বসুন্ধরায় আজাদি প্রতিবেদন #
উৎসবের মরশুম চলে এলেও উৎসবে মেতে ওঠার মতো পয়সা নেই লোকের হাতে। লকডাউন শেষ হলেও কাজ বা ব্যবসার হাল তেমন ফেরেনি এখনও। বর্ষা দেরিতে আসায় ধান রুইতে দেরি হয়েছে। কিন্তু এসবের মধ্যেই বাজারে সমস্ত জিনিসের দাম চড়া। হাত দেওয়া যাচ্ছে না।
খবরে দেখাচ্ছে, মন্ত্রী এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা বেরোচ্ছে। স্কুলের চাকরি যেন নিলাম হয়েছে এতদিন। সাত লাখ আট লাখ দশ লাখ। সরকার-শাসক দলের দুর্নীতির বহরে ঠিক যখনই মনে হচ্ছিল, তাহলে আর পড়াশুনা করে কী লাভ, ‘নেতা’ হয়ে গেলেই হয়, তখনই হাইকোর্টের ধাক্কায় সব পর্দাফাঁস হয়ে যেতে বসেছে। যারা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিল, তাদের অনেকের চাকরি গেছে বা যেতে চলেছে। তাতে মনে শান্তি হলেও চাপ রয়েই যাচ্ছে। কারণ যত মানুষ চাকরি চাইছে — তার তুলনায় চাকরি নগণ্য। সরকারি চাকরিগুলো ঠিকা, আংশিক এবং অস্থায়ী হয়ে যাচ্ছে আজ বহু বছর ধরে। বেসরকারি চাকরি কিছু আছে, কিন্তু তাতে চাকরি টিঁকে থাকার নিশ্চয়তা নেই, বেতন কম, খাটনি বেশি। লকডাউনে অনেকের চাকরি চলে গেছে। সেগুলো আর ফিরে পাওয়া যায়নি। কাজ কারবার বা ব্যবসার হাল খারাপ বেশ কয়েক বছর ধরে — সেই নোটবন্দী বা তার আগে থেকেই। চাষেও লাভ সামান্য এবং তা-ও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এই তো এখন, সবজির দাম এক ধাক্কায় কমে গেছে অনেকখানি। ফলে পুরো ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত হয়ে গেলে, দুর্নীতি যারা করেছে তারা শাস্তি পেলেও মানুষের প্রতিদিনের সমস্যাগুলি চলে যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাচ্ছে। ভাত কাপড় বাসস্থান শিক্ষা কাজ চিকিৎসা যানবাহন বিদ্যুৎ ইন্টারনেট ইত্যাদির সমস্যা রয়ে গেলে সকলেই অন্যকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাইবে, এমনকি ঘুষ টুষ দিয়ে হলেও। ফের কি তাহলে দুর্নীতি মাথা চাড়া দেবে না?
দুর্নীতি মূলতঃ দুই ধরনের। এক, অতিধনী কর্পোরেট ও ধনী ব্যবসায়ী এবং শাসক দল ও সরকারি উচ্চপদস্থ বাবুদের মধ্যে লেনদেন। দুই, সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষ এবং ধান্দাবাজ নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের মধ্যে লেনদেন। আমাদের রাজ্যে এই দুই ধরনের দুর্নীতিই এখন ভয়ঙ্কর বেশি। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক তৎপরতাও কম। যেমন একশ’ দিনের কাজ না করেও টাকা চলে যায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। মোটা কমিশন খায় পার্টির নেতারা। পাকা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও আবাস যোজনায় টাকা পায় শাসক পার্টির কাছাকাছি থাকা লোকেরা। নদীর যেখান থেকে বালি তোলার কথা নয় সেখানে শাসক দলের নেতাদের ঘুষ দিয়ে বালি তোলা হয়। পুকুর নদী বিল ভরাট করে প্লট করা হয় পার্টিকে টাকা দিয়ে। এই সব দুর্নীতির কথা সবাই জানে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তৎপরতা কতটা?
এছাড়া আরো কিছু দুর্নীতি আছে, যেগুলি দুর্নীতি বলে প্রমাণ করা যায় না — যেমন, বড়ো কোম্পানিগুলির মুনাফার ওপর কর কমিয়ে দেওয়া বা কর মুকুব করে দেওয়া (ফলে সরকারের আয় কমে যাওয়া) এবং তার বিনিময়ে শাসক দলের প্রতি বড়ো কোম্পানিগুলির ডোনেশন বৃদ্ধি (২০১৯ এ কেন্দ্রীয় সরকার করেছে) ইত্যাদি। উদাহরন স্বরূপ, তদন্তকারী সংস্থার মতে ‘স্কুল-শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি’ একশ’ কোটি টাকার। আর কর্পোরেটদের ওপর কর কমিয়ে দেওয়ার (যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষতি বছরে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো) ‘কৃতজ্ঞতা’ স্বরূপ ২০১৯-২০ বর্ষে দেশে রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া মোট কর্পোরেট ডোনেশনের আশি ভাগই পেয়েছিল কেন্দ্রের সেই সময়ের শাসক দল, এবং তার পরিমাণ ৭২০ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা হিসেব করে দেখিয়েছেন, দেশে দুর্নীতির মোট পরিমাণ দেশের মোট বার্ষিক ধনসম্পদ-এর (জিডিপি) পাঁচ শতাংশেরও কম। তাহলে বাকি পঁচানব্বই শতাংশ ধনসম্পদ দুর্নীতিমুক্ত। দেশের মোট ধনসম্পদও ভালোই বাড়ছে। এই তো খবরে দেখাচ্ছে, ইংলন্ড-কে পেছনে ফেলে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে আমাদের দেশ। ২০১০ সালে ছিল ন’ নম্বরে। ফলে দেশগত ভাবে গত দশ বারো বছরে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি হারে মোট ধনসম্পদ বেড়েছে আমাদের দেশের। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অভাব অভিযোগ বাড়ছে কী কারণে? দেশ ধনী হলেও সাধারণ মানুষ কেন গরীব হয়ে যাচ্ছে? টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়? এর উত্তর হল — টাকাগুলো চলে যাচ্ছে দেশের অতিধনী ও ধনীদের পকেটে। গত বারো বছরে দেশের ধনসম্পদের ওপর অতিধনীদের কব্জা বেড়েছে (৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হয়েছে), ধনীদের ভোগদখলও বেড়েছে (৬১ থেকে ৬৫ শতাংশ হয়েছে)। উপার্জন-ও বেড়েছে ওদেরই (দেশের মোট আয়-এর মধ্যে ধনীদের ভাগ ৫৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়েছে)। অপরপক্ষে সাধারণ মানুষ, যারা দেশের জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশ, তাদের দেশের মোট সম্পদে এবং মোট আয়-এ ভাগ কমে গেছে এই বারো বছরে (সম্পদের ভাগ ৭ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৬ শতাংশ, আয়-এর ভাগ ১৪ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৩ শতাংশ)।
তাই দুর্নীতির বিরোধিতার পাশাপাশি মানুষের অভাব অভিযোগ নিরসনের পক্ষে আমরা। নইলে ধান্দাবাজ নেতামন্ত্রীআমলা আর সুযোগসন্ধানী মানুষ ঠিক গলতা খুঁজে বার করবে। মানুষ অভাব অভিযোগ নিরসনের জন্য চাই অসমতার বিলোপ। চাই সমতা। সেটা কী? আমাদের দেশে তথা গোটা বিশ্বে অতিধনী মুষ্টিমেয়-র হাতে বেশিরভাগ সম্পদ কুক্ষিগত। তাদের সম্পদ ও আয়ের ওপর চড়া হারে (৫০%) কর বসিয়ে সেই টাকা দিয়ে সাধারণ মানুষের আয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে। জনগণনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে, কারা শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরি, ব্যবসাপাতি, আয়ব্যয়, জমিজমা এবং সুযোগসুবিধায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পেছনে থেকে গেছে। তাদের সংরক্ষণ, উৎসাহপ্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে হাত ধরে টেনে এগিয়ে আনতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন খাদ্যশস্য ও মাছ-ডিম-মাংস-ডাল অর্থাৎ প্রোটিন, ভালো জ্বালানি, নির্মল জল, উঁচুমানের বিদ্যুৎ, দ্রুতগতির ইন্টারনেট, ঘরবাড়ি, পয়ঃপ্রণালী, যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত, সুচিকিৎসা ও ওষুধপত্র, উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গুণমানের শিক্ষা — এসব সর্বজনীন অধিকার মেনে নিয়ে সরকারিভাবে খুব কম পয়সায় বা বিনে পয়সায় সবাইকে সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তির যথাযোগ্য চাকরি/কাজ এর অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে, নইলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ভাতা দিয়ে। যারা এসবকিছুই অতিরিক্ত ভোগদখল করছে — সেই অতিধনীদের অতিভোগে ভাগ বসাতে হবে। শিশু কিশোর, বয়স্ক, গর্ভবতী এবং সদ্য-মা, ও গুরুতর অসুস্থ যারা — তাদের আদর যত্নের সুবন্দোবস্ত করতে হবে।
অনেকে মিলে চাইলে এ সব কিছুই সম্ভব।
সবচেয়ে বড় কথা। শুধু মাত্র ভারতে নয় প্রবাসী পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্হা খারাপ। বেতন কমছে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ। তবে তারচেয়ে বড় কথা কাজের বাজার কমেছে ফলে, বেতন আরো কমবে। বড়লোক সংখ্যা আরো বাড়বে, কিন্তু এর সমাধান কি???