[পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতায় একটি বিখ্যাত সরকারি হাসপাতালের মহিলা ট্রেনি চিকিৎসকের রাত্রিবেলা মর্মান্তিক ধর্ষণ-হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভূতপূর্ব প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে গোটা রাজ্য, বিশেষতঃ মেয়েরা, যা ১৪ আগস্ট রাত-দখল কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে ভালোভাবে ভাষা পেয়েছে। তারপর বহু মানুষ ‘জাস্টিস ফর আরজিকর’-এর দাবিতে বহুভাবে গলা মিলিয়েছে যা অভূতপূর্ব। এই প্রসঙ্গে আমরা কয়েকটি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে এই আন্দোলন -এর মধ্যে ও বাইরে সংলাপ চালানোর চেষ্টা করব। এটা প্রথম কিস্তি। এটা প্রকাশ হচ্ছে আজ ২৭ আগস্ট। ফিচার ছবিটি ২৫ আগস্ট রাত-দখল অধিকার-দখল মিছিল থেকে অংশগ্রহণকারী কানিজ ফতিমার তোলা। ]
??=> আন্দোলনটা করছে প্রাথমিকভাবে ডাক্তাররা এবং সেটা তাদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানোর তাগিদ থেকে। কিন্তু বাস্তবতঃ ডাক্তাররা সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ অংশ, তাই নয় কি?
@@=> আন্দোলনটা প্রাথমিকভাবে ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীরা করেছে। যে ধর্ষিতা ও খুন হয়েছে, সে ট্রেনি ডাক্তার বা বলা যেতে পারে উঁচু ক্লাসের ডাক্তারি ছাত্রী। তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের মাথার কাছে ল্যাপটপ খোলা ছিল এবং সে ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটির পর ল্যাপটপ খুলে পড়তে বসেছিল। ফলে সে যতটা না স্বাধীন ডাক্তার, তার চেয়ে অনেক বেশি ডাক্তারি ছাত্রী। তাছাড়া, ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা, ফলে ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন মহিলাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার আন্দোলন তথা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার আন্দোলনও বটে। একথা ঠিক, এই আন্দোলনে বারবার ‘ডাক্তারদের নিরাপত্তা’ এবং ‘ডাক্তার খুন’ -এর প্রসঙ্গ আসছে। কিন্তু এই কথা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত অন্য যারা, নার্স, আয়া, হাসপাতাল পরিষ্কার রাখার কাজ যারা করে — তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েরা সংখ্যায় বেশি। ফলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রী ও কর্মীদের নিরাপত্তা এবং মহিলাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা-র বিষয় দু’টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত — একটি থেকে অন্যটিকে আলাদা করা যায় না।
আবার এটাও ঠিক, ডাক্তারি পড়ুয়াদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের সমান সমান হলেও পাশ করে প্র্যাক্টিস করা এবং কর্মরত ডাক্তারদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা বেশি। হাসপাতালগুলির (সরকারি ও বেসরকারি) প্রশাসনের মধ্যে পুরুষ ডাক্তারদের সংখ্যা নিরঙ্কুশভাবে বেশি। এই আরজিকর হাসপাতালেই প্রশাসনের আশি শতাংশ পুরুষ। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোনও হাসপাতালেই বিশাখা গাইডলাইন বা ২০১৩ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বিরোধী আইন (POSH 2013) মেনে কোনও বন্দোবস্ত নেই।
হাসপাতালে কর্মীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন আসলেই যেভাবে রোগীর পরিবারের থেকে নিরাপত্তার প্রশ্নকেই কেবল ভাবা হয়, আরজিকর-এর ঘটনা দেখিয়ে দেয়, নিরাপত্তা কেবল রোগীদের পরিবারের ক্ষুদ্ধ লোকজনের হাত থেকে নয়; বরং সহকর্মী এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশদের থেকেও। ফলে পুলিশ মোতায়েন করে, নিরাপত্তাকর্মীর বাড়াবাড়ি করে কর্মক্ষেত্রে মহিলা এবং প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
একথা ঠিক, পেশাজীবী এবং শ্রমজীবীদের মধ্যে ডাক্তাররা আপেক্ষিকভাবে সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ অংশগুলির মধ্যে পড়ে। তাছাড়া তাদের সামাজিক মর্যাদা থেকে শুরু করে রোজগার — এসব অনেক বেশি ও সুরক্ষিতও বটে। কিন্তু ডাক্তারি ছাত্ররা এসবের কোনওকিছুই পায় না, এবং তাদের বেশ ভালো পরিমাণ চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যেহেতু ডাক্তারি পড়াশুনা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা আধুনিক হয়েছে তা নিয়ে সংশয় আছে।
??=> একজন ডাক্তারি ছাত্রীর জন্য যেটা হল, চেষ্টা করলে কামদুনি বা উন্নাও বা হাথরসের ঘটনায় বা এই ধরনের আরো ঘটনায় কি এত বড়ো আন্দোলন তৈরি করা যেত না কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে ?
@@=> আগের কোনও ঘটনাতেই যে এতবড়ো আন্দোলন হয়নি সে তো আমরা দেখতেই পেয়েছি। কারণ সম্ভবতঃ এটা নয় যে ওই ঘটনাগুলি আরজিকর এর ঘটনার চেয়ে কম গুরুতর। কারণ, আরজিকর-এর ঘটনার পর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে বিশেষতঃ রাত-দখল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি ঘটনা বা ইভেন্ট। তা ‘আন্দোলন’-এর চেয়ে শুধু মাপে বড়ো তা-ই নয়। তা সম্পূর্ণ অন্য একটি ব্যাপার। সত্যিকারের ইভেন্ট বা ঘটনা কখনও তৈরি করা যায় না। ঘটনা ঘটে। ঘটনা কখনও পরিকল্পনা করা যায় না। কামদুনি, সোনি সোরি, মনোরমা, বা হাথরস কাণ্ডে কলকাতায় প্রতিবাদ কমবেশি হয়েছে। সেগুলি প্রতিবাদই। কোনওভাবেই সেগুলি রাত-দখল এর মতো ঘটনায় রূপান্তরিত হতে পারত না। অথবা পারত। কিন্তু সেটা ঘটত। ঘটানো যেত না। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ধর্ষণ হত্যার উপরিউক্ত ঘটনাগুলির যে প্রতিবাদ কলকাতা তথা বাংলায় হয়েছে এবং যৌন হেনস্থার যে প্রতিবাদ কলকাতায় আজ থেকে আট বছর আগে হয়েছিল (‘হোক কলরব’ আন্দোলন), সেগুলি আজকের এই রাত-দখল কে ঘটতে সাহায্য করেছে। সেগুলির মাধ্যমে মেয়েদের দিক থেকে সমাজকে দেখা, মেয়েদের দিক থেকে প্রতিবাদ ও সংগঠনের অভ্যেস তৈরি হয়েছে।
রাত-দখল এর মতো ঘটনা ঘটে, তাকে ঘটানো যায় না, তার পরিকল্পনা করা যায় না, এমনকি তাকে আগাম আন্দাজ-ও করা যায় না। এবারেও যারা রাত-দখল এর আহ্বান রেখেছিল, তারা নিজেরা ভাবেওনি যে এতবড়ো ঘটনা ঘটবে, সেটা তারা বারবার বলেছে। ঘটনা ঘটে গেলে ভাবার চেষ্টা করা যায়, কেন ঘটল। যেমন, আরজিকর কাণ্ডের পর এই ব্যাপক প্রতিবাদের ঘটনা দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করা যায়, কেন ঘটল। দু’টি ব্যাপারের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। প্রথমতঃ গত চার পাঁচ দশক ধরে আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত একটা স্বপ্ন লালন করেছে, মেয়ে পড়াশুনা করে ডাক্তার, অধ্যাপিকা, বিজ্ঞানী হবে। কারণ, এগুলিই মেয়েদের জন্য সমাজে সবচেয়ে উঁচু ও সম্মানজনক পেশা। একজন ট্রেনি ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা সেই স্বপ্নে ঘা দিয়েছে। তার ওপর এই ঘটনা ঘটেছে হাসপাতালের মধ্যে, যেটা তার কর্মক্ষেত্র এবং যেখানে সে সবচেয়ে সুরক্ষিত। হাসপাতাল নামক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের থাক-বিভাজনে সবচেয়ে উঁচুতে ডাক্তারদের স্থান। দ্বিতীয়তঃ, গত দশ বছরে আমাদের দেশে এবং রাজ্যে মেয়েরা অনেক বেশি রাস্তায় বেরোচ্ছে। মেয়েদের কলেজে ভর্তি হবার হার বাড়তে বাড়তে ছেলেদের সমান হয়ে গেছে। কাজে যোগ দিতে চাওয়া মেয়ের সংখ্যাও বেড়েছে, যদিও তা এখনও বেশ কম, পনেরো বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের মধ্যে এখন একশ’ জনে সাঁইত্রিশ জন কাজ খোঁজে, যা গত কয়েক বছরে অনেকটা বেড়েছে (সারা ভারত)। এখন শহরে তো বটেই, গ্রামেও অনুর্ধ চল্লিশ কলেজে পড়া মেয়েদের রাস্তাঘাটে দেখা যায় সন্ধ্যের অনেকটা পরেও। প্রত্যক্ষ ইভটিজিং অনেক কমে গেছে। মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরা অনেক বেড়েছে। সেই যাপনগত বাস্তবতার ওপর আঘাত হেনেছে আরজিকর-এর ঘটনা। প্রত্যেকেই নড়েচড়ে বসেছে। ক্ষুব্ধ হয়েছে। এর মধ্যে রাত-দখল আন্দোলনের ডাক অত্যন্ত যথাযথভাবে এই ক্ষোভ-এ ভাষা জুগিয়েছে। ফলে রাত-দখল এর মতো ঘটনা বা ইভেন্ট ঘটেছে।
আরেকটা ব্যাপারও গুরুত্বপূর্ণ। কোনও একটা আন্দোলন সফল হয় কেন? আন্দোলনের আহ্বানে মানুষ সারা দিলে তবে সেটা সফল হয়। ডাক যে বা যারা দিয়েছে, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, ডাক যে বা যারা গ্রহণ করেছে। যে কোনও আহ্বানের দু’টি দিক থাকে। আমরা ইতিহাসে কেবল কে আহ্বান জানিয়েছে সেটা পড়ি এবং তার সুখ্যাতি হয়। কিন্তু কোনও আহ্বানে কে দিয়েছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, কে নিয়েছে, কে সাড়া দিয়েছে। আন্দোলন ইভেন্ট বা ঘটনায় পর্যবসিত হয় ডাক দেওয়াতে নয়, সেই ডাক নেওয়াতে। গ্রহণ করা-তে।
??=> আচ্ছা, তাহলে এটা কি বাংলাদেশের মতো বিপ্লব বা জনঅভ্যুত্থান অথবা নিদেনপক্ষে ‘সরকার ফেলে দেওয়া’র দিকে নিয়ে যাওয়া যেত বা যায়?
@@=> বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ-র পরিস্থিতি এক নয়। তাছাড়া, বাংলাদেশ একটি ছোটো দেশ। আর পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষ নামক একটি বড়ো দেশের একটি অঙ্গরাজ্য। তাছাড়া এখানে আরজিকর -এর পরিপ্রেক্ষিতে যে আন্দোলন, তা বাংলাদেশের মতো তীব্রতায় পৌঁছয়নি। আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন প্রায় হয়ইনি বলা চলে, স্বয়ং প্রধান বিচারপতি সুয়ো মোতু (নিজে থেকেই) তা যাতে না হয় তার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বহু ছাত্র গুলি খেয়েছে পুলিশের। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কয়েকশ’ শহীদ হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মতো সরকার ফেলে দেওয়ার দিকে যাওয়ার কোনও বাস্তবতাই এখনও অবদি এই আন্দোলনের নেই।
তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, এই ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ন্যায্যতা কমছে, যা এই শতাব্দীর প্রথম দশকে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পরবর্তীতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়েছিল।
??=> সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেন হস্তক্ষেপ করতে গেল?
@@=> সুপ্রিম কোর্ট যেটা করেছে, সেটা আমাদের দেশের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা-র তিনটি স্তম্ভের একটি হিসেবে করেছে। দেখাই যাচ্ছিল, অন্য দুটি স্তম্ভ — যথাক্রমে নির্বাচিত সরকার এবং প্রশাসন — দু’টিই আরজিকর-এর ঘটনার পরবর্তীতে তাদের দায়সারা কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছিল। নির্বাচিত সরকার (পশ্চিমবঙ্গ সরকার) এই বিক্ষোভের পরিস্থিতি সামলাতে পারছিল না। বরং তাদের পদক্ষেপগুলি বিক্ষোভকে আরো বেশি তাতিয়ে দিচ্ছিল (যেমন, আরজিকর এর অধ্যক্ষকে বিক্ষোভের চাপে আরজিকর থেকে সরিয়ে আরেকটি সরকারি হাসপাতালে অধ্যক্ষ হিসেবে বহাল করা)। প্রশাসন-ও হয় গয়ংগচ্ছ ভাব দেখাচ্ছে (উদাহরন, আরজিকর-এর প্রধান বা অধ্যক্ষ-দের গ্রেফতার না করা, ধর্ষণ-হত্যার বদলে অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে পুলিশের ডায়েরি করা, তড়িঘড়ি পোস্ট মর্টেম করা, তড়িঘড়ি দেহ সৎকার করা, পোস্টমর্টেম-এর রিপোর্টে মৃতার যৌনাঙ্গে ‘চটচটে তরল’ পাওয়া গেছে উল্লেখ করলেও তা যে সিমেন তা উল্লেখ না করা ইত্যাদি)। এবং তদন্তটিতেও তেমন কোনও অগ্রগতি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে ক্ষোভ যখন বাড়ছে, সেই মুহুর্তে হস্তক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট নজির সৃষ্টি করল। মূল যে নির্দেশটা সে দিয়েছে, তা তিনটি স্তম্ভের বাকি দু’টির উদ্দেশ্যে, তা হল, এই আন্দোলন ক্ষোভ বিক্ষোভের ওপর বলপ্রয়োগ করা চলবে না। বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশে গণবিক্ষোভে বলপ্রয়োগের পর তা যেভাবে সেখানে গণঅভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের জায়গায় নিয়ে গেছিল, তার মতো কিছু তারা এখানে হতে দিতে রাজি নয়।
??=> কিন্তু, এই মর্মান্তিক ধর্ষণ-হত্যার ঘটনার পরবর্তীতে এই যে বিপুল জনজাগরণ, কীভাবে তা ফলপ্রসূ হতে পারে?
@@=> জনজাগরণ -এর মধ্যে দিয়ে শাসনব্যবস্থা বদল হয়, শাসক বদল হয় — এগুলো হয়। কিন্তু, শুধু এগুলো হয় না, জনজাগরণের মধ্যে দিয়ে আইন-কানুন-প্রথা এবং সমাজের অভ্যাস-ও বদলায়। যে কোনও জনআন্দোলন এবং জনবিক্ষোভ যে সে কী চায় তা সব সময় যথাযথভাবে জানান দিতে পারে, তা নয়। বলা কথা আর না-বলা কথার মধ্যে ফাঁক থাকে। বলা কথাগুলো অনেকসময়ই চালু কথার মতো করে বলা হয়। ফলে তার পেছনে না-বলা কথাগুলো যে কী, তা এমনকি বোঝাও যায় না। এমনকি এই সোসাল মিডিয়ার যুগে যখন প্রায় সবকিছুই কোথাও না কোথাও বলা হচ্ছে, তখনও নয়। তাছাড়া, আন্দোলন যা চায়, তাকে কেটেছেঁটে ছোটো করে এবং উল্টোভাবে উপস্থাপিত করে তবে তাকে কাইন-কানুনে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কারণ মানুষের স্পৃহা সবসময়ই ইতিবাচক। আর আইন-কানুন সবসময়ই নেতিবাচক। এই প্রাথমিক ধ্যানধারনার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা দেখি, এক্ষেত্রে কী সম্ভব।
এই জনজাগরণে একটা কথা মেয়েদের তরফ থেকে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, “আর একজন মেয়েও যেন ধর্ষিতা না হয়”। এটা এমন একটা স্পৃহা, যে আইন-কানুনে তাকে ভাষা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে সুপ্রিম কোর্ট এই স্পৃহার একটি আইনি উলটো বয়ান নির্মাণ করে শুনিয়েছে — ‘আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করার জন্য আর একটি ধর্ষণের ঘটনার জন্যও অপেক্ষা করলে চলবে না।’ আন্দোলনের তরফ থেকে সবচেয়ে বেশি যে স্লোগানটা শোনা যাচ্ছে, তা হল — “আমরা বিচার চাই”। অর্থাৎ, অপরাধীরা যেন ছাড় না পায়। যেন এই অপরাধের বিচার হয়। অপরাধীদের সনাক্তকরণের মধ্যে কিছু তথ্যমূলক ইতিবাচকতা থাকে। কিন্তু শাস্তির মধ্যে সেটা থাকে না। আইনের বাচনে যতই শাস্তিকে সংশোধনের উপায় হিসেবে দেখানো হোক, বাস্তবে শাস্তির মধ্যে সংশোধনের উপাদান খুবই কম থাকে।
কিন্তু বিচারের স্পৃহার মধ্যে অত্যাচারিতদের (অর্থাৎ, সেই অত্যাচারিত যদি মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তার নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে তাকে নিজের লোক বলে যারা মনে করে সবার) ভবিষ্যৎ সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত থাকে। এবং একইসাথে সমাজ যাতে অপরাধীমুক্ত থাকে তার স্পৃহাও থাকে। অপরাধীমুক্ত সমাজের সামাজিক বন্ধন জোরালো হয়। ফলে বিচারের স্পৃহার মধ্যে সমাজকে আরো খানিকটা উষ্ণ করার স্পৃহা থাকে, তার মধ্যে থাকে ব্যক্তিদের সমাজ গঠন বা সমাজ সংস্কারের স্পৃহা। ফলে “বিচার চাই”-এর দাবির মধ্যে যেমন ধর্ষক-এর ফাঁসি বা গুলি করে মারার দাবি উঠছে, যা আইন কানুন বিচারব্যবস্থার নেতিবাচকতার সঙ্গে মানানসই বা যাকে আইন কানুনে ভাষান্তর করা অত্যন্ত সহজ (মৃত্যুদন্ড, ফাস্ট-ট্র্যাক বিচার ইত্যাদি); কিন্তু তাতে ‘বিচার চাই’ -এর মধ্যেকার যে স্পৃহাগুলির কথা আমরা বললাম একটু আগে, সেগুলো খুব একটা নিশ্চিত হয় না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে এই ধরনের শাস্তির ফলে যে ধর্ষণ ও হত্যা কমে যায় তা নয়, বিশেষতঃ সেই সব সমাজে যেখানে কমবেশি এই নিয়ে আইনকানুন আছে এবং মেয়েদের একটা পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তা আছে। বরং কেবল ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হলে ধর্ষকদের মধ্যে ভিকটিমকে মেরে ফেলার প্রবণতা বাড়ে বলে অনেকের অভিমত।
২০১২ সালে দিল্লির মর্মান্তিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভার্মা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আমাদের দেশের যৌনহিংসা ও যৌননির্যাতনের আইন কানুনের বেশ কিছু বদল হয়। ধর্ষণ-হত্যার সাজা হয় মৃত্যুদন্ড ইত্যাদি। ২০০৪ সালে ধর্ষণ-হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ধনঞ্জয় -এর ফাঁসি হয় কলকাতাতে। ২০১৮ সালে হায়দ্রাবাদে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনায় চারজন অভিযুক্তকে আইনি বিচারের আগেই সাজানো এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু তাতে যে ধর্ষণ কমে গেছে তার কোনও প্রমাণ তথ্যাদিতে নেই। এই পরিস্থিতিতে ‘বিচার চাই’ -এর দাবিকে অবশ্যই মেয়েদের (এবং প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের) আরও বেশি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আঙ্গিকে দেখা দরকার।
আবার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিজেই একটি নেতিবাচক ব্যাপার। যেমন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু পদক্ষেপের কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রশাসনিকভাবে জানিয়েছে। যথা, মেয়েদের নাইট ডিউটি কম দেওয়া; রাতে পুলিশকে জানিয়ে বেরোনো; রাতে বেরোলে দল বেঁধে বেরোনো বা অন্য কাউকে জানিয়ে বেরোনো ইত্যাদি। এগুলো সবই নেতিবাচক এবং এতে মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরানো হয়। প্রথমটি যে নেতিবাচক তা প্রমাণ করার অপেক্ষা রাখে না। পুলিশকে জানিয়ে বেরোনো শুধু নেতিবাচক নয়, অপমানজনকও বটে। রাতে দল বেঁধে বেরোনো বা অন্য কাউকে জানিয়ে বেরোনোও কি নেতিবাচক নয়? ধরা যাক, একটা মেয়ে রাতে গোপনে অভিসারে বেরোচ্ছে, সে কি সেটা তৃতীয় ব্যক্তিকে জানিয়ে বেরোবে? কতটা সামাজিক অনিরাপত্তাকে মেনে নিলে এটা করার কথা বলা যায়? সে যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, এমনকি তার কাছেও সে তাহলে নিরাপদ নয়?
এই সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কের পরিস্থিতিতে কিছু সাজেশন আন্দোলনের মধ্যে থেকেই আসছে — তা হল, স্কুলের সিলেবাসে প্রতিটি ক্লাসে লিঙ্গ হিংসা থেকে শুরু করে মেয়েদের সাথে কীভাবে সম্মানজনক ব্যবহার করতে হয় তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া আরো কিছু সমাধানের কথা আসছে, সেগুলি সবই কাঠামোগত। যেমন, প্রতি এক কিমি অন্তর টয়লেট এবং তা দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খোলা রাখা। সারা রাত গণ পরিবহন চালু রাখা। সরকারি বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বিশাখা গাইডলাইন মেনে বন্দোবস্ত চালু করা (নিচের ছবি দ্রষ্টব্য)। এইগুলি তুলনায় অনেকটা ইতিবাচক বন্দোবস্ত। আইন বা কানুনের মতো নেতিবাচক নয়। যদিও আইন বা কানুনের মধ্যে দিয়েই এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাই এগুলির জন্য প্রশাসন ও সংসদ/বিধানসভা — এই দুয়েরই ভূমিকা নির্ধারক।
তবে সমাজের পিতৃতান্ত্রিক অভ্যেস বদলানোর জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়; তার জন্য লাগাতার মেয়েদের দিক থেকে দেখা, বিশ্লেষণ করা, মেয়েদের নেতৃত্বে সমাজরাজনৈতিক প্রচার আন্দোলন সংগঠন, ও সর্বোপরি উন্নয়ন ও ক্ষমতার সমস্ত ক্ষেত্রে মেয়েদের ছেলেদের সমান অংশীদারি বা সমতা ছাড়া সমাজের দীর্ঘলালিত পিতৃতান্ত্রিক অভ্যেস পরিবর্তন অসম্ভব। রাত-দখল একে সজোরে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে, সেই ধাক্কাকে ছোটো ছোটো ঢেউ-এর মতো করে সমাজের মধ্যে রেখে যাওয়ার কাজ সামনে।
(চলবে)

