কোবাডের স্মৃতিচারনায় আফজল গুরুর শেষ তিন বছর

মাওবাদী নেতা কোবাড গান্ধীর স্মৃতিচারনায় আফজল গুরুর শেষ তিন বছরের কথা। তিহার জেল-এ। চার বছর আগে ৯ ফেব্রুয়ারি আফজলের ফাঁসি হয়। সংসদ হামলায় অভিযুক্ত ও পরে দণ্ডিত হয় আফজল। সে ছিল আত্মসমর্পন করে গৃহী জীবনে ফেরত আসা কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী। এই বয়ান যে চিঠির অংশ সেই চিঠিটি কোবাড গান্ধী এক সাংবাদিককে পাঠান ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ শমীক সরকার। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।

ওটা ছিল ২০০৯ এর ২১ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যে সাতটার সময় আমি প্রথমবারের জন্য ঢুকলাম কোনো ভারতীয় জেল-এ — তিহার জেল। দু-দফা অপমানজনক তল্লাশির পর আমি ঢুকলাম উচ্চঝুঁকির ৩ নম্বর জেল ওয়ার্ডে। কয়েদিদের নিজেদের খুপড়িতে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল। দুটো ব্লক, এ ব্লকের এক নম্বর খুপড়ির দরজায় দেখলাম আফজল গুরুকে। চওড়া হাসিতে অভ্যর্থনা করল আমায় – “আসুন আসুন। আপনাকে এখানেই আশা করেছিলাম”।

বলল, আমি কাগজ জুড়ে তোমার কথা পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম সকালবেলায়, দ্যাখা হবে। যাই হোক, আমাকে ৪ নম্বর খুপরিতে নিয়ে গিয়ে আরো তিনজনের সঙ্গে রাখা হলো, যাদের একজন দিল্লির বিখ্যাত ডন, কিসান পেহলওয়ান।

পরদিন সকালে আমাকে দুই খালিস্তানির সঙ্গে ৮ নম্বর খুপড়িতে বদলি করে দেওয়া হল। যে খালিস্তানিটি মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ছিল, ভুল্লার, সে ছিল ২ নম্বর খুপরিতে। ওইদিন সকালে আমি চা খেলাম আফজলের সাথে। এই অভ্যেস বজায় ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ আফজল ফাঁসিতে লটকানো পর্যন্ত। আফজল তিহার জেলের জোলো চার ফ্লাস্কে গুঁড়ো দুধ আর ক্যান্টিন থেকে কেনা চা-থলি মিশিয়ে সুন্দর স্বাদ তৈরি করত। তারপর থেকে তিন বছর আমরা এটাই খেয়েছি, সাথে জেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া দু-পিস রুটি। তারপর ওয়ার্ডের লাগোয়া মাঠে একটু হাঁটা। রোজকার অভ্যেস ছিল। এই মাঠটায় সেই মাঠ, যার পাশেই ‘ফাঁসি কোঠি’, যেখানে আফজলকে পরে ফাঁসি ও কবর দেওয়া হয়।

এই বছরগুলোতে আমি আফজলকে দেখেছি, অত্যন্ত মানবিক, উষ্ণ হৃদয়ের এক সরল লোক। একজন মানুষ, যে গভীরভাবে ভালোবাসে তার মা, তার স্কুল শিক্ষক স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্রকে। রাখির দিন বন্দীদের বাড়ির মেয়েদের জেল-এ ঢুকতে দেওয়া হত, ওরা আসত নিয়ম করে। আফজলের হাত খরচা লাগত মাসে মাত্র ১০০০ টাকা, ওর স্ত্রী তার সামান্য উপার্জন থেকে পাঠাত।

আফজল গুরুকে মিডিয়া প্রতিপন্ন করেছে, একজন মৌলবাদী উন্মাদ হিসেবে। বাস্তবে সে ঠিক তার উলটো। কোনো সন্দেহ নেই, সে ইসলামের প্রবল বিশ্বাসী ছিল, দিনে ৫ বার নামাজ পড়ত, রোজা ইত্যাদি রাখত। জান্নাত এ তার খুব বিশ্বাস ছিল, তাই তো সে সাহস করে মাথা উঁচিয়ে ফাঁসির মঞ্চে উঠতে পেরেছিল।

আফজল ইসলামের সুফি ঐতিহ্যে বিশ্বাসী ছিল, যাতে জোর দেওয়া হয় মানবতা, প্রেম আর সমতায়। সে রুমি আর ইকবালের ভক্ত ছিল খুব। তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ঊর্দুতে রুমির পুরো ৬ খণ্ড। সকালে চা খাওয়ার সময় সে রুমির চমৎকার সব পয়ারগুলো অনুবাদ করে শোনাত আমাকে। আফজলের মাধ্যমে আমি ইসলামের অনেক মানবিক দিকের খোঁজ পেয়েছি, যে ইসলামকে মৌলবাদী ও গোঁয়াররা কী কুতসিত চেহারা দিয়েছে।

আফজল কেবল মৌলবাদীদের নিরপরাধ লোককে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মেরে ফেলার চরম বিরোধী ছিল না, সে পাকিস্তানি সংস্থা / আই এস আই কেও পছন্দ করত না। সে মাঝে মাঝেই বলত, আই এস আই এমনকি র’ এর চেয়েও খারাপ। ওরা আজাদির পক্ষে কিন্তু কাশ্মীরের পাকিস্তানের সাথে জুড়ে যাওয়ার পক্ষপাতী নয় এরকম অনেক ইন্টেলেকচুয়ালকে মেরে ফেলেছে। বিশেষ করে ১৯৯০ সালে জেকেএলএফ এর উত্থানের পর, যারা কখনোই পাক-পন্থী ছিল না। আফজল বলত, ভারত সরকারের পাশাপাশি আই এস আই এর হাতেও বহু মানুষ মারা গেছে। সে আমাকে কাশ্মীরিদের জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিল, কীভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে আর্মি এবং কেন কাশ্মীর উপত্যকা একটা খোলা জেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কাশ্মীরিদের জীবনের সঙ্গে খুব প্যালেস্তাইনের তুলনা করত। সে বলত, পাকিস্তান কীভাবে কাশ্মীরিদের লড়াইকে ব্যবহার করছে তার ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে। ভারত-পাক দ্বন্দ্বের বলির বখরা কাশ্মীর। এতে কাশ্মীরীদের লড়াইয়ে লাভের তুলনায় ক্ষতি বেশি।

আফজলের কমিউনিজমের প্রতি খুব ভক্তি ছিল, যা মোটেই মৌলবাদীসুলভ নয়। সে এমনকি ইকবালকে টেনে বলত, কমিউনিজম + ঈশ্বর = ইসলাম। আফজল খুব পড়াশোনা করা লোক ছিল এবং ঊর্দু ও হিন্দিতে সমান দখল। পশ্চিমের নোয়াম চমস্কি এবং অন্যান্য প্রগতিশীলদের লেখকদের লেখাও তার পড়া ছিল। সে গজল ভালোবাসত। জেল কর্তৃপক্ষের তাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিলনা। যদিও শুরুর দিকে সে খুব অপমানিত হত।

আফজলের ফাঁসির দুদিন আগে আমাদের তাড়াহুড়ো করে বি ব্লকে চলে যেতে বলা হলো, এবং সেখানকার কয়েদিদের অন্যত্র সরানো হলো। বলা হলো, সাদা রঙ করা হবে। কিন্তু আমরা বি ব্লকে যেতেই ফাঁসি কোঠি ও সংলগ্ন মাঠের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো যাতে সেখানে কী হচ্ছে আমরা না দেখতে পাই। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম চরম কিছু হচ্ছে ওখানে। নানা গুজব ছড়াতে লাগল জেলকর্মীরা, কে নাকি বিদেশী প্রতিনিধিদল আসবে, ভুল্লার (যে কিনা এর মধ্যে মানসিক হাসপাতালে ট্রান্সফার হয়ে গেছে) কে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। ইত্যাদি।

আফজল বলত, যদি কাউকে ঝোলায় তো সে ভুল্লার নয়, সে নিজে। সেই সন্ধ্যেয় সবাই ভীত সন্ত্রস্ত, কেবল আফজল বরাবরের মতো উচ্ছ্বল।

পরদিন সকালে জেলকর্মীরা এলো আধঘন্টা দেরিতে, ছটায়। যখন তারা আফজলের কুঠুরি ১ নম্বরটা খুলল, তখন সেটার কয়েদীরা বলল, যদি তল্লাশি নিতে চায়, তাহলে একটু পরে, তারা নামাজ পড়বে প্রথমে। কিন্তু আফজলকে বের করে নিয়ে বাকিদের রেখে দেওয়া হলো কুঠুরিতে বন্ধ করেই। এইবার বোজা গেল, আফজলও বুঝল, কী হতে চলেছে।

তাকে নিয়ে গেল এ ব্লকে তার আসল কুঠুরিতে। সেখানে ল অফিসার তার সঙ্গে দেখা করে জানাল, সকাল আটটায় হবে ফাঁসি। আফজল পরিবার এবং ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইল, দেওয়া হলো না। সবাই জানে, সে সময় কংগ্রেস সরকার কোনো নিয়ম মানেনি। আফজল নামাজ পড়ল, চা-বিস্কুট খেতে দেওয়া হলো তাকে; স্নান করল। তারপর শেষ নামাজ পড়ল।

আটটা বাজতে পাঁচ মিনিটে তাকে সেই মাঠটার মধ্যে দিয়েই নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে আমরা রোজ হাঁটতাম। সে সব জেলকর্মীদের মঙ্গলকামনা করল। জেল কর্তৃপক্ষকে বলল তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে। আমরা পরে জেনেছিলাম, বেশিরভাগ স্টাফই কেঁদে ফেলেছিল। তারপর সে মাথা উঁচু করে চলে গেল ফাঁসির মঞ্চে। জেল কর্তৃপক্ষ সরকারের অঙ্গুলিনির্দেশে আফজলের জামা কাপড়, ডায়েরি, এমনকি দেহটাকেই দিলনা তার পরিবারকে। তাকে কবর দেওয়া হলো জেলের মধ্যে, আরেক কাশ্মীরি নেতা মকবুল ভাটের কবরের দু ফুট দূরে। পরিহাসের কথা, মকবুল ভাটও মনে হয় পাক-পন্থী ছিল না, কারণ তার বইগুলো নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।

………

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *