‘ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটি নেটওয়র্ক’ সহ বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি ইংরেজি বিবৃতি আমাদের হাতে আসে ১৬ জানুয়ারি। এখানে তার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হল। অনুবাদ করেছেন সৌভিক ঘোষ।
রাস্তা আর ঘরের দেওয়ালে বড় বড় ফাটল আর ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে পড়া কাদাজল নিয়ে ঘুম ভাঙল যোশীমঠের; একটা দুটো নয় শহর জুড়ে ছশোর বেশি বাড়িতে ফাটল। যোশীমঠের নাম এখন “ডুবন্ত শহর”। ইতিমধ্যে ত্রাণ আর শহর খালি করার কাজ শুরু হয়েছে শম্বুক গতিতে। এদিকে শ’য়ে শ’য়ে নিরুপায় মানুষ রাস্তার ধরে পাতলা ছাউনিতে রাত কাটাচ্ছে যেখানে তাপমাত্রা প্রায় শূণ্য ডিগ্রি। উত্তরাখণ্ডের ক্ষমতাসীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী স্বভাবসুলভ দায়সারা ভঙ্গিতে নতুন করে বিশেষজ্ঞ দল গঠনের কথা বলছেন। অথচ যোশীমঠের এই পরিণতির পেছনের কারণগুলো গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরেই জানাছিল। আগে যেসব বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করা হয়েছিল তাদের সব সতর্কবার্তা আর সুপারিশ সম্পর্কে সরকার এযাবৎ উদাসীন ছিল। বদ্রীনাথ আর হেমকুন্ড যাবার প্রবেশদ্বার, এই ঐতিহাসিক শহরকে বহুদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা অবনমন এলাকা (land subsidence zone) অঞ্চল বলে এসেছেন। আজ যোশীমঠে যা হচ্ছে তার পেছনে পাঁচটি মূল কারণ আছে। জানা থাকা সত্ত্বেও NTPC আর `চারধাম মহামার্গ বিকাশ পরিযোজনা’ র মত সংস্থাগুলো সেগুলো অবহেলা করে আসছে। আজকের এই বিপর্যয় তারই ফলশ্রুতি।
১. যোশীমঠ শহর শতাব্দী প্রাচীন এক ধ্বসের ওপর তৈরি হয়েছে। এই শহরে বড় নির্মাণ আর পরিকাঠামো প্রকল্প-এর অনুমতি না দেবার জন্য শুধু এই একটি কারণই যথেষ্ট হবার কথা ছিল।
২. ভূবিজ্ঞানগত ভাবে main Central Thrust (MCT) এর খুব কাছে অবস্থিত হবার জন্য এই শহর সবচাইতে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল বা সিজমিক জোন-৫ এর অন্তর্ভুক্ত। শহরের কাছাকাছি অঞ্চলে সাম্প্রতিক কালেই বেশ কয়েকটা ছোটো ও মাঝারি ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছে, এর মধ্যে ১৯৯৯-এর বড়ো চামোলি ভূমিকম্পও (রিখটার স্কেলে ৬.৬-৬.৮) আছে। এই সব ভূমিকম্প শহরে ভিত্তিকে, যা কখনোই স্থিতিশীল ছিল না, আরো দুর্বল করে দিয়েছে।
৩. এই অঞ্চলের নিচ দিয়ে ধৌলিগঙ্গা, অলকানন্দা, ঋষিগঙ্গার মত বেশ কিছু দ্রুত বয়ে চলা নদী চলে গিয়েছে। এই সব নদীর প্রবাহ, বেড়ে চলা ভারী বৃষ্টিপাত, হরপা বান (উদাহরণস্বরূপ সাম্প্রতিক ধৌলিগঙ্গা বিপর্যয়) আর অস্থির জলবায়ু পাহাড়ের গোড়ালিকে (“toe region”) ক্ষয় করে স্থিতিশীলতা আরও নষ্ঠ করছে। সাথে সাথে বেড়ে চলেছে সব নির্মাণ সহ ওপরের মাটিতে ধ্বস নামার সম্ভাবনা।
৪. পর্যটনের (ধার্মিক আর প্রাকৃতিক) জন্য, ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে জটিল ও সক্রিয়, হিমালয়ের এই অংশের বিপুল বাণিজ্যিকরণ করা হয়েছে, আর্থিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ধারণ ক্ষমতার তোয়াক্কা না করে শহর জুড়ে বড়ো বড়ো হোটেল আর ইমারত তৈরিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
৫. বিপর্যয় পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে আছে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পঞ্চাশ বছর ধরে জানা থাকা সত্ত্বেও সমস্ত রকম ঝুঁকি ও বিনিয়োগের দায়বদ্ধতাকে অবহেলা করে চলার। চার ধাম সড়ক ও বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মত প্রকল্পকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে আর বিপদের কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই সেগুলো রূপায়ণও করা হয়েছে। অথচ এই ধরনের প্রকল্প সব সময়ই একটা অঞ্চলের জমির স্থিতিশীলতা নষ্ঠ করতে পারে। এসবই বিপর্যয় ডেকে এনেছেও।
১৯৭৬ এর বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে “মিশ্র কমিশন” তৈরি হয়েছিল। কমিশনের তৎকালীন পর্যবেক্ষণ খুব পরিষ্কারভাবে এইসব দুর্বলতাকে তুলে ধরে এবং এই অঞ্চলে ভারী নির্মাণ, ভিত্তি স্তরের পাথর অপসারণ, নিচের মাটিস্তরে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা (disturbance) সৃষ্টি ইত্যাদি কাজের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়। NTPC আর চারধাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্প এই সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেছে। এই বিপর্যয়ের জন্য তাই সরাসরি এই দুটি সংস্থা, রাজ্য সরকার, এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করা যায়।
অস্থিতিশীল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ হিমালয় অঞ্চলের জটিল বাস্তুতন্ত্রের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার কারণ :
যোশীমঠের নাম এখন সংবাদ মাধ্যমে সর্বত্র, কিন্তু যোশীমঠ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিবেশ বিষয়ক সমস্ত সতর্কতাকে উপেক্ষা করাটাই একরকম রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই হঠকারিতা হিমাচল থেকে সিকিম পর্যন্ত গোটা হিমালয় পর্বতমালার ভূসংস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। কার্যতঃ সরকারি বিশেষজ্ঞরাও মেনে নিয়েছেন যে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হল শহরের নিচে অবস্থিত তপোবন বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
আপৎকালীন ব্যবস্থা, পুনর্বাসন এসব নানা বিষয়ে আজ আলোচনা হচ্ছে। এমন বিপর্যয় হল কি করে এই নিয়ে কথা বিশেষ হচ্ছে না। আরো গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন চাপা পড়ে থাকছে। যেমন এই ব্যাপক নির্মাণ কাজ কী করে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পেল? এইসব প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ কারা করছে? কোথা থেকে টাকা আসছে?
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০০৬-এ। আনুমানিক ৩ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ২০১২-১৩-র ভেতর চালু হবার কথা ছিল। ২০১৩ ও ২০২১ এর বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির কারণে প্রকল্প এ-বছর থেকে চালু হবার কথা আর দেরির কারণে বাড়তি ১.৫ হাজার কোটি টাকা দরকার হয়। অতি ভূমিকম্পপ্রবণ, এবং হিমালয়ের জটিল বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত অঞ্চলে হওয়া সত্ত্বেও ২০০৪-এ পরিবেশ ছাড়পত্র পায় প্রকল্পটি। টাকা আসে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে।
NTPC যে EnvironmentImpact Assessment (EIA) জমা দিয়েছিল তাতে পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে এই অঞ্চল সিজমিক জোন ৪-৫ এর অন্তর্ভুক্ত। রিপোর্টে চারটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জলবিদ্যা-র দিক থেকে শুধু দুটি বাঁধের অন্তর্বর্তী অঞ্চলে প্রবাহ কমে আসার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে; জলজ বাস্তুতন্ত্র — যেখানে উজানে মাছের যাতায়াত আটকানোর কথা আলোচনা করা হয়েছে, কৃষি ও অরণ্য সম্পদ এর ক্ষতির কথা বলা হয়েছে, এবং ৫৭ টি পরিবারের পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। EIA যদিও দাবি করে যে জমি, মাটি ও অন্যান্য প্রভাব বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে ভূতত্ত্ব ও বাস্তুতন্ত্রের দিক থেকে এই বিপুল নির্মাণ কাজের কী প্রভাব এই অঞ্চলের ওপর পড়তে পারে সে সম্পর্কে কোনো খতিয়ান দেওয়া হয়নি। ২০১৩ ও ২০২১ এর বন্যায় ভেসে গেলেও নির্মাণকাজ বন্ধ হয়নি, নতুন করে চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনকি মিশ্র কমিশনের কোনো সতর্কতার দিকেও EIA নজর দেয়নি। বস্তুতঃ, শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধব শক্তি আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পের ভূমিকার ওপরেই EIA জোর দিয়ে এসেছে, বাস্তবে এই প্রকল্প পরিবেশ বান্ধব কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন মনে করেনি।
শক্তিশালী সামাজিক ও পরিবেশগত রক্ষাকবচের প্রয়োজনীয়তা :
কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদি না হওয়া সত্ত্বেও এই সব প্রকল্প যে ছাড়পত্র পেয়ে যায় তা থেকেই স্পষ্ট যে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ADB-র মোট আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো সমাজ বা পরিবেশরক্ষার বিষয়ে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। দেশীয় ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরো শোচনীয়, এই উন্নয়নমুখী লগ্নির ক্ষেত্রে এ-ধরনের এসব দিক খতিয়ে দেখার মত কোনো ব্যবস্থা এরা নিতে পারে না।
দেশের অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই সব প্রকল্প থেকে মুনাফা লোটে। NTPC তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্প দেখিয়ে, কয়েকশো কোটি টাকা বাজার থেকে তুলেছে শুধু বন্ড-এর মাধ্যমে। LIC, Central Bank of India, Punjab National Bank, Union Bank of India, Indian Overseas Bank, ও আরো বেশ কয়েকটি বিনিয়োগকারী সংস্থা এই বন্ড কিনেছে। শুধু এই একটি প্রকল্প নয় ২০১৭-র মার্চ মাস পর্যন্ত NHPC -র সুরক্ষিত ঋণ মিলিয়ে মোট দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমান ১৭,২৪৬ কোটি টাকা। সুরক্ষিত ঋণের মধ্যে আছে State Bank of India, Indian Overseas Bank, ICICI Bank Limited, Jammu & Kashmir Bank Limited, Bank of India, Axis Bank, State Bank of Patiala, State Bank of Bikaner & Jaipur, HDFC Bank, IndusInd Bank, Bank of Baroda, Central Bank of India, Kotak Mahindra Bank, RBL Bank, Life Insurance Corporation, Power Finance Corporation, and Rural Electrification Corporation -র মত আর্থিক সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ। এইসব সংস্থার একটিরও পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক কোনো নীতি বা দায়বদ্ধতা নেই।
এইসব বিপর্যয় বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় কোন নির্বোধের মতো উন্নয়নের মডেল আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা দেশীয় সংস্থা আর সরকারের প্রত্যক্ষ আর্থিক মদতে। ভবিষ্যতে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে বিপর্যয়ের ঝুঁকি কমানোর নাম করে দেশি বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলো এই ধরনের বিপর্যয় ভাঙিয়েও মুনাফা না লোটে।
আমরা দাবি করছি:
• তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্পের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করা হোক।
• হিমালয় অঞ্চলে এধরনের সমস্ত বড় প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করে সীমিত করা হোক।
• ভারতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য পরিবেশ সুরক্ষা নীতি তৈরি করা হোক।
• দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রথম ধাপ হিসেবে ক্ষুদ্র স্তরে গোটা হিমালয় জুড়ে জমির সব ধরনের দুর্বলতা চিহ্নিত করে মানচিত্র তৈরি করা হোক। এতে কোথায় কোথায় জমি স্থিতিশীল আর জল, যাতায়াতের সুবিধে ইত্যাদি খতিয়ে দেখে কোথায় কত বড় নির্মাণ করা যাবে তার রূপরেখা তৈরি করা যাবে।