সংযোজিত নাগরিকত্ব বিধি (CAR 2024) : কিছু বিপজ্জনক শর্ত

১১ মার্চ ২০২৪ তারিখে ই-গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরকত্ব বিধি ২০০৯ (CR 2009) এ কিছু সংযোজনী এনেছে, যার মধ্যে দিয়ে এই বিধি ২০১৯ সালে সংযোজিত নাগরিকত্ব আইন (CAA 2019) মোতাবেক হচ্ছে। ফলে এই সংযোজিত নাগরিকত্ব বিধি (CAR 2024) -র মধ্যে দিয়ে সংযোজিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯ (CAA 2019) লাগু হল বলা যায়। কেন্দ্রীয় সরকার টুইট করার পাশাপাশি এই বিধিসম্বলিত ই-গেজেটটি আলাদা ওয়েবসাইট করে রেখেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, এই বিধি যাতে যথেষ্ট প্রচারিত হয়, সে জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অতি-তৎপর।

কয়েক মাস আগে (গত বছর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে) কেন্দ্রীয় সরকার আধার আইনের বিধিতে একটি সংযোজন এনেছিল, যুক্ত হয়েছিল ২৮এ ধারা; কিন্তু তা নিয়ে কোনও প্রচার হয়নি। পরে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে যখন পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানুষের আধার কার্ড বাতিল হওয়ার চিঠি আসা শুরু করে, তখন লোকজানাজানি হয় এই ২৮এ ধারা সম্পর্কে।

তবে, যেহেতু এই বিধি কার্যকর করবে জেলা প্রশাসন, তাই সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের এখনও এক্তিয়ার আছে এই বিধি কার্যকর করা বা না করা বিষয়ে।

নয়া বিধি (CAR 2024) অনুযায়ী, পড়শি তিনটি দেশ — পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালের আগে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পার্সি, শিখ, এবং জৈন ধর্মের মানুষরা ভারতবর্ষে নাগরিকত্ব পাবেন। উল্লেখ্য, এই বিধিতে কোথাও এগুলিকে ধর্ম বা রিলিজিয়ন বলে উল্লেখ করা নেই; বলা আছে এই এই কমিউনিটির বা সম্প্রদায়ের মানুষ।

CAA 2019 তে ছিল, পড়শি দেশগুলিতে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত (religious persecution) হয়ে সেদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসা সেই দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ (ওপরে বলা ছটি ধর্মের) এই সংযোজনী অনুযায়ী ভারতে নাগরিকত্ব পাবে। সরাসরি আইনের ধারায় একথা না বলা হলেও, পাসপোর্ট আইন এবং ফরেইনার্স আইনের ধারাগুলির উল্লেখ ছিল, যেখানে এই ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে আসা-র কথা বলা ছিল।

নয়া বিধি CAR 2024 তেও পাসপোর্ট আইন ও ফরেইনার্স আইনের ওই ধারাগুলির উল্লেখ আছে, যা আমরা পরে দেখব। উল্লেখ্য, ওই ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে আসলে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা হবে না, এই ধারাগুলি পাসপোর্ট আইন ও ফরেইনার্স আইনে অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১৫ সালে। ২০২৩ সালে আধার আইনের ২৮এ সংযোজনীও ওই ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে আসা বিষয়ক ধারা।

ফলে, CAA 2019 এবং CAR 2024 এর ধারাগুলিতে প্রত্যক্ষভাবে “ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত” হয়ে বা তার ভয়ে যারা এসেছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, একথা উল্লেখ নেই বটে; কিন্তু এই আইন ও বিধিদুটি ঠিক এই কারণেই করা এবং তা আইনের ধারায় না পাওয়া গেলেও, এই দুটি ধারায় নাগরিকত্বের জন্য কে আবেদন করতে পারবে তার শর্ত থেকেই স্পষ্ট।

ফলে CAA 2019 এবং CAR 2024 আসলে পড়শি মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলি থেকে “ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত” হয়ে বা তার ভয়ে ভারতে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্বের আইন। এই আইন পড়শি দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের এই দেশে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এবং এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি শুরু হয়েছে ২০১৫ সালে পাসপোর্ট ও ফরেনার্স আইনের সংযোজনীর সময় থেকে, অর্থাৎ মোদি সরকার গঠনের পর।

নাগরিকত্ব শংসাপত্র পাওয়ার জন্য ওই মানুষদের আবেদন করতে হবে। এবং এই আবেদনকারীকে কিছু কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। এখানে সেরকম কয়েকটি শর্ত নিয়ে আমরা আলোচনা করছি।

শর্ত ১ : তাকে একটা হলফনামা দিতে হবে যাতে বলতে হবে — এই আবেদনে সে যা যা বলছে সেগুলি সত্য।

শর্ত ২ : আবেদনকারীকে আবেদনপত্রের সাথে কোনও একজন ভারতীয় নাগরিকের দেওয়া চরিত্রের শংসাপত্র দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে চরিত্রের শংসাপত্র দিচ্ছে, সে যে ভারতীয় নাগরিক তা কীভাবে প্রমাণ হবে?

শর্ত ৩ : এছাড়াও আবেদনকারীকে একটা চিঠি দিয়ে বলতে হবে যে সে ভারতের অষ্টম শিডিউলে স্বীকৃত ভাষাগুলির যে কোনও একটিতে লিখতে ও পড়তে পারে। তার মানে যে লিখতে পড়তে পারে না, সে নাগরিকত্ব পাবে না।

নয়া বিধিতে শিডিউল IA, IB এবং IC সংযোজিত হয়েছে।

শর্ত ৪ : শিডিউল IA তে বলা আছে, আবেদনকারী যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের নাগরিক তা প্রমাণ করার জন্য সেই দেশের একটি সরকারি কাগজ দেখাতে হবে। তাতে সেই দেশের স্কুল সার্টিফিকেট, বা নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট, বা জন্ম শংসাপত্র, বা পাসপোর্ট, বা রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট, বা ভাড়ার কাগজ, বা কোনও লাইসেন্স, বা আগের তিন প্রজন্মের কারোর সেই দেশের নাগরিকত্বের শংসাপত্র ইত্যাদি হলে চলবে।

শর্ত ৫ : শিডিউল IB তে বলা আছে, আবেদনকারী যে ২০১৫ সালের আগে ভারতে ঢুকেছিল তার প্রমাণ দেখানোর জন্য ২০১৫ -র আগে তার নামে ভারতের কোনও একটা সরকারি কাগজ লাগবে। যেমন, রেশন কার্ড, বা ড্রাইভিং লাইসেন্স, বা আধার কার্ড, বা ভিসা, বা রেসিডেন্সিয়াল পারমিট, বা সেনসাসের স্লিপ, বা জমির কাগজ, বা ভাড়ার কাগজ, বা প্যান কার্ড, বা ব্যাঙ্কের কাগজ, বা পঞ্চায়েত/মিউনিসিপ্যালিটির কাগজ, বা বিমার কাগজ, বা ইলেক্ট্রিক বিল, বা শিক্ষাগত সার্টিফিকেট, বা বিয়ের কাগজ ইত্যাদি হলে চলবে।

শর্ত ৬ : শিডিউল IC অনুযায়ী, আবেদনকারীকে হলফনামা দিয়ে বলতে হবে, সে উক্ত দেশের (পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বা বাংলাদেশ) উক্ত সম্প্রদায়ের (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পার্সি, শিখ, বা জৈন) নাগরিক। এবং এখন সে ভারতে বাস করে এবং ওই সম্প্রদায়ের লোক হিসেবেই বাস করে। সে যে এখনও ওই সম্প্রদায়ের লোক তা প্রমাণ করার জন্য তাকে ওই সম্প্রদায়ের স্থানীয় কোনও একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান (locally reputed community institution) থেকে যোগ্যতার শংসাপত্র (Eligibility Certificate) জোগাড় করে হলফনামার সঙ্গে দিতে হবে। অর্থাৎ, কোনও মন্দির থেকে বা গুরুদোয়ারা থেকে বা গীর্জা থেকে ইত্যাদি। কিন্তু এই ভাবে ধর্মীয় শংসাপত্র কি হয়? তা কি সংবিধান সম্মত? এটা কি কোর্টে টিঁকবে? এটি একটি বিপজ্জনক শর্ত।

শর্ত ৭ : শিডিউল IC তে বলা আছে, আবেদনকারী পাসপোর্ট আইন এবং ফরেইনার্স আইনের ধারাগুলিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়, তা হলফনামায় লিখতে হবে। পাসপোর্ট আইনের ধারাগুলিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হওয়ার জন্য তাকে পড়শি দেশে ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত বা নিপীড়িত হতে পারেন বলে বলতে হয়। অর্থাৎ, প্রাকারান্তরে বলিয়ে নেওয়া হচ্ছে, যে আবেদনকারী পড়শি দেশে ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের শিকার। এই স্বীকারোক্তিও একটি বিপজ্জনক শর্ত, কারণ এটা যদি কখনও কেউ প্রমাণ করতে বলে, তবে তা প্রমাণ করা দুষ্কর।

শর্ত ৮ : শিডিউল IC অনুযায়ী, আবেদনকারীকে হলফনামায় বলতে হবে ঠিক কত তারিখে সে ভারতে ঢুকেছে। এটা নাগরিকত্বের শংসাপত্র, যেটি দেওয়া হবে, তাতেও থাকবে। নির্দিষ্ট করে এই তারিখ বলা বিপজ্জনক, কারণ কেউ যদি এই তারিখকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কোনও নথি জমা দেয় এবং তা যদি জোরালো নথি হয় তাহলে আবেদনকারী মিথ্যে বলছে বলে দেখানো যাবে। এটিও একটি বিপজ্জনক শর্ত

শর্ত ৯ : শিডিউল IC তে বলা আছে, যদি কোনও ভুল তথ্য দেওয়া হয় এই হলফনামায়, এমনকি যদি পরেও দেখা যায় যে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে (if it is found later that wrong information has been furnished) তাহলে প্রাথমিকভাবেই ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাবে (I shall be deprived of my Indian citizenship ab initio)। এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক শর্ত। এটা প্রমাণ করে, এই নাগরিকত্ব আসলে প্রভিশনাল বা আপাততঃ।

এছাড়াও ভুল তথ্যের মধ্যে ওই ধর্মীয় যোগ্যতার শংসাপত্র টিকেও ধরা হয়েছে। ফলে প্রাকারান্তরে বলে দেওয়া হচ্ছে, তাকে ভবিষ্যতেও ওই ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক অনুগামী থাকতেই হবে ভারতীয় নাগরিকত্ব টিঁকিয়ে রাখতে গেলে। ফলে এইভাবে যিনি নাগরিকত্ব পাচ্ছেন, তার কি ধর্মান্তরের অধিকার থাকছে?

শর্ত ১০ : আবেদনকারীকে আবেদনপত্রের সাথে বাবা বা মায়ের জন্ম সার্টিফিকেট বা পাসপোর্ট দিতে হবে। যদি তা না থাকে তাহলে নিজের জন্ম সার্টিফিকেট দিতে হবে যেটায় বাবা বা মায়ের নাম, ঠিকানা এবং জাতীয়তা স্পষ্ট লেখা থাকতে হবে। যদি আবেদনকারী বিবাহের কারণে এই দেশের নাগরিক হতে চান, তাহলে যার সঙ্গে বিবাহ হয়েছে তার জন্ম সার্টিফিকেট দিতে হবে।

এছাড়া আরেকটি বিপজ্জনক ব্যাপার হল, CAR 2024 এ কোথাও বলা নেই, আবেদনকারী আবেদন করার কতদিনের মধ্যে এই নাগরিকত্বের শংসাপত্র পাবেন, এবং ঐ মাঝের সময়টিতে তার অধিকার কতটা। এটা স্পষ্টই বোঝা যায়, আবেদন যখন করা হচ্ছে, তখন আবেদনকারী ঘোষণা করে দিচ্ছেন, তিনি বিদেশী নাগরিক। তাহলে, আবেদন করার পর থেকে নাগরিকত্বের শংসাপত্র পাওয়া পর্যন্ত তিনি কি এই দেশের নাগরিক হিসেবে তার অধিকারগুলি ভোগ করতে পারবেন?

এমনিতেই CAA 2019 এবং CAR 2024 দুটিই খুবই বিতর্কিত দুটি আইন এবং বিধি, কারণ এই দুটিতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হচ্ছে; যা আমাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে আদৌ সংবিধানসম্মত কি না তা ভাবার মতো। এখনও বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন।

এছাড়া ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত না হলে, অন্য কোনও কারণে পড়শি দেশে নিপীড়িত হয়ে এদেশে চলে এলে সে কেন এখানকার নাগরিকত্ব পাবার অধিকারী হবে না, সেই নৈতিক প্রশ্নও তোলা যায়। প্রশ্ন তোলা যায়, শুধু আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ কেন? পড়শি মায়ানমার থেকে গৃহযুদ্ধের কারণে বহু মানুষ প্রাণ বাঁচাতে এই দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে গত এক দশকে। তারা কেন এই দেশে নাগরিকত্ব পাবার অধিকারী হবে না?

কিন্তু সেসব নৈতিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রেক্ষিত বাদ দিলেও, যাদের কথা ভেবে এই আইন ও বিধি বানানো, আদৌ তারা উপকৃত হবে কি না এই বিধির বল-এ; নাকি ভোটের মুখে তাদের শান্ত করার জন্য তাদের জন্য নতুন কোনও বিপদ হাজির করানো হল — সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *