা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় ডোজ নেবার ৭ দিন গত হলে তাকে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া বলে ধরা হয়েছিল। জনস্বাস্থ্য কেস-কন্ট্রোল সমীক্ষা ভিত্তিক জিনোমিক বিশ্লেষণ এই তথ্য দেখালেও গবেষণাপত্রটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই অনুসিদ্ধান্ত বাদ দেয় যে অন্ততঃ প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজ-এর মাঝের সময়টিতে টিকাগ্রহীতারা আলফা স্ট্রেনটির ছড়ানোয় সম্ভবতঃ বেশি সাহায্য করেছেন, যারা টিকা নেননি তাদের তুলনায়। অত্যন্ত আগ্রহজনক ব্যাপার হল, ইজরায়েলে টিকা দেওয়া শুরু হয় ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ থেকে। এবং সেই সময় থেকেই আলফা রূপভেদটি অন্যান্য রূপভেদগুলিকে হারিয়ে মূল রূপভেদে পরিণত হবার দিকে যেতে শুরু করে (ছবি — ৪)। ফলে গবেষণার ফল ও প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্তের থেকে উক্ত অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছনোর মতো মালমশলা ওই গবেষকদের হাতে ছিল। বদলে তারা যত দ্রুত সম্ভব দ্বিতীয় ডোজ দেবার অনুসিদ্ধান্তের পক্ষে সওয়াল করে উদ্বেগজনক রূপভেদ আটকানোর জন্য।

ছবি – ৪ : ইজরায়েলে ভাইরাসের উদ্বেগজনক রূপভেদ বৃদ্ধি, দ্বিতীয় ঢেউ-এর সংক্রমণ বৃদ্ধি, এবং টিকাপ্রদান-এর সূচনা-র আন্তঃসম্পর্কের রেখাচিত্র। (ওপরে) জিনসারণী ডেটাবেস-এ উদ্বেগজনক রূপভেদ বৃদ্ধি; নীল রেখা আলফা রূপভেদের। কমলা রেখা বিটা রূপভেদের। (মাঝে) ইজরায়েলে দ্বিতীয় ঢেউ, যা আলফা রূপভেদ বাহিত। (নিচে) ইজরায়েলে টিকাকরণ। ২০২০ -র ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ থেকে শুরু হয়েছিল। জানুয়ারির মাঝামাঝি যখন আলফা রূপভেদ ব্যাপক আকার নিচ্ছে, তখন অবদি ইজরায়েলে ফাইজার টিকার প্রথম ডোজ নেওয়া কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ না নেওয়া বয়স্ক মানুষ ও স্বাস্থ্যকর্মী জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ।

২২ মে আর্কাইভে একটি ব্রিটেনের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় (Bernal et al 2021; https://doi.org/10.1101/2021.05.22.21257658 )। এতে প্রথম ডোজ এর পর ২১ দিন গত হলে তবে তাকে প্রথম ডোজ নেওয়া বলে ধরা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় ডোজ নেবার ১৪ দিন গত হলে তাকে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া বলে ধরা হয়েছিল। এছাড়াও যারা কেবল অসুস্থ হচ্ছে (সিম্পটম দেখাচ্ছে) তাদের সিম্পটম বেরোনোর পর দশ দিনের মধ্যে পিসিআর টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ এলে তাকে সংক্রমিত বলে ধরা হয়েছিল। এই জনস্বাস্থ্য সমীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে জিনোমিক বিশ্লেষণ গবেষণার রিপোর্টের নমুনা সংখ্যা বেশ বেশি ছিল, ইজরায়েলের গবেষণাটির চেয়ে। এই গবেষণায় দেখা গেল, আলফা রূপভেদের চেয়ে বেশি ছোঁয়াচে ও বেশি শক্তিশালী বা বেশি উদ্বেগজনক ডেল্টা রূপভেদ-এ আক্রান্ত হবার হার টিকাগ্রহীতাদের (ফাইজার ও অ্যাস্ট্রোজেনেকা, দুটিতেই) বেশি, যারা টিকা নেয়নি তাদের তুলনায়। এমনকি, দেখা গেল, প্রথম ডোজ ও দ্বিতীয় ডোজ এর মধ্যেখানের সময়টাতে আলফার বদলে ডেল্টায় আক্রান্ত হবার হার টিকা-না-নেওয়া লোকেদের তুলনায় যত বেশি, দ্বিতীয় ডোজের পর তা আরও বেশি (টেবিল – ১)। ফলে এই তুলনামূলকভাবে বৃহৎ নমুনা নিয়ে হওয়া গবেষণাটি পরিষ্কারভাবে দেখালো, ইজরায়েলের গবেষণাটিতে যে দ্বিতীয় ডোজ দ্রুত দিয়ে আরো উদ্বেগজনক রূপভেদ আটকানোর ব্যাপারে সওয়াল করা হয়েছে, তা বিতর্কিত অনুসিদ্ধান্ত এবং এই গবেষণার ফলাফল তার ঠিক উল্টো অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় — আংশিক টিকাভাঙা সংক্রমণই শুধু বেশি উদ্বেগজনক রূপভেদকে ছড়ানোয় সাহায্য করছে, তা নয়; পূর্ণ টিকাভাঙা সংক্রমণও বেশি উদ্বেগজনক রূপভেদকে ছড়ানোয় সাহায্য করছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কোভিড টিকাকরণ কর্মসূচীর মধ্যে দিয়েই বেশি উদ্বেগজনক রূপভেদ বহরে গতরে বাড়ছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, যা পাওয়া গেল গবেষণায় তার ঠিক উল্টো একটা গড়পড়তা সিদ্ধান্ত লিখে দায় সারল গবেষণাপত্রটি, যাতে এই তুলনামূলক দিক সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেওয়া হল। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া টিকাগ্রহণকারীদের মধ্যে আক্রান্ত (সংক্রমিতর সংখ্যা নয়, কেবল অসুস্থদেরই ধরা হয়েছে গবেষণাটিতে; অর্থাৎ, যারা অসুস্থ বোধ করার দশ দিনের মধ্যে টেস্ট করিয়ে পজিটিভ এসেছে) মোটের ওপর যারা টিকা নেয়নি তাদের তুলনায় কম, এটা বলেই সিদ্ধান্ত শেষ করল গবেষণাপত্রটি।

টেবিল — ১ : Bernal et al 2021 থেকে নেওয়া। যুক্তরাজ্যে টিকা না নেওয়া দের তুলনায় টিকা নেওয়াদের মধ্যে আলফার তুলনায় আরো বেশি উদ্বেগজনক ডেল্টা রূপভেদে আক্রান্তের হার বেশি।

আগেই আলোচনা করা হয়েছে, সার্স কোভ-২ ভাইরাসের জিনের শরীর মূলতঃ চার ধরনের প্রোটিন দিয়ে তৈরি। স্পাইক (এস) প্রোটিন, যা মানুষ (বা অন্যান্য প্রতিপালক) শরীরের কোষের ওপর গেঁড়ে বসতে ও ঢুকতে সহায়তা করে। এস ১ অংশ, যার মধ্যে আছে রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন (আরবিডি) যা প্রতিপালকের গ্রাহক প্রোটিনের (এসিই২) সঙ্গে ভাইরাসটিকে বাঁধে কোষে ঢোকার ঠিক আগে। যত ভালো করে গেঁড়ে বসবে, তত ঢোকা সহজ হবে। এস ২ অংশ ভাইরাস এবং প্রতিপালক কোষের পর্দার মধ্যে জোড়া লাগার কাজ করে। নিউক্লিওক্যাপসিড (এন) প্রোটিন প্রতিপালক কোষের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরি এবং প্রতিপালক কোষের প্রতিক্রিয়া ম্যানেজ করার কাজ করে। মেমব্রেন (এম) প্রোটিন এবং এনভেলপ (ই) প্রোটিন প্রতিলিপি ভাইরাস সুষ্ঠভাবে গঠনে ভূমিকা পালন করে। আগেই বলা হয়েছে, টিকা থেকে যে প্রত্যক্ষ অনাক্রম্যতা পাওয়া যায় (পরিভাষায় অ্যান্টিবডি) তা টিকাটি ভাইরাসের শরীরের যে অংশটুকু নকল করে কেবল তারই প্রতিরোধক্ষম। যে পরীক্ষামূলক টিকাগুলি এখন চলছে, ফাইজার মডার্না কোভিশিল্ড কোভ্যাক্সিন ইত্যাদি, সবগুলিই ভাইরাসের স্পাইক-প্রোটিন গুলি (এস) শুধু নকল করে, ফলে টিকা থেকে পাওয়া অ্যান্টিবডি ভাইরাসের স্পাইক-কেন্দ্রিক। এর কারণ অবশ্য, নানা গবেষণায় দেখা যায়, মানুষের দেহে যে করোনা ভাইরাসগুলি দশকের পর দশক ধরে কাজ করে এসেছে, সেগুলি মানুষের কোষে মূলতঃ ঢোকে এই স্পাইক প্রোটিন বা গজালের মতো জায়গাটি কাজে লাগিয়ে। আবার, বছরের পর বছর ধরে তারা বদলও ঘটিয়েছে তাদের শরীরের স্পাইক অংশেই সবচেয়ে বেশি, আরও ভালো করে বললে, স্পাইকের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন অংশে (Eguia​ et al, ডিসেম্বর ২০২০, বায়োআর্কাইভ; https://doi.org/10.1101/2020.12.17.423313)। ফলে আন্দাজ করা যায়, মানব শরীর করোনাভাইরাসের এই স্পাইক বা গজাল অংশটিকেই সবচেয়ে বেশি চিনতে পারে এবং সংক্রমণের অভিজ্ঞতাজনিত স্মৃতি ও অ্যান্টিবডি তৈরি করে ওই স্পাইক বা গজাল লক্ষ্য করে, অনাক্রম্যতার জন্য। ভাইরাসের জাতিগতিতত্ত্ব অনুযায়ী, সেই অনাক্রম্যতাকে এড়ানোর জন্যই করোনা ভাইরাসের শরীরের ওই অংশে সবথেকে বেশি বদল হয়। যাই হোক, টিকা তৈরি হল স্পাইক-প্রোটিনকে কেন্দ্র করেই।

অপরপক্ষে প্রাকৃতিক সংক্রমণ থেকে পাওয়া অ্যান্টিবডি ও স্মৃতি কোষ ভাইরাসের সামগ্রিক শরীরের স্মৃতি বহন করে ও ভাইরাসের সামগ্রিক শরীরের ওপর কাজ করে। ফলে করোনা ভাইরাসের রূপভেদে স্পাইকের নানা অংশের গঠনের বেশি পরিবর্তন হলেও (বিশেষতঃ রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন বা আরবিডি অংশের, যা সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনপ্রবণ, পুরনো ২০০৪ সালের সার্সের তুলনায় ২০১৯ সালের সার্স-কোভ-২ তে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে এই অংশে) প্রাকৃতিক সংক্রমণ থেকে পাওয়া প্রত্যক্ষ (অ্যান্টিবডি) এবং পরোক্ষ প্রতিরোধ ক্ষমতার (স্মৃতি বি কোষ) তাকে প্রতিরোধ করতে পারার কথা। (প্রসঙ্গতঃ এই লেখার সমগ্র আলোচনায় আমরা স্মৃতি টি কোষেও ছাপ ফেলে যাওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতার কথা বাদ রাখব, কারণ গবেষণায় তার কোনো স্পষ্ট দিশা এখনও পাওয়া যায়নি।) যদিও, প্রাকৃতিক সংক্রমণ থেকে পাওয়া অ্যান্টিবডির পরিমাণ সাধারণতঃ একটু কম থাকে এবং সময়ের সাথে সাথে আরও কমে যায়। এগুলো সবই গত বছরের নানা গবেষণায় দেখা গেছিল (Robbiani et al, জুন ২০২০, নেচার; Lagunas-Rangel and Chávez-Valencia, জানুয়ারি ২০২১, ইমুনোবায়োলজি; Gaebler et al, ৪ জানুয়ারি 2021, বায়োয়ার্কাইভ; https://doi.org/10.1101/2020.11.03.367391)। ফলে প্রশ্ন যেটা দাঁড়ায়, তা হল, উদ্বেগজনক রূপভেদগুলিকে জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে, রাস্তা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে বা তাকে অন্যান্য রূপভেদগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভালো জায়গায় পৌঁছে দিতে প্রাকৃতিক সংক্রমণ থেকে পাওয়া অনাক্রম্যতা এবং টিকা থেকে পাওয়া অনাক্রম্যতার মধ্যে কে বেশি দর? ওপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার, যুক্তি বলে, টিকা বেশি দর। কিন্তু বিজ্ঞান তো যুক্তি দিয়ে চলে না। তার প্রমাণ লাগে। ফলে হাতে গরম প্রমাণ চাই। সে গবেষণা কি হল?

সে গবেষণাও হল। এপ্রিলের ৪ তারিখে আর্কাইভে প্রকাশিত হয় একটি আমেরিকান গবেষণা (Bates et al, 2021; https://doi.org/10.1101/2021.04.04.21254881)। জনা পঞ্চাশেক করে টিকাপ্রাপ্ত (ফাইজার, দ্বিতীয় ডোজ পাবার ১৪ দিন পর, গড়ে) এবং পুরনো সংক্রমণের ইতিহাস আছে (পিসিআর টেস্টে পজিটিভ আসার ১ থেকে ৩০০ দিন পর) এমন মানুষের রক্তরস (পরিভাষায় ভ্যাক্সিনেটেড সেরা ও কনভালেসেন্ট সেরা) সংগ্রহ করা হয়। সেই রক্তরসে উদ্বেগজনক রূপভেদগুলির আরবিডি অংশের পরিব্যক্তিগুলি নিকেশ বা নিউট্রালাইজ হচ্ছে কি না, তার একাধিক ধরনের পরীক্ষা করা হয় ল্যাবরেটরিতে। তাতে দেখা যায়, টিকার রক্তরসে আরবিডি-অ্যান্টিবডির পরিমাণ অনেক বেশি, পুরনো সংক্রমণের তুলনায়। টিকার রক্তরসের অ্যান্টিবডির রূপভেদ-আরবিডি নিউট্রালাইজ করার ক্ষমতাও বেশি পুরনো সংক্রমণের রক্তরসের অ্যান্টিবডির তুলনায়, সেটা কী আদি ভাইরাস, কী উদ্বেগজনক রূপভেদ — দুই ক্ষেত্রেই। কিন্তু, পুরনো সংক্রমণের রক্তরসের আদি ভাইরাস-আরবিডি এবং উদ্বেগজনক রূপভেদ-আরবিডি গুলিকে নিউট্রালাইজ করার ক্ষমতার যে ফারাক (আদি ভাইরাসের তুলনায় আলফার ক্ষেত্রে ১.৪ গুণ কম এবং বিটার ক্ষেত্রে ১.৮ গুণ কম), তা তুলনায় অনেক কম। কিন্তু টিকার রক্তরসের আদি ভাইরাস-আরবিডি ও উদ্বেগজনক রূপভেদ-আরবিডি গুলিকে নিউট্রালাইজ করার ক্ষমতার যে ফারাক, তা অনেক বেশি (আদি ভাইরাসের তুলনায় আলফার ক্ষেত্রে ২.২ গুণ কম এবং বিটার ক্ষেত্রে ৮.৮ গুণ কম)। এই ব্যাপারটিকে আলোচনায় উল্লেখ করে গবেষণাপত্রটি এবং বলে, পুরনো সংক্রমণ যাদের আছে, তাদের পুনঃসংক্রমণের জন্য দায়ী কম পরিমাণ অ্যান্টিবডি, ভাইরাসের রূপভেদের গজাল বা স্পাইক (আরবিডি) অংশের পরিব্যক্তি জনিত অনাক্রম্যতা-এড়ানো (ইমিউন এসকেপ) এর জন্য দায়ী নয়। কিন্তু এইটুকু বলেই ছেড়ে দেয়। যে অনুসিদ্ধান্তটি এড়িয়ে যায়, সেটা হল, প্রাকৃতিক সংক্রমণ জনিত অনাক্রম্যতা ভেঙে যে সংক্রমণ হয় তাতে উদ্বেগজনক বা বেশি উদ্বেগজনক রূপভেদ (খুব ঠিকঠাক বলতে গেলে, বেশি ছোঁয়াচে, কারণ ভাইরাসের স্পাইকের আরবিডি অংশ প্রতিপালকের কোষে ঢোকার দক্ষতা বাড়ায় বা কমায়) আলাদা করে ছাড় পায় না, কিন্তু টিকাভাঙা সংক্রমণে সেটা পায় এবং বেশ ভালোমতো পায়। ফলে টিকাভাঙা সংক্রমণ উদ্বেগজনক রূপভেদগুলিকে ছড়াতে সহায়তা করে।

৮ জুন একটি পত্রিকায় একটি আমেরিকান গবেষণা প্রকাশিত হয় (Greaney et al 2021) , তাতে দেখা যায়, প্রাকৃতিক সংক্রমণ জনিত অ্যান্টিবডি সাধারণভাবে ভাইরাসের গোটা অঙ্গের প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি করলেও টিকা (মডার্না-র) ভাইরাসের স্পাইকের আরবিডি অংশের পরিব্যক্তিকে নিউট্রালাইজ করতে বেশি সক্ষম পুরনো প্রাকৃতিক সংক্রমণের অ্যান্টিবডির তুলনায়। যদিও এই গবেষণায় প্রাকৃতিক সংক্রমণের যে ভলান্টিয়ারদের রক্তরস সংগ্রহ করা হয়েছিল, তারা বয়স্ক (গড় বয়স ছাপান্ন) এবং নানা ধরনের কো-মর্বিডিটি আছে, আর টিকাগ্রহীতা ভলান্টিয়াররা কমবয়সী, সর্বোচ্চ বয়সই পঞ্চান্ন মাত্র। আগের প্যারাগ্রাফে যে গবেষণাটার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে দেখানো হয়েছিল, পঞ্চাশের চেয়ে কমবয়সী এবং পঞ্চাশের বেশি বয়সীদের মধ্যে টিকাগ্রহীতা-রক্তরসের উদ্বেগজনক রূপভেদ-আরবিডি গুলিকে নিউট্রালাইজ করতে পারার ক্ষমতায় বেশ কয়েকগুণ ফারাক (বেশি বয়সীদের ক্ষমতা কম) হচ্ছে। অতএব স্পাইকের আরবিডি অংশের পরিব্যক্তিকে নিউট্রালাইজ করতে সংক্রমণের রক্তরসের অ্যান্টিবডির চেয়ে টিকার রক্তরসের অ্যান্টিবডি বেশি সক্ষম, সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এখানে আবার বলা প্রয়োজন, উদ্বেগজনক রূপভেদগুলি যদিও ফেনোটাইপ (বেশি ছোঁয়াচে, এবং / অথবা বেশি শক্তিশালী ইত্যাদি) দিয়ে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, তবে জিনোটাইপেও কিছু সাধারণ পরিব্যক্তি দেখা যায় — সেগুলিতে স্পাইক-প্রোটিনের ওই আরবিডি এনটিডি ও অন্যান্য অংশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিব্যক্তি ঘটেছে। এমনকি প্রতিপালকের কোষের মধ্যে প্রতিলিপি গঠনে অংশগ্রহণকারী নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন ও অন্যান্য অংশেও ঘটেছে (Rahman et al, অক্টোবর ২০২০, মেডিক্যাল ভাইরোলজি; Peacock et al, এপ্রিল ২০২১, জেনারেল ভাইরোলজি)। তবে উদ্বেগজনক রূপভেদগুলির আরবিডি অংশের পরিব্যক্তি গুলিই বেশি আলোচিত হয়।

আমরা ইংলন্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিখ্যাত একটি ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধানে দুটি গবেষণা পত্রের উল্লেখ করে আমাদের গবেষণাপত্র পাঠ-এর ইতি টানব আপাততঃ।

প্রথমটি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আর্কাইভে প্রকাশিত হয়েছিল (Collier et al 2021), পরে তার অনেক বয়ান বদল হয়ে বিখ্যাত পত্রিকা নেচার-এ প্রকাশিত হয় মার্চ মাসে। গবেষণাটির প্রথম ভার্সানে দেখা যায়, ইংলন্ডের কিছু বয়স্ক টিকাগ্রহীতাদের (২৫ জন, ৮২ বছর গড় বয়স, ফাইজার প্রথম ডোজ) রক্তরস নিয়ে এবং কিছু প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমিতদের (৭ জন) রক্তরস নিয়ে তাতে আদি উহান ভাইরাস, আলফা রূপভেদ, এবং আরো কিছু পরিব্যক্তি (আরবিডি এবং এনটিডি — স্পাইকের দুই অংশেই) কে সেগুলো কতটা নিউট্রালাইজ করতে পারে তার ওপর নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। তাতে দেখা যায়, টিকার প্রথম ডোজ গ্রহীতাদের বেশিরভাগের রক্তরসের অ্যান্টিবডি আলফা রূপভেদকে নিউট্রালাইজেশনের ক্ষমতা হারাচ্ছে আদি ভাইরাসের তুলনায়, গড়ে চারগুণের কাছাকাছি। অথচ পুরনো সংক্রমিতদের বেশিরভাগের রক্তরসের অ্যান্টিবডি আলফা রূপভেদকে নিউট্রালাইজেশনের ক্ষমতা ধরে রাখছে। আলোচনা শেষে অনুসিদ্ধান্ত টানার সময় গবেষণাপত্রটির পূর্ণাঙ্গ রূপের প্রথম ভার্সানটি (২ ফেব্রুয়ারি https://doi.org/10.1101/2021.01.19.21249840) বলে, যদিও টিকা সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটিকে দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায়, তবু দেখা যাচ্ছে, টিকা-এড়ানো (ভ্যাক্সিন এস্কেপ) সংক্রমণ হবেই ভবিষ্যতে। ফলে স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজনে এই টিকা কাজে লাগতে পারে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। এই ভার্সানটিতে শিরোনামে ছিল আলফা রূপভেদের টিকা ভাঙা-র কথা, পরিভাষায় ব্রেকথ্রু শব্দটি। কিন্তু দিন পনেরো পরে আর্কাইভে প্রকাশিত ভার্সানে এবং পরের মাসে (মার্চ) নেচার-এ প্রকাশিত ভার্সানে (https://doi.org/10.1038/s41586-021-03412-7) গবেষণাপত্রটির অনুসিদ্ধান্ত বদলে যায়, এবং শিরোনামটিও। শিরোনামে টিকা ভাঙার কথা বাদ যায়, বদলে আসে আলফা রূপভেদে টিকার সংবেদনশীলতা, পরিভাষায় সাসেপ্টিবিলিটি। আর অনুসিদ্ধান্তে টিকা-এড়ানো সংক্রমণ-এর অবশ্যম্ভাবতা প্রায় শর্তাধীন হয়ে যায় একটি বিশেষ উদ্বেগজনক পরিব্যক্তি (ই৪৮৪কে) ভাইরাসের রূপভেদ-এ আছে কি না তার ওপর। এবং ফলাফলের বর্ণনায় দেখা যায় নমুনা কিছু বেড়েছে। এখানে দেখা যায়, প্রথম ডোজ নেওয়াদের (৩৭ জন) বেশিরভাগের রক্তরসই আদি ভাইরাসের তুলনায় আলফা রূপভেদকে আটকানোর ক্ষমতা হারাচ্ছে গড়ে তিনগুণের বেশি (সর্বোচ্চ প্রায় ৯ গুণ)। এই ভার্সানে দেখা যায়, কিছু দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া নমুনা যোগ হয়েছে (২১ জন), তাদের রক্তরসের আদি ভাইরাসের তুলনায় আলফা রূপভেদকে আটকানোর ক্ষমতা হারানোর গড় প্রায় দুইগুণ। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে বদলটি হয় ফলাফলে, দেখা যায় এবার বর্ধিত নমুনা সংখ্যায় পুরনো সংক্রমিতদের (২৭ জন) বেশিরভাগের রক্তরসের আদি ভাইরাসের তুলনায় আলফা রূপভেদকে আটকানোর ক্ষমতা কমেছে এবং তা অনেকখানি (গড়ে ৪.৫ গুণ এবং সর্বোচ্চ প্রায় ১৩ গুণ)। এবং এই নতুন ভার্সানে টিকাগ্রহীতাদের বয়সের গড় দাঁড়ায় ৬২ বছর, এবং সবচেয়ে কমবয়সীর বয়স ৪৭ বছর। আগেই বলা হয়েছে, প্রথম ভার্সানে টিকাগ্রহীতাদের বয়সের গড় ছিল আশি বছরের বেশি। অর্থাৎ, পরে যুক্ত করা নমুনাগুলি কমবয়সীদের থেকে নেওয়া। পুরনো সংক্রমিত নমুনাগুলির বয়সের গড়ের কথা কোনো ভার্সানেই উল্লেখ করা হয়নি।

এই গবেষণাপত্র-র বিবর্তন এবং আগের দুটি গবেষণাপত্র থেকে কী আন্দাজ করা যায়? বেশিবয়সীদের প্রথমে টিকাকরণের স্ট্র্যাটেজিতে উদ্বেগজনক রূপভেদ জিইয়ে রাখা ও ছড়ানোর সম্ভবনা বেশি। তাই না?

আরেকটি গবেষণাপত্র খুবই সদ্য, ২২ জুন আর্কাইভে প্রকাশ করা হয়েছে (Mlcochova et al 2021; https://doi.org/10.21203/rs.3.rs-637724/v1) । গবেষণাপত্রটি ব্রিটেন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ডেনমার্কের নানা গবেষণাগার মিলে বানানো। গবেষণাটিতে দেখা যায়, পুরনো সংক্রমিতদের রক্তরসের অ্যান্টিবডিতে ডেল্টা রূপভেদটি আলফা সহ অন্যান্য রূপভেদগুলির চেয়ে কম দমিত হয়, এবং ওই রক্তরসে ডেল্টা রূপভেদটির প্রতিলিপি বানানোর দক্ষতাও আলফা রূপভেদটির চেয়ে বেশি। ভারতের তিনটি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে টিকাভাঙা সংক্রমণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাদের সংক্রমণে ডেল্টা রূপভেদ অন্যান্য রূপভেদগুলির চেয়ে বেশি তো বটেই, এমনকি যাদের সংক্রমণে ডেল্টা রূপভেদ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের ভাইরাল লোড-ও বেশি (গড় সিটি মান ১৬.৫, অন্যান্য রূপভেদে গড় ১৯) । এই স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকাভাঙা সংক্রমণের ভাইরাসগুলির জেনেটিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায়, ডেল্টা রূপভেদ যাদের আছে, তাদের চাক বা ক্লাস্টারের গড় ৩.৩ জন, সেখানে অন্যান্য রূপভেদগুলির ক্ষেত্রে এই চাক ১.১ জনের। অর্থাৎ টিকাভাঙা সংক্রমিতদের মধ্যে যারা ডেল্টায় সংক্রমিত, যারাই কি না সংখ্যায় বেশি, তাদের ভাইরাল লোডও তুলনায় অনেক বেশি এবং তারা তুলনায় তিনগুণ বেশি ছড়ায় সংক্রমণ। দেখা যায়, টিকাগ্রহীতাদের রক্তরসের অ্যান্টিবডির ডেল্টা রূপভেদকে আটকানোর বা নিউট্রালাইজ করার ক্ষমতা গড়ে ৮ গুণ কম ভাইরাসের প্রাথমিক রূপভেদগুলিকে নিউট্রালাইজ করার ক্ষমতার চেয়ে। দেখা যায়, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার (ভারতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত) এই ক্ষমতা ফাইজারের টিকার চেয়ে অনেক কম। গবেষণাপত্রটি অনুসিদ্ধান্ত তৈরি করে, ভারতে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের মারাত্মক আকারের দ্বিতীয় ঢেউ পুরনো সংক্রমিতদের মধ্যে ডেল্টা রূপভেদের অনাক্রম্যতা এড়ানো সংক্রমণ ও বেশি ছোঁয়াচে ফেনোটাইপের ফল। কিন্তু শুধু কি এটুকুই আলোচনার ছিল এই ফলাফল থেকে? ডেল্টা রূপভেদ ভারতে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে। সেই রূপভেদ কীভাবে টিঁকে থাকল, খুব অল্প অল্ল করে বাড়তে লাগল ফেব্রুয়ারি অবদি, এবং শেষে মার্চ মাসে মাঝামাঝি থেকে অন্যান্য সমস্ত রূপভেদকে ছাপিয়ে গেল তো বটেই, ভীষণ মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ এনে দিল যা খাড়া উঁচু হয়ে উঠল এপ্রিল মাসে? উল্লেখ্য, ভারতে স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকাকরণ শুরু হয় জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে এবং মার্চ মাসের এক তারিখ থেকে ষাটোর্ধদের টিকাকরণ শুরু হয়। তাহলে কি এই ডেল্টা রূপভেদের টিঁকে থাকা, অন্য রূপভেদগুলির মাঝে পথ করে নেওয়া এবং আস্তে আস্তে বাড়তে থাকার যে তিনমাস সময়কাল (জানুয়ারি — মার্চ), এই সময়কালে ভারতে স্বাস্থ্যকর্মী এবং বয়স্কদের অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাকরণ ডেল্টা রূপভেদ-কে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল? এই প্রশ্নটা তোলার সঙ্গত কারণ রয়েছে, যেহেতু জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শুরু করে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেখা যায় ভারতে প্রায় ৪ কোটি লোক টিকার প্রথম ডোজ পেয়ে গেলেও দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার সংখ্যা পৌনে এক কোটিও হয়নি, এবং এদের সবাই হয় স্বাস্থ্যকর্মী বা ষাটোর্ধ বয়স্ক। মার্চের শেষ অবদি স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া একজনও ষাটোর্ধ বয়স্ক দ্বিতীয় ডোজ পাননি কারণ দুটি ডোজের মধ্যের সময়ের তফাত এক মাসের মতো। এবং আগে উল্লিখিত গবেষণা দেখিয়েছে, বিশেষ করে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার প্রথম ডোজ-এর ডেল্টা রূপভেদ-এ বাস্তব কার্যকরীতা মাত্র ৩৩ শতাংশের মতো (Bernal et al, 2021)। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, বিটা রূপভেদে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার কার্যকরীতা ১০ শতাংশের মতো (Madhi et al., মার্চ ২০২১, নিউ ইংলন্ড জার্নাল অফ মেডিসিন), এবং এই কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানে বিটা রূপভেদ সবচেয়ে প্রবল, সে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা-কে ছাড়পত্র দেয়নি। যাই হোক, বর্তমানে আলোচিত গবেষণাপত্রটিতে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে ভারতে দ্বিতীয় ঢেউ এর কারণ হিসেবে ডেল্টা-র পুরনো সংক্রমণ জনিত অনাক্রম্যতা ভাঙা ও ডেল্টার বেশি ছোঁয়াচে ফেনোটাইপের অনুসিদ্ধান্ত টানা হয়েছে, কিন্তু জানুয়ারি-মার্চ তিনমাস সময়কালে এই ডেল্টা রূপভেদের টিঁকে থাকা ও বহরে গতরে বাড়তে বাড়তে যাওয়া ও তার সাথে ভারতের টিকাকরণ কর্মসূচীর (অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা কোভিশিল্ড নির্ভর, স্বাস্থ্যকর্মী এবং বয়স্কদের আগে টিকাকরণ নির্ভর) আন্তঃসম্পর্কের আলোচনাটি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, অথচ এই আলোচনার সুযোগ ছিল গবেষণাটি যে বিস্তারে ফলাফল তৈরি করেছে, তার মধ্যে থেকেই।

আমরা গবেষণার আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না, যদিও আরো প্রচুর গবেষণা আছে এবং আলোচনারও সুযোগ আছে। সমবৈশিষ্ট্যের বা কোহর্ট সমীক্ষা ভিত্তিক জনস্বাস্থ্য গবেষণা, মডেল ভিত্তিক জনস্বাস্থ্য গবেষণা, জিনোমিক গবেষণা ইত্যাদি প্রচুর হচ্ছে ও হয়ে চলেছে। গত দু-তিন মাস ধরে এই সব গবেষণায় টিকা-এড়ানো, অনাক্রম্যতা-এড়ানো রূপভেদের আলোচনা আরো বেশি বেশি করে উঠে আসছে। মোটামুটি সব গবেষণাই বলছে, যে টিকাগুলি চলছে, সেগুলিকে আরো উন্নত করতে হবে অতিমারিকে কব্জা করার জন্য। কিন্তু পরীক্ষামূলক স্তরের টিকা দিয়ে গণটিকাকরণের যে স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়েছে অতিমারি চলাকালীন, তাকে প্রশ্ন করা হয়েছে এরকম গবেষণা এখনও চোখে পড়েনি। একটি মডেলভিত্তিক জনস্বাস্থ্য গবেষণা (ফ্রান্সের, ১ জুন আর্কাইভে প্রকাশিত, McLeod and Gandon 2021, https://doi.org/10.1101/2021.06.01.446592 ) খুব কাছাকাছি পৌঁছেছে এই প্রকল্প বা প্রশ্নটিকে আলোচনায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে। মারেক রোগ, ইঁদুরের ম্যালেরিয়া এবং পের্টুসিস -এর ক্ষেত্রে টিকাকরণের ফলে প্যাথোজেনগুলির বেশি শক্তিশালী রূপভেদগুলি বিবর্তনে সুবিধা পেয়েছে সেসবের গবেষণাপত্র উল্লেখ করে এই জনস্বাস্থ্য গবেষণায় অতিমারি পরিস্থিতিতে টিকাকরণের ফলে একইসাথে টিকাভাঙা ও বেশি শক্তিশালী রূপভেদ নির্বাচিত হতে পারে কি না সেই প্রশ্নটিকে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে জনস্বাস্থ্য মডেলিং-এর মাধ্যমে।

উপসংহার — গতিশীল অচলায়তন

বিজ্ঞান গবেষণার যে ধরন এবং উদ্দেশ্য এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সবজায়গাতেই, তাতে তা সমাজমুখীনতার পরিবর্তে ব্যক্তি গবেষকের আকাডেমিক কেরিয়ারকেন্দ্রীক। পেপারের সংখ্যা, বেশি সাইটেশন, লম্বা লেখক তালিকায় এক নম্বরে থাকা, নামী জার্নালে পেপার ছাপানো — এসবই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় বা আকাদেমিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি বা পাকাচাকরিতে বা পদোন্নতিতে সরকারিভাবেই দেখা হয়। তাছাড়া যে ধরনের গবেষণার কথা তুলে ধরা হল — সেগুলি সবই পুঁজিনিবিড়, কারণ এই জিনোমিক গবেষণায় প্রচুর জিনিসপত্র মেশিন এবং পূর্ণসময়ের গবেষক বা গবেষণাকর্মীর প্রয়োজন হয় যা ব্যাপক বিনিয়োগের ব্যাপার। এমনকি পেপার ছাপাতেও অনেক সময় প্রচুর টাকাপয়সা লাগে। উদাহরণ স্বরূপ, কয়েকটি উন্নত দেশ ছাড়া এই জিনোমিক গবেষণার সরঞ্জামই নেই। এছাড়া প্রশিক্ষিত গবেষণাকর্মী পাওয়াও কঠিন। আমাদের দেশে কিছু থাকলেও সেখানকার তথ্য চাইলেই পাবলিক পরিসরে জানানো যায় না, সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সবমিলিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা এখন একটি ইন্ডাস্ট্রি বললে অত্যুক্তি হয় না। যার সঙ্গে চিকিৎসা-ইন্ডাস্ট্রির নিবিঢ় যোগ। চিকিৎসা ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে যেমন আছে ওষুধ, অ্যান্টিবডি-ককটেল, তেমনি আছে টিকা। আশেপাশেই আছে টেস্ট, স্যানিটাইজার ইত্যাদি। দেখা যায়, এই দুই ইন্ডাস্ট্রিই লাভজনক, কিন্তু চিকিৎসা ইন্ডাস্ট্রি বেশি লাভজনক তাই স্বাভাবিকভাবেই সে এই বিজ্ঞান-গবেষণা ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেখা যায়, নামী জার্নালের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য যে বিজ্ঞানী, সেই আবার টিকা-কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। ফলে গবেষক-গবেষণা-গবেষণাগারের স্বার্থের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী, ঘোষিতভাবে বা অঘোষিতভাবে। চিকিৎসা-ইণ্ডাস্ট্রি ও গবেষণা-ইন্ডাস্ট্রি আবার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সাধারণভাবে পুঁজি বিনিয়োগ এবং রাষ্ট্র ও অতিরাষ্ট্রের (যেমন রাষ্ট্রপুঞ্জের হু) এই করোনা-অতিমারিকে সামলানো বা ম্যানেজ করার সঙ্গে। যে কারণে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার কতটা যথাযথ প্রতিনিধিত্বমূলক, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। সব মিলিয়ে এ এক অচলায়তন, মানুষ বা সমাজ সেখানে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ প্রায় পায়ই না বলতে গেলে। শুধু সেই সমাজের মধ্যে যাদের কথা বেশি শোনা যায় – যেমন, নানা ধরনের মিডিয়ার কাছাকাছি থাকা অংশ, প্রতিষ্ঠিত পার্টির ওপরতলা, প্রতিষ্ঠানগুলির ওপরতলায় থাকা অংশ — এদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা মাঝে মাঝে এই অচলায়তনে ছাপ ফেলে। এই উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা ওই অচলায়তনের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তৈরি করে এক গতিশীল অচলায়তন, যা নিজেই নিজের প্রকল্প ও প্রশ্ন তৈরি করে এবং তার সমাধান করে। কী প্রকল্প সেখানে বিবেচিত হবে এবং কী সেখানে বিবেচিত হবে না, তা নির্ভর করে এই গতিশীল অচলায়তনের বেঁচেবর্তে থাকা এবং প্রফুল্ল থাকার শর্তের ওপর, ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলে অ্যালাইভ এন্ড কিডিং। এই নিজেই নিজের প্রকল্প তৈরি ও সমাধানের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ — এক বছরের মধ্যে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের টিকাকরণ শুরু করে দিয়ে টিকাকরণের মাধ্যমে অতিমারিকে মোকাবিলা। ফলতঃ সমস্ত গবেষণাপত্রে কীভাবে আরো ভালো করে টিকাকরণ সম্ভব (দ্রুত দ্বিতীয় ডোজ, তৃতীয় ডোজ, টিকার পরেও মাস্ক-সামাজিক দূরত্ব-লকডাউন চালিয়ে যাওয়া, আদি ভাইরাসের স্পাইক নির্ভর টিকার বদলে সাধারণ টিকা ইত্যাদি) তার অনুসিদ্ধান্ত লেখা হয়। কিন্তু এই টিকাকরণের ফলে টিকা-এড়ানো সংক্রমণের মধ্যস্থতায় আরো ছোঁয়াচে ও আরো শক্তিশালী রূপভেদের ভাইরাস তৈরি হয়ে অতিমারিটাই দীর্ঘায়িত হচ্ছে কি না — এই প্রকল্প বিবেচনায় আসে না গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ এবং আলোচনা করার সময়। কারণ এসব প্রকল্প বিবেচনায় আনলে বিশালাকৃতিক্সের ভাষায় ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে’। এইসময়ে এইভাবে এইধরনের টিকাকরণ বা গণটিকাকরণ বন্ধ করে দেওয়া উচিত কি না, বিজ্ঞান গবেষণার মধ্যে থেকে সে কথা তোলা তো অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয় করার মতো ব্যাপার। তাই যতই গবেষণার তথ্য উন্মুক্ত হোক (Gisaid), যতই গবেষণাগারগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হোক, এসবের ফলে গবেষণার ফলাফল তৈরি হওয়া যতই দ্রুত ও সহজ হোক — বিজ্ঞান-গবেষণা ওই গতিশীল অচলায়তনের কব্জায় থাকলে তার সমাজমুখীন হওয়া দূর অস্ত।

3 thoughts on “করোনা ও টিকা : টিকাভাঙা সংক্রমণ অতিমারিকে দীর্ঘায়িত করছে কি? — এই প্রশ্নটির আলোচনা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছে গবেষণাপত্রগুলি

  1. একটি প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ।
    “Taking all these observations into consideration, the question whether the vaccines used have generated new
    variants is relevant. From diverse public sources, we have reconstructed the history of the vaccine trials conducted
    worldwide and established their chronology with respect to the dates of first appearance of the main variants of
    concern (VOC) [9-14]. Result are gathered in Table 1a and 1b and Figure 2. We observe that VOCs have emerged in
    the countries where large trials were conducted. The emergence occurred towards the end of the vaccine trial
    periods, or shortly after”
    https://fortunepublish.com/articles/10.26502.ami.93650065.pdf

  2. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ (খসড়া) যা টিকার ফলে উদ্বেগজনক রূপভেদগুলি নির্বাচনী সুবিধা পেয়েছেস সম্ভবতঃ, সেটা অ্যাবস্ট্রাক্ট-এ বলেছে এবং প্রথম দিকে কিছু তথ্য দিয়েছে এই বক্তব্যের সপক্ষে। https://doi.org/10.21203/rs.3.rs-986605/v1

Leave a Reply to শমীক সরকার Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *