আরজিকর জনজাগরণের প্রেক্ষাপটে নানা সংলাপ (২)

??=> আরজিকর-এ যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা একজন মহিলা ডাক্তারের কর্মরত অবস্থায় ধর্ষণ ও হত্যা। তার ন্যায়বিচার চাওয়া মানে তো অপরাধীদের ধরা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাওয়া। মেয়েদের রাত-দখল আন্দোলন কীভাবে আরজিকর-এর ঘটনার ন্যায়বিচার-এর সঙ্গে যুক্ত?

@@=> এই প্রশ্নের উত্তর মেয়েদের রাত-দখল আন্দোলনের গড়ে ওঠাকে পর্যবেক্ষণ করলেই পাওয়া যাবে। ৯ আগস্ট ঘটা ওই মর্মান্তিক ঘটনার দু’দিন পর আরজিকর হাসপাতালের সুপার সন্দীপ ঘোষ, যিনি হাসপাতালে ডাক্তারি ছাত্রদের মধ্যে কুখ্যাত তার স্বৈরাচার, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, এবং দুর্নীতির জন্য — তিনি বলেন, “রাতে সেমিনার রুমে একা থাকা মেয়েটির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়” (“It was irresponsible for the girl to be alone in the seminar room”). এই কথাতে কলকাতার নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মেয়েরা এবং পেশাগত কারণে (স্বাস্থ্যক্ষেত্র, সাংবাদিকতা, তথ্যপ্রযুক্তিশিল্প, বিনোদনশিল্প ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত) বা কলকাতার খোলামেলা সামাজিকতার কারণে ঘরের বাইরে বেরোনো মেয়েরা প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়। প্রথম হাতে লেখা পোস্টারে এর বিরোধিতা আসে আরজিকর হাসপাতালে আন্দোলনরত জুনিয়ার ডাক্তারদের মধ্যে থেকেই, যার ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক ও ব্যক্তিগত গণমাধ্যমগুলোতে (নিচের ছবি)

“১৪ আগস্ট স্বাধীনতার মধ্যরাতে নারী স্বাধীনতার জন্য মেয়েদের রাত দখল”-এর আহ্বানের (নিচের ছবি) মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যা এই ক্ষোভকে ভাষা দিয়েছিল। এই আওয়াজ জাস্টিসের আওয়াজের সঙ্গে মিলে গিয়ে ১৪ আগস্ট রাত জনতার রাত দখল -এ পরিণত হয়। শহর মফস্বল তো বটেই, তা ছাপিয়ে গ্রামেও এই রাত-দখল হয়। সোসাল মিডিয়া (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব) এবং ব্যক্তিগত মিডিয়া (হোয়াটস্যাপ) -র দৌলতে তা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বেশিরভাগ জায়গাতেই মেয়েরাই উদ্যোক্তা এবং সংগঠকের ভূমিকা পালন করে।

??=> ধর্ষণ জনিত কারণে যদি ধর্ষিতার মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের সাজা এনেছে রাজ্য সরকার, আরজিকর-এর ঘটনার পর বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন বসিয়ে ‘অপরাজিতা বিল’ পাশ করে। ঝটপট সাজা দেওয়ার কথাও আছে এই বিল-এ। সত্যিই তো আইন যদি কড়া না হয়, তাহলে জাস্টিস কীভাবে হবে?

@@=> ‘অপরাজিতা বিল’ -এর ধর্ষণ জনিত মৃত্যুতে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের যে সাজা আছে, তা ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধে, কারণ কোনও অপরাধের সাজা শুধু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না সংবিধান অনুযায়ী। দ্বিতীয়তঃ যে দ্রুততায় তদন্ত শেষ করা, বিচার শেষ করা, এবং সাজা কার্যকর করার কথা বলা আছে — তা জাস্টিসের মূল আদর্শেরই পরিপন্থী। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে দিল্লির ‘নির্ভয়া’ ঘটনা ও তার প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে ভার্মা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে যে আইন সংশোধন করা হয়েছিল, তাতেও দ্রুততায় তদন্ত শেষ করা, বিচার শেষ করা এবং সাজা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেই সংশোধিত আইন মেনে এক বছরের মধ্যে তদন্ত ও বিচার শেষ হয়, এবং অপরাধীদের ফাঁসি হয় দুই বছরের মধ্যে। কিন্তু তারপর যে ধর্ষণ কমেছে, তার কোনও প্রমাণ তথ্যাদিতে নেই। অর্থাৎ, ঝটপট তদন্ত বিচার ও সাজা প্রদানের মাধ্যমে ধর্ষণ যে কমে বলে মনে করা হয়, তার কোনও বাস্তব গ্রহণযোগ্যতা নেই।

তবে ঝটপট কড়া সাজা-র মধ্যে একটা প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধমূলক ব্যাপার আছে। প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ অনেকসময়ই জাস্টিস বা ন্যায়বিচারের সমার্থক, এবং নানা দেশের আইনব্যবস্থায় তার স্বীকৃতিও আছে। ন্যাচারাল জাস্টিস বা স্বাভাবিক ন্যায় এর মধ্যেও প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ-এর স্বীকৃতি আছে। কিন্তু প্রতিহিংসামূলক বা প্রতিশোধমূলক জাস্টিসের ধারনার সমালোচনাও আছে। সবচেয়ে বড়ো সমালোচনা আছে আমাদের দেশে মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতির মধ্যে। গত শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতিতে আমাদের দেশের রাজনীতির ভূমিকা বলতে গেলে এইটা অন্যতম।

এছাড়া, চটজলদি তদন্ত ও বিচারে অনেকসময়ই ভুল হয়ে যাবার সুযোগ আছে। এতে নির্দোষ কেউ সাজা পেয়ে যেতে পারে যা ন্যায়বিচারের দিক থেকে গর্হিত কাজ। কথাতেই আছে, “একজন দোষী ছাড়া পেয়ে যায় তো যাক, কিন্তু একজন নির্দোষ যেন সাজা না পায়।”

??=> বাহ, তাহলে তদন্ত, বিচার, সাজার প্রক্রিয়া যেমন চলছে তেমন চলবে? তাহলে আর জাস্টিস আন্দোলনের মানে কী? জাস্টিস নেই বলেই তো জাস্টিস চাওয়া হচ্ছে?

@@=> আধুনিক বিচারপ্রক্রিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দু’টি ধাপ হল দু’টি প্রাথমিক ধাপ। অপরাধ নথিভুক্তিকরণ বা এফআইআর দাখিল করা। এবং প্রাথমিক তদন্তে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও অপরাধীকে আটক করা। যদি এফআইআর দাখিল করা না হয়, তাহলে বিচারের পথে এক চুলও এগোনো হলো না। তখন রাষ্ট্র ন্যায়বিচারের প্রাথমিক দায়িত্বটুকুও অস্বীকার করল। নারী এবং ভিন্নলিঙ্গের মানুষদের ওপর হওয়া যৌন নির্যাতন এবং অন্যান্য নির্যাতন -এর ক্ষেত্রে ন্যুনতম এফআইআর দাখিল করানোই কষ্টকর হয়। থানা সহযোগিতা করে না। নারী আন্দোলন ও সংগঠনগুলি দশকের পর দশক ধরে চেষ্টা করেছে যাতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় থানায় এফআইআর করা যায়। তবুও এখনও তা লেখানো যথেষ্ট কষ্টকর।

উদাহরন স্বরূপ আমরা দুটি ঘটনার উল্লেখ করব — ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশে হাতরাসে একজন উনিশ বছর বয়সী মেয়ে গ্যাং-রেপ হয় এবং তার দু-সপ্তাহ পরে মারা যায়। মেয়েটি মারা যাবার আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী দিয়ে জানায় — তাকে চারজন রেপ করেছে এবং রেপ করার পর ওড়না গলায় পেঁচিয়ে মারার চেষ্টা করেছে। এই জবানবন্দী দেবার আগে পর্যন্ত পুলিশ যে অভিযোগ লিখেছিল, তাতে হত্যার চেষ্টা লেখা হয়েছিল, জবানবন্দীর পর গ্যাং-রেপ এর ধারা যোগ করা হয়। কিন্তু রেপ নথিভুক্ত না হওয়ায় রেপ-এর প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হয়নি। সিবিআই তদন্ত রিপোর্টে পুলিশের তুলোধনা করে এই প্রাথমিক প্রমাণ সংগ্রহ না করার জন্য। নিম্ন আদালতে রেপ প্রমাণিত হয় নি। অ্যাটেম্পট টু মার্ডার প্রমাণিত হয়েছে। ফলে চারজন অভিযুক্তের মধ্যে তিনজনের কোনও সাজা হয়নি। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। দ্বিতীয় উদাহরনটি আরজিকর এর ঘটনা। প্রথমে এটাকে আনন্যাচারল ডেথ বলে ডায়েরি করা হয়, এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে সুইসাইড বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়। নিহত-র বাবা-মা কে তিন ঘন্টা হাসপাতালে অপেক্ষা করানো হয়, বডি দেখতে দেওয়া হয়নি। বডি দেখে নিহত-র বাবা বলেন পিটিআই-কে, ধর্ষণ ও খুন হয়েছে। ততক্ষণে হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার ও ইন্টার্ন-রা ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সন্ধ্যেবেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পারমিশন নিয়ে বডি পোস্টমর্টেম করা হয়। সেই পোস্টমর্টেম করেছিল হাসপাতালের অধ্যক্ষের স্নেহধন্য একজন। এবং পোস্টমর্টেমে যৌনাঙ্গের ভেতরের অংশে যে চটচটে তরল পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তা সিমেন হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। তারপর বডি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িতে দু-ঘন্টা বডি রেখে বাবা-মা র স্বাক্ষর ছাড়াই দাহ করা হয় বডি। তারপর রেপ-মার্ডার এর এফআইআর করা হয়। ততক্ষণে বডি দাহ হয়ে গেছে, ফলে আরো কিছু প্রমাণ সংগ্রহের সুযোগ নেই।

এরকম ভুরি ভুরি উদাহরন আছে। যেখানে প্রাথমিক তদন্তের গাফিলতির জন্য যৌন নির্যাতন প্রমাণ করাই যায় না। ফলে যৌন নির্যাতনের যে সংখ্যক মামলা হয়, তার তুলনায় যৌন নির্যাতন সংখ্যায় অনেক বেশি। এছাড়া আমাদের দেশে বিবাহের মধ্যেকার ধর্ষণ-কে ধর্ষণ বলে স্বীকার করা হয় না আইনে। ফলে যৌন নির্যাতন ও যৌন হিংসা-র একটি মূল উৎস-কে আমরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না। ফলে জাস্টিসের এই প্রাথমিক পর্যায়, যেখানে যৌন হিংসা ও যৌন নির্যাতন নথিভুক্ত হবে এবং তার প্রাথমিক তদন্ত ঠিকঠাক ভাবে হবে — তার ব্যবস্থা করাই প্রাথমিক জাস্টিস — যার অভাব রয়েছে। এই প্রাথমিক নথিভুক্তিকরণ এবং প্রাথমিক তদন্তে যদি সংবেদনশীল মহিলা অফিসার না থাকে (যেমন, পার্ক স্ট্রীট কেস-এ দময়ন্তী সেন), তাহলে এই কাজটি হওয়া প্রায় অসম্ভব।

বিচারের ক্ষেত্রেও নিম্নতম আদালতের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেখানেই প্রাথমিক তদন্ত, প্রমাণাদি, চার্জশিট জমা পড়ে। নিম্ন আদালত যদি প্রমাণাদি সংগ্রহ ও তার সংরক্ষণের দিকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়, তাহলে মামলাটি আলগা হয়ে যায়। এই নিম্ন আদালত হল বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে দুর্বল অংশ। এখানে বিচারকদের মধ্যে মহিলাদের অনুপাত-ও সবচেয়ে কম। ফলে জাস্টিস-এর অভাব কাঠামোগত।

নিচে এই সময়েই ঘটে যাওয়া একটি উদাহরন রাত-দখল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীর বয়ানে :
“আজ (৫ সেপ্টেম্বর) সকালে প্রতিবাদীদের গ্রেফতারির খবর পেয়ে বারাসাত থানায় এসে পুলিশের চূড়ান্ত অপরাধ আর অপদার্থতা উইটনেস করলাম। ক্লাস টুয়েলভ্ -এ পড়া এক স্কুলছাত্রী মাথা ফাটা সর্বাঙ্গে ক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় থানায় আসে‌,সে বারাসাতের বাসিন্দা। তার বাবা এবং দাদু সারারাত তাকে লাঠিপেটা করেছে,তাই সে এফ-আই-আর করতে এসেছিল। পুলিশ তাকে দেখেই বলে ‘”তোকে আবার মেরেছে!” তারপর এফ আই আর নিতে অস্বীকার করে। পুলিশের মন্তব‍্যে স্পষ্ট যে তারা মেয়েটির সাথে চলা অত‍্যাচারের ব‍্যপারে ওয়াকিবহাল। তবুও এফ-আই-আর নেয় না,এবং মেয়েটির হাতে একটি ‘মুভ’ এর টিউব ধরিয়ে দিয়ে বলে “আগে হাসপাতালে যা”। আমাদের সঙ্গে থাকা দুজন মেয়ে তাকে বারাসাত জেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে‌। মেয়েটির বাবা এবং দাদু তাকে দীর্ঘকাল ধরে সেক্সুয়ালি অ্যাবিউজ্ করছে,এই অভিযোগে পুলিশ তাদের 3দিন লক আপে রেখেছিল। ছাড়া পেয়ে তারা বাড়িতে মেয়েটিকে অকথ‍্য মারধোর করে,তারপরেই আজ সকালে মেয়েটি থানায় আসে। এই অবস্থায় ভিক্টিমের চিকিৎসা করানো এবং অবিলম্বে এফ-আই-আর নিয়ে তদন্ত শুরু করতে পুলিশ বাধ‍্য। সেক্সুয়াল আর ফিজিক‍্যাল ভায়োলেন্সের ভিক্টিমের অভিযোগ না নেওয়ার জন‍্য প্রতিটি দেশের পুলিশের শাস্তি ধার্য আছে আইনত। এই রাত দখল আন্দোলনের অন‍্যতম লক্ষ‍্য যারা ভালনারেবল্ তাদের জাস্টিসের জন‍্য লড়াই করা। পুলিশ কেন তার স্বাভাবিক কর্তব‍্য করবে না? কেন একজন ভিক্টিমের চিকিৎসার ব‍্যবস্থা করবে না? কেন সাংঘাতিক ফিজিক‍্যালি উন্ডেড মেয়ের এফ-আই-আর তৎক্ষণাৎ নেওয়া হবে না? …

গতকাল সকালে বারাসাত থানার পুলিশ ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের (সেক্সুয়াল এবং ফিজিক‍্যাল) ভিক্টিম মেয়েটির এফ-আই-আর না নেওয়ার পর আমরা ঘটনাটা প্রচার করায় আর পুলিশকে চাপ দেওয়ায়, শেষ অবধি পুলিশ এফ-আই-আর নেয় ও মেয়েটির বাবাকে গ্রেফতার করে, হাসপাতালে মেয়েটির কাছে কনস্টেবল মোতায়েন করে। এবার পুলিশের ন‍্যক্কারজনক ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে –
১)ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের(সেক্সুয়াল বা ফিজিক‍্যাল বা দুটোই) ভিক্টিম মেয়েদের মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতেই তৎক্ষণাৎ এফ-আই-আর নিতে বাধ‍্য পুলিশ, নিতে অস্বীকার করা মানে কর্তব্য ডিনাই করা, যে কাজ করার জন‍্য তারা সাধারণ মানুষের টাকায় মাইনে পায়, সেই পুলিশদের আইনত শাস্তি হয় না কেন?
২) ফিজিক‍্যালি উন্ডেড ভিক্টিমের(কম অথবা বেশি) দ্রুত চিকিৎসার ব‍্যবস্থা করে ইনজুরি সার্টিফিকেট নেওয়া পুলিশের দায়িত্বের মধ‍্যে পড়ে, পুলিশ তা না করে ভিক্টিম এবং তার পরিবার/পরিচিতিদের ওপর এই দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় কেন?এটাও কর্তব‍্য ডিনাই করা, আইনত শাস্তিযোগ‍্য অপরাধ।
৩)মেয়েদের সাথে হওয়া ডোমেস্টিক এবং অন‍্যান‍্য ভায়োলেন্সের পর, ভিক্টিমের তৎক্ষণাৎ এবং লং টার্ম চিকিৎসার(শারীরিক ও মানসিক) দায়িত্ব স্টেট এবং তার মেশিনারি কেন নেবে না?
৪)পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টি কেন করতে হবে এফ-আই-আর নেওয়ার জন‍্য,যেটা তাদের জব ডেসক্রিপশনের মধ‍্যে পড়ে?
৫)ভায়োলেন্সের(সেক্সুয়াল,ফিজিক‍্যাল) শিকার মেয়েদের স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে পুলিশ দ্রুত তথ‍্যপ্রমাণ জোগাড়ের কাজ কেন শুরু করবে না?অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশের অপদার্থতার জন‍্য ধর্ষণ বা অন‍্যান‍্য ভায়োলেন্সের প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়,যার জন‍্য অনেক মেয়ে আদালতে প্রাপ‍্য বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এই অপদার্থতার শাস্তি সেই পুলিশ অফিসাররা কেন পায় না?
৬)প্রতিটি থানায় অন্তত ৪০% মহিলা পুলিশ পোস্টেড হয় না কেন? (গতকাল গ্রেফতার মেয়ে প্রতিবাদীদের স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিনের প্রয়োজন হলে তাদের পুরুষ পুলিশরা অশ্লীল কথা বলে,আমরা দিতে গেলে আমাদেরও গালিগালাজ করে)

??=> আন্দোলনে দেখতে পাচ্ছি দু’টি মূল স্বর আছে। একটা জুনিয়র ডাক্তারদের। তারা কর্মবিরতি চালাচ্ছে এবং আন্দোলন করছে। তাদের সংগঠন জুনিয়র ডাক্তার্স ফ্রন্ট। আরেকটা হল মেয়েরা। তাদের কোনও নির্দিষ্ট সংগঠন নেই। বহু ছোটো ছোটো সংগঠন, নাটকের গ্রুপ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত অল্পবয়সী মেয়েরা সোসাল মিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে যোগাযোগ করে নানা জায়গায় আন্দোলন সংগঠিত করছে। তাতে সাধারণ মেয়েরাও যোগ দিচ্ছে। এছাড়া আরেকটা স্বর আছে, সেটা একদম সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের, পুরুষ নারী নির্বিশেষে। তারা নিজেরাই নানাভাবে সংগঠিত হয়ে মিছিল করছে। সবার দাবি এক, কিন্তু সবাই মিলে একসাথে সংগঠিত হচ্ছে না কেন একটাই সংগঠন একটাই উদ্যোগে?

@@=> আন্দোলনে প্রথম দু-তিন দিন স্বর বলতে ছিল জুনিয়র ডাক্তার ও ছাত্রছাত্রীরা, বিশেষতঃ আরজিকর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার ও ছাত্রছাত্রীরা। তাদের সঙ্গে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি ইত্যাদি কলেজগুলির ছাত্রছাত্রীরাও প্রথম দু-তিন দিনের মধ্যেই মিছিল শুরু করে দিয়েছিল। রাত দখল-এর ডাক দেওয়ার সময় থেকে বিভিন্ন র‍্যাডিক্যাল লেফট ছাত্র সংগঠনের মেয়েরা নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হয়ে একটা মেয়েদের স্বর তৈরি করে। এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ওইটিই। যৌনহিংসার অবসানে লিঙ্গ সমতা ও মহিলা এবং ভিন্নলিঙ্গ মানুষদের নিরাপত্তার প্রশ্নটা আন্দোলনের সামনের সারিতে নিয়ে আসে তারাই। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন প্রথমে এটাকে ‘ডাক্তার হত্যা’ হিসেবেই তুলে ধরেছিল। অবশ্য ছাত্ররা যৌনহিংসা ও হত্যার প্রশ্নটা প্রথম থেকেই তুলছিল।

এখন প্রায় একমাস অতিবাহিত আন্দোলনের এবং ঘটনার। মেয়েদের আন্দোলনের তেমন কোনও সংগঠন নেই, এবং সংগঠকরাও চাকুরিরতা বা পড়াশুনা বা গবেষণায় যুক্ত। তার থেকে সময় বাঁচিয়ে তারা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। অপরপক্ষে টানা কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার ফলে জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনে পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া জুনিয়র ডাক্তাররা একটাই সংগঠনে সংগঠিত। এর মধ্যে তারা সম্মেলনও করেছেন মেডিক্যাল কলেজে। তাদের আন্দোলন অনেক বেশি সংগঠিত। তাদের সংগঠকও অনেক বেশি এবং গত একমাস ধরে তারা পূর্ণ সময়ের। ফলে আন্দোলনে মেয়েদের স্বর কমছে, এবং ডাক্তারদের স্বর অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে এই পর্যায়ে। উদাহরন স্বরূপ — মেয়েদের একটা বড়ো উদ্যোগ, যারা ১৪ আগস্ট রাত দখল এর আয়োজক ছিল, এবং পরে ‘রাত-দখল অধিকার-দখল’ হিসেবে একত্রিত হয়েছিল, তারা প্রথম দুই সপ্তাহে একাধিক মিছিল, এবং (৫ তারিখ শুনানির আগের দিন) ৪ সেপ্টেম্বর রাত দখলের উদ্যোগ নানা জায়গায় নিলেও (৯ তারিখ সুপ্রিম কোর্টে শুনানির আগের দিন) ৮ তারিখে তারা কোনও উদ্যোগের আহ্বান রাখেনি। অপরদিকে জুনিয়র ডাক্তারদের ফ্রন্ট পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের অপসারণ চেয়ে লালবাজার অভিযান, ২ তারিখ বেসরকারি হাসপাতালগুলির ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মানববন্ধন, ৪ সেপ্টেম্বর বাতি নেভানো, ৮ সেপ্টেম্বর আওয়াজ নেভানো থেকে শুরু করে অভয়া ক্লিনিকের পাশে গণ-আদালত বসানোর উদ্যোগ নিয়ে চলেছে। একইসাথে ডাক্তারদের জয়েন্ট ফোরাম ৮ তারিখে মহামিছিল করছে। জুনিয়র ডাক্তারদের উদ্যোগগুলিতেও প্রথমে যেভাবে মেয়েদের সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছিল, এখন পুরুষ ডাক্তাররা আস্তে আস্তে সামনের সারিতে চলে এসেছে। সংহতিমূলক মিছিলগুলিতেও প্রথমে যেভাবে মেয়েদের সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছিল, স্লোগান থেকে শুরু করে সবকিছুতে, এখন পুরুষরাই বেশিরভাগ এবং সামনের সারিতে। এছাড়া ‘অভয়ার ন্যায়বিচার’ এর দাবি সামনে থাকলেও জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারদের আন্দোলনের মূল জায়গা দাঁড়িয়েছে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে তৃণমূল নেতা ও প্রশাসনের মিলিত দুর্নীতি। অভিযোগ, ধর্ষিত ও মৃত ট্রেনি ডাক্তার আসলে এই ধরনের কোনও দুর্নীতির প্রতিবাদ করার কারণেই টার্গেট হন। ফলে দুর্নীতিরাজের অবসানই ‘অভয়া’র আসল জাস্টিস। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যৌনহিংসা ও লিঙ্গসমতার প্রশ্নটি আন্দোলনের পেছনের সারিতে চলে যাচ্ছে এবং দুর্নীতির প্রশ্নটি সামনে চলে আসছে। আন্দোলনের মূল যে দুটি স্বর, তার মধ্যে মেয়েদের স্বর দুর্বল হয়ে যাবার ফলে মেয়েদের এজেন্ডাটিও পেছনের সারিতে চলে যাচ্ছে।

দুটি স্বর একসাথে মিলে একটাই উদ্যোগ এর প্রয়াস হয়ত দুই দিক থেকেই কিছুটা আছে। যেমন, জুনিয়র ডকটরস ফ্রন্ট তাদের মেডিক্যাল কলেজের সম্মেলনে সিনেমা ব্যক্তিত্ব সোহিনী সরকারদের উদ্যোগ সমর্থন করেছিল, যা মেয়েদের উদ্যোগ এবং মেয়েদের এজেন্ডায়। অন্যদিকে মেয়েদের রাত-দখল অধিকার-দখল উদ্যোগ তাদের ৪ তারিখের রাত দখলের আহ্বানের পোস্টারে ডাক্তারদের সংহতি জানানোর আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু দু’টি উদ্যোগ একসাথে আসার কোনও বাস্তবতা এখনও অব্দি দেখা যাচ্ছে না। মেয়েদের আরেকটি উদ্যোগ ৮ তারিখে সমস্ত মানুষের জন্য কিছু সাংস্কৃতিক কর্মসূচির আহ্বান রেখেছিল। সেদিক থেকে দেখলে, এই আন্দোলন ১৪ আগস্ট ‘নারী স্বাধীনতার দাবিতে মেয়েদের রাত-দখল’ থেকে ৪ সেপ্টেম্বর রাতের ‘জনতার রাত-দখল’ পেরিয়ে ধীরে ধীরে ‘ডাক্তার এবং তাদের সংহতিমূলক’ আন্দোলন -এ পরিণত হবার দিকে যাচ্ছে। ১৪ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্দোলনের একটি ‘জনজাগরণের স্তর’ গেছে মূলতঃ মেয়েদের নেতৃত্বে। তারপর আন্দোলনটা আস্তে আস্তে ‘জুনিয়র ডাক্তার ও তাদের সংহতিমূলক গণ-আন্দোলন’ এর স্তরে চলে গেছে। তবে মেয়েদের এজেন্ডাগুলি এবং মেয়েদের নেতৃত্বে বিক্ষোভগুলিও ইতিউতি মাঝে মাঝেই দানা পাকিয়ে উঠছে। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *