“নতুন’ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তা চায় মানুষ’

প্রঃ এক দশক আগে শাহবাগে প্রজন্ম আন্দোলন দেখেছিলাম আমরা। রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছিল। হাসিনা সরকার “হেফাজতে ইসলাম” কে সমর্থন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ঘোর সমর্থক প্রজন্ম এক দশকে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অবসানে এককাট্টা হয়ে উঠল?

উঃ শাহবাগ আন্দোলন, কোটা, হেফাজত, এবারের আন্দোলন এগুলো একটা লেয়ারে বলা বেশ দুরূহ ব্যাপার এককথায়! যুদ্ধাপরাধের বিচার বাংলাদেশে খুব পপুলার দাবি ছিল সন্দেহ নেই। একটা রায় ‘পপুলার’ দাবির পক্ষে আসেনি বলে গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছিল, প্রথমত। আপাত সরল ও জনপ্রিয় সেই দাবির পক্ষে সরকার-ব্যাকড যে আন্দোলন হয়, সেটা ক্রমেই ফ্যাসিস্ট রূপ নেয়। এই আন্দোলনের যে ন্যারেটিভ, এর কাউন্টার ন্যারেটিভ ছিল হেফাজতের আন্দোলন। যা মে মাসের ৫ তারিখ, ২০১৩ চূড়ান্ত চেহারায় হাজির হয়। হাসিনা রাতের আঁধারে লাইট বন্ধ করে সেখানে তার পুলিশ লেলিয়ে দেয়। হত্যা করা হয় অনেক মাদ্রাসা ছাত্রকে। পরে ছলে-বলে-কৌশলে মাদ্রাসার একটা অংশকে হাসিনা সমর্থন দেন এবং পান, এগুলো আলাদা করে বলার ব্যাপার আসলে। আর হাসিনা হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন দেয়নি, যা কিছু দৃশ্যমান ও অদৃশ্য তার সবই একটা রাজনৈতিক গেমের পার্ট ছিল। আমি বরং জুলাই বা আগস্ট যে নামেই বলেন, বর্তমানের এই আন্দোলন নিয়ে কিছু বলি। 

দেখেন, এইখানে এবারের সমস্যাটা ভিন্ন। মুক্তিযোদ্ধা বা যুদ্ধের সাথে কোটার সমস্যাটার এক করাটা সমস্যাজনক। এখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ পার্সেন্ট ছিল। যেটা অত্যন্ত অন্যায্য। মোট কোটা ছিল ৫৬ শতাংশ। ছাত্ররা তো ১০ শতাংশ করার দাবি জানয়েছিল। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এটার শুরু। যার পরিপ্রেক্ষিতে তখন হাসিনা রীতিমতো রাগ করে কোটা বন্ধ করে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। কিন্তু ২০২১ সালে এই পরিপত্র বাতিল চেয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা রিট দায়ের করে। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে ওই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ব  বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। পরে গত ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়। এই রায়ের ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ায় আর বাধা থাকল না। এই কথাগুলো আমি খবরের কাগজ থেকে বললাম। 

এবার ৫ জুনের পর থেকে মূলত আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এই রায় বাতিল চেয়ে পরের দিন কর্মসূচি দেওয়া হয়। এইটা নিয়ে আন্দোলনের এবারেরটা কিন্তু সেকেন্ড ওয়েভ। যে ওয়েভে হাসিনার ভাগতে হইছে। ৫-৬ জুলাই নানা রাস্তা অবরোধ, ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেড; ৮ জুলাই রেল ও সড়কপথ বন্ধ করা, সমন্বয়ক ঠিক করা;  ১০ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ, শুনানির জন্য ৭ আগস্ট দিন রাখা হয়। এর মধ্যে আওয়ামীলীগের নেতারা অনবরত হুংকার-হুমকি দিতে থাকে। ওবায়দুল কাদের (আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক) তার সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্রলীগ লেলিয়ে দিয়ে শায়েস্তা করার হুমকি দেয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্ররা লিমিট ক্রস করছে বলে মন্তব্য করে। ১৪ তারিখ হাসিনা তার সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। তারা রাজাকার, এমন বলেন। এর পরই আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। যে পদ্ধতিতে ‘অপর’ করতে চাইছিলেন হাসিনা, সেটা ছাত্ররা উল্টা প্রয়োগ করে। যা বুমেরাং হয় তার জন্য, ছাত্ররা বলে, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’।  ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ আগ্রাসী হয়ে ওঠে। আহত ২৯৭ জন শুধু ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেন। পরের দিন ঘটে রক্তাক্ত ঘটনা, রংপুরে আবু সাঈদসহ সারা দেশে অন্তত ৬ জন মারা যান। আপনারা সবাই দেখেছেন সাঈদকে কেমন করে গুলি করা হয়েছে। অবিশ্বাস্য সেই দৃশ্য! 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করা হয় ১৭ জুলাই। পরের দিন হাসিনার হুকুমে আরও ৩০ জনের মতো ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়। পুলিশের সঙ্গে মোতায়েন করা হয় বিজিবি, র‍্যাব ও সোয়াট। ১৯ তারিখ ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এ সারা দেশে ৬০ জনের মতো মানুষকে হাসিনা হত্যা করে। ২০ জুলাই আর্মি নামানো হয়।  সব মিলিয়ে আগের চার দিনে নিহত হন ১৪৮ (প্রথম আলোর ভাষ্য)। আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আট দফা দাবি পেশ করা হয় এই দিন। এর মধ্যে ইন্টারনেট বন্ধ করা, সমন্বয়কদের তুলে নেওয়া, নির্যাতন করা ইত্যাদি চলতে থাকে। মৃতের সংখ্যাও প্রায় ২০০ ছোঁয়। ২৩ তারিখ কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কিন্তু এর মধ্যে বহু ঘটনা ঘটে গেছে। 

নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর ডিবি, পরে ছয়জনকে নিয়ে বন্দী অবস্থায় বিবৃতি দেওয়ায়! জামাত নিষিদ্ধের মতো রাজনৈতিক চাল দেয়, যেটাও কাজ করে নাই আসলে।  

চলে গণগ্রেপ্তার। কয়েক হাজার গ্রেপ্তার করা হয়। ৩১ জুলাই এদিন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়। সারা দেশে ‘ছাত্র-জনতা হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলার প্রতিবাদে ও জাতিসংঘের অধীনে ঘটনার তদন্ত করে বিচার এবং ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। ১ আগস্ট ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি নেওয়া হয়। প্রতিদিনই সংঘর্ষ হয়। ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ হয় ২ তারিখ। ৩ তারিখ  ‘বিক্ষোভ মিছিল’ হয়, বিকেলে শহীদ মিনারে লাখো লোকের জমায়েত হয়। 

৪ আগস্ট সরকার পতনের ‘একদফা’ দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। কর্মসূচির প্রথম দিন সারা দেশে জীবন হারান কমপক্ষে ১০৪ জন। আহত হন কয়েক হাজার। সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় আদালতের কার্যক্রম। 

৫ তারিখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লং মার্চ কর্মসূচি পালিত হয়। কারফিউয়ের ঘোঘণা থাকায় সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে বাড়তে থাকে গণমানুষের জমায়েত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ রাজপথগুলো গণজোয়ারে পরিণত হয়। এরই মধ্যে আন্দোলনকারীদের ওপর বিভিন্ন জায়গায় নির্বিচারে গুলি করা হয়। এ দিনও প্রায় ১০০ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। দুপুরে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান। রাজপথে শুরু হয় বিজয় উল্লাস। 

(ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারগুলো খবরের কাগজের সূত্র থেকে বলা, কিছু অংশ সরাসরি তুলে দেওয়া)। 

কথাগুলো লম্বা করেই বলা হলো বুঝতে যেন সুবিধা হয়। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিজম কায়েমে যে কয়েকটি চাবি ব্যবহার করেছে, মুক্তিযুদ্ধ তার প্রধান। যেন কেউ আওয়ামী ফ্যাসিবাদরে সমর্থক না হলেই সে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ, সে রাজাকার। এভাবেই ‘ট্যাগ’  দিয়ে মানুষকে অপর করার খেলায় মেতেছিল তারা। ফল হয়েছে প্রচণ্ড অজনপ্রিয়তা, শেষ পর্যন্ত হাসিনার পলায়ন।

প্রঃ কোভিডের আগে আমরা দেখেছিলাম বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই ভালো অবস্থায়, অন্তত সূচকগুলি সেইরকম ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু কোভিডের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি সেভাবে চেগে উঠল না কেন?

উঃ দেখুন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের মন্দ অবস্থা কিন্তু রাজনৈতিক। 

বাংলাদেশে অনাদায়ী ঋণ খুবই বেশি। এ ঋণ বেশিরভাগ আওয়ামীলীগের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। এদের একটা অংশ আছে যারা ঋণ নেয় না দেওয়ার জন্য। আর এটাই তাদের কালচার। 

এখানে কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। হাসিনা বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের লুটপাটের অর্থনীতি চালু করছেন। যেমন ধরুন, উন্নয়নের যে মহাবয়ান আওয়ামী লীগ চালু করছে, এইটা পেছনেও মহাডাকাতির গল্প কিন্তু আছে। প্রতিটা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় তিন চার থেকে শুরু করে কখনো দেড় শ’ গুণ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। একটা নমুনা দিই, যে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নিয়ে মানুষে বহু আপত্তি, যার ঋণ দেওয়ার সময় হয়ে আসছে, সেই কেন্দ্রের একেকটা বালিশ কেনা হয় প্রায় ৬০০০ টাকা করে, তখন যার দাম কোনোভাবেই ৩০০ টাকার বেশি ছিল না, ডাইনিং টেবিলের দাম দেখানো হয় ১১ লাখ টাকার বেশি। নমুনা হিসাবে বললাম। পদ্মা সেতু আমাদের দেশের মানুষের কাছে বেশ প্রিয় প্রকল্প ছিল, আওয়ামীলীগের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, সেখানে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা অবিশ্বস্য! ১১ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে বলে এইটা শুরু করে, যখন শেষ করে তখন ব্যয় বাড়াতে বাড়াতে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়! মেট্রোরেলের ক্ষেত্রেও একই কথা, কর্ণফুলি টানেল মোটের ওপর এখনই নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে, অনেকেই অপ্রজনীয় উচ্চাভিলাষ হিসেবে দেখছেন। এই মেগা প্রকল্প মেগা দুর্দশা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব তো পাবলিকের টাকায় করা হয়েছে। আওয়ামীলীগ এসবের ভেতর দিয়ে নিজেদের পকেট ভরেছে আর ভেঙেছে দেশের আর্থিক অবস্থা। 

বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এই তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এইটা অনেকের মতে ১৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। ভাবা যায়! বাংলাদেশের বাজেট হয় ৭ লাখ কোটি টাকার, সেই হিসাবে কমবেশি তিন বছরের বাজেটের সমান! 

বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ প্রবাসী! তাদের টাকাটা বড় আয়, আর গার্মেন্টস। কোভিডের সময় সূচক হিসেবে আপনি বললেও আমি ঠিক কোভিড দিয়ে বিষয়টা দেখি না। এখানে রিজার্ভ বড় দেখানো, ডেটা টেম্পার করা, ব্যাংকে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা টাকার হিসাব তারা এক করে দেখাতো। ঋণ নিতে গিয়ে আইএমএফের হস্তক্ষেপে হিসাবের নয়ছয় বন্ধ হয়েছে, ফলে আর্থিক খাতের খারাপ অবস্থাতাটা দৃশ্যমান হয়েছে।

আরেকটা ব্যপার হলো, ব্যাংক করে বা ব্যাংক দখল করে ঋণ নিয়ে ব্যাংক ‘খেয়ে দেওয়া’। হাসিনার বিশ্বস্ত এস আলম যার প্রধান হোতা, ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত ছয়টি ব্যাংক ওরা জাস্ট খেয়ে দিছে! 

রাজস্ব, মুদ্রা নীতি, ব্যাংক খাত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই দুর্বলতা ছিল প্রকট। 

প্রঃ কাগজে পড়লাম, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৮ লক্ষ কোটি টাকা। এই ঋণ কি স্বাভাবিক? কীভাবে এই বিপুল ঋণ তৈরি হল?

উঃ ১৮ লক্ষ কোটি টাকার মতো বড় ঋণের কারণ মূল কারণ আসলে ওই সুশাসনের অভাবই। যারা অর্থনীতির মানুষ তারা নানান হিসাব দিয়ে হয়তো বোঝাবেন। আসলে সমস্যাটা রাজনৈতিক। ফ্যাসিবাদের যে অর্থনীতি, সেখানে ‘উন্নয়নের ফুটানি’ ছিল প্রবল। সেখানে তারা দৃশ্যমান হয় এমন কাজ করতে চেয়েছে—যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এলেভেটেড এক্সপ্রেস কিংবা টানেল। এগুলো করতে গিয়ে এমনিতেই প্রচুর খরচ হয়েছে, সেইটা আবার নিজের পকেটে ভরার বাসনা থেকে খরচ বাড়িয়ে নিয়েছে দুই থেকে দশ কুড়ি বা শত গুণ। বালিশ-কাণ্ডের নমুনা থেকে আপনারা বুঝবেন। এই ঋণ কোনোভাবেই স্বাভাবিক না।  এ ছাড়া ব্যাংক তছরুপের কথাও বললাম। 

হাসিনা যখন ক্ষমতায় এল অর্থাৎ ২০০৯ সালে ঋণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, আর উনি যখন পালালেন তখন ঋণ ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। মানে ৮৫ শতাংশের মতো ঋণ বাড়িয়েছেন তিনি! আর আপনারা দেখেন এই সময়ে অর্থ পাচার হইছে অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। শুধু পাচারের হিসাব এটা। অন্য হিসাব ধরেন, তাহলেই বুঝবেন, সমস্যাটা কোথায়!

প্রঃ বাংলাদেশে এখন যতটা ভারতবিরোধী মনোভাব সোসাল মিডিয়ায় দেখি, আগে কখনও এতটা দেখিনি। এর কারণ কী?

উঃ একটা বা দুইটা কারণ আসলে না। অনেকগুলো কারণ এখানে ক্রিয়া করছে। এর প্রধান দুইটা কারণ হলো, ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী আচরণ এবং বাংলাদেশের স্বৈরাচারকে সুবিধা নেওয়ার স্বার্থে সব রকম শেলটার দেওয়া। তা ছাড়া দুই দেশের যে সম্পর্ক, তা সাধারণ বাইল্যাটেরাল সম্পর্কের মতো না। বাংলাদেশের নাগরিকদের নানান সন্দেহের কারণ স্বাভাবিক। ট্রানজিট, করিডোরসহ নানান চুক্তিতে বাংলাদেশ ঠকেছে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা মনে করে, এতে স্বার্বভৌমত্ব পর্যন্ত হুমকিতে পড়েছে। 

সাধারণ একটা কথাই ধরেন, বাংলাদেশ ভারত থেকে পেঁয়াজ কেনে। অন্য দেশ থেকেও কেনে, কিন্তু ভারত থেকে যখন কেনে, বলা হয় ভারত পিঁয়াজ দিয়েছে! টাকায় কেনা জিনিস ভারত থেকে কিনলে ‘দেওয়া’ হয়ে যায়, এই ধরনের বাজে ব্যাপার আছে।

গত দুই তিন ভুয়া নির্বাচনে নির্বাচনে ভারত রাষ্ট্র হাসিনা সরকারকে সব রকমের সহায়তা করেছে। বৈশ্বিক পরিসরে লেজিটিমেট করতে সহায়তা করেছে। এর বিনিময়ে হাসিনা দেশের কথা চিন্তা না করেই দিল্লির ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছে। ফলে হাসিনা আর ভারত রাষ্ট্রের অজপ্রিয়তা একটা সমান্তরাল রেখায় এগিয়েছে। 

ফেলানিকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অনবরত মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের আসেন। তার আসার প্রতিবাদ হয় বাংলাদেশে। তখন হাসিনার পুলিশ বাহিনী গুলি করে অনেক মানুষ হত্যা করে। 

ফারাক্কা চুক্তি থেকে শুরু করে তিস্তার পানি নিয়ে সমস্যা—এসব জিইয়ে রাখাই শুধু হয়নি, দিনকে দিন বড় করা হয়েছে। বড় করা হয়েছে বলেই দেখুন সাম্প্রতিক বন্যার পুরো দায় বাংলাদেশের মানুষের একটা অংশ ভারতকে দিয়েছে! 

আরেকটা কথা অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ হবে, সেটি ধর্মীয়। ভারতে হিন্দু-মৌলবাদী আরএসএস-বিজেপির সরকার ভারতে মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার, হুমকি, হামলা ইত্যাদি করেছে, এর একটা বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। এবং এই দিকেও যে উল্টা চিত্র একেবারে নাই, তা কিন্তু না। গত ২০ সেপ্টেম্বর অমিত শাহের মতো বড় নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় বলল, বাংলাদেশিদের সীমান্তে ঝুলিয়ে রাখা হবে। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আপনার স্মৃতিতে ফেলানির ঝুলে থাকা লাশ ফিরে আসবে। এই অবস্থায় আপনি কী করবেন? 

এসবের প্রভাব তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পড়ে। এই সব, এমন আরও অনেক কিছু, এবং আরও অনেক কিছু মিলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। 

এর মধ্যে আমরা যারা মনে করি, ভারতের নির্যাতিত জনগণ আমাদের বন্ধু, ভারতের একই মানসিকতার যে বন্ধুরা আছেন, আমরা মিলে কিন্তু প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হয়ে উঠতে পারিনি, যেটা হওয়া খুবই দরকার। এটার দায়ও কিন্তু আছে।

 প্রঃ বাংলাদেশে বস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের কিছু লড়াই এর খবর আমরা শুনেছি। বর্তমান ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে গাজীপুরের শ্রমিকদের ভূমিকা কী ছিল?

উঃ গাজীপুরের শ্রমিক শুধু না, ঢাকার চারপাশের শ্রমিকেরাই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, সারা দেশের শ্রমিকেরাই যুক্ত হয়েছেন। আন্দোলন শ্রমিকদের যোগদানের ভেতর দিয়েই একটা সর্বাত্মক চেহারা পেয়েছে। তাঁদের অনেকেই আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন। আমাদের এক শ্রমিক নেতা বন্ধুর বরাতে জেনেছি, গাজীপুরের বোর্ড বাজারে, গুটিয়া, টঙ্গী,  চন্দনা চৌরাস্তা, গাজীপুর চৌরাস্তা ইত্যাদি স্থানে শুধু ২০ জুলাইতেই শহীদ হয়েছেন সাতজন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২৬ পোশাককর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। তাঁদের মধ্যে সাভারের আশুলিয়ায় ৬ জন, গাজীপুরে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকার বাড্ডা, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ১৪ জন নিহত হয়েছেন।

প্রঃ ছাত্র-আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে যখন অনেক দফা দাবি ছিল, সেই পর্যায় থেকে কীভাবে দেড় দু সপ্তাহের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানে বদলে গেল তার একটা বিবরণ যদি দেওয়া যায়…

উঃ এই প্রশ্নের উত্তর আমি শুরুতেই দিলাম। 

প্রঃ যারা শহীদ হলেন, তাদের সংখ্যা আনুমানিক কত?

উঃ আন্দোলনের মাস পার হয়ে গেল। শহীদের সংখ্যা নিয়ে শুরু থেকেই কথা হচ্ছিল। হাসিনা সরকার স্বাভাবিক কারণেই অনেক রাখঢাক করেছে। গোপন করেছে। এখন গিয়ে সব পরিষ্কার হচ্ছে। তারপরও আমার মনে হয় না সংখ্যাটা সম্পূর্ণ উঠে আসবে। শহীদ, আহত, স্থায়ী অঙ্গহানি, স্থায়ীভাবে দৃষ্টি হারানো মানুষের সংখ্যা দুঃখজনকভাবে অনেক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির প্রাথমিক তালিকায় শহীদের সংখ্যা ১৪২৩ জন। আহত ২২ হাজারের মতো, স্থায়ীভাবে অঙ্গহানি হয়েছে ৫৮৭; চোখে আঘাত পেয়েছেন ৬৮৫ জন, এর মধ্যে ৯২ জন স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়েছেন! 

প্রঃ নতুন বাংলাদেশে কোন ধরনের রাজনীতি এবং অর্থনীতি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন প্রত্যাশা করে?

উঃ এই প্রশ্নটার জবাব মনে হয় এমন কারও দেওয়া উচিৎ যিনি সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন। আমার নিজের স্টেক কম বা আমি ছাত্রও না, এখন সরকারের কেউও না। এগুলো নিয়ে সমন্বয়কেরা বা যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, এখনো জেলায় জেলায় যাচ্ছেন, তারা অনেক কথা বলছেন। আমি আমার প্রত্যাশা বরং বলতে পারি। ধারণা করি, এই প্রত্যাশা বেশিরভাগ মানুষেরই। সেটা হলো বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তা। প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করানো। সংবিধানসহ রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক জায়গাগুলোতে গণতান্ত্রিক ধরনের সংস্কার করা। সামনে যেন হাসিনার মতো ভয়াবহ কিছুর মোকাবিলা না করতে হয়, ফ্যাসিজমের জন্ম না হয়, তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কারের ভেতর দিয়ে নিশ্চিত করা। আদালতকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া, প্রেসকে প্রেসের মতো কাজ করতে দেওয়া। সামগ্রিক একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ। যেটা নিশ্চিত হলে আর্থিক অনেক ব্যাপার এমনিতেই সমাধান হয়ে যায়। আশা করি, আগামীতে বাংলাদেশকে আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে অনেক এগোনো দেখতে পাওয়া যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *