ফিল্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থা : তদন্ত রিপোর্ট চেপে দিয়ে আভ্যন্তরীন অভিযোগ কমিটিটাই তুলে দিলো প্রতিষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদন, ২৬ মার্চ ২০১৭@

প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি যৌন হেনস্থার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসি বা আভ্যন্তরীন অভিযোগ কমিটির তৈরি করা তদন্ত রিপোর্ট-এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ডাকা গভর্নিং কাউন্সিল মিটিং-এ খোদ আইসিসি টাকেই তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় সরকারি ফিল্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে!! ঘটনাটিকে সমর্থন করে অভিযোগকারীদের “দিকভ্রষ্ট খামখেয়ালী মেয়ে” অভিধা দিলেন প্রতিষ্ঠানটির অধিকর্তা স্বয়ং!
কলকাতার একটি নামী কেন্দ্রীয় সরকারি ফিল্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের 8 জন ছাত্রী ২০১৫ সালের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠানের তিনজন প্রফেসরের বিরুদ্ধে ধর্ষণ সহ যৌন হেনস্থার একাধিক  অভিযোগ করে। দীর্ঘ টাল বাহানার শেষে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় দুমাস পর একটি আইসিসি (অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি) তৈরি করে। ২০১৬ র এপ্রিল মাস নাগাদ আইসিসি ৩ জনের অভিযোগের একটি তদন্ত-রিপোর্ট দেয়।  তিনজন প্রফেসর দোষী সাব্যস্ত হয় ও আইসিসির নির্দেশ অনুযায়ী তাদের বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ করানো হয়। গোটা সময় জুড়ে অভিযোগকারীদের ওপর চলতে থাকে নানা ধরণের অত্যাচার ও হেনস্থা। বছর দেড়েক আগে অভিযোগকারীদের পক্ষ থেকে লেখা একটি চিঠির বাংলা করে সংবাদমন্থনের পেজ এ দেওয়া হয়েছিলো। নীচে তার লিঙ্ক দেওয়া হল। এই চিঠিটি থেকে বোঝা যাবে কীধরণের অত্যাচার অভিযোগকারীদের ওপর হয়েছিলো সেই সময়। http://songbadmanthan.com/sexual-harrasment-and-ragging-in-srfti/

এখানে ওই চিঠির একটি অংশ দেওয়া হলো :

————————————————————–

“ডিসেম্বর ২০১৫ তে আমরা  … যখন ক্যাম্পাসে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলাম আমরা ভাবতেই পারিনি আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে! অভিযোগ করার দিন থেকে  আমাকে  ক্যাম্পাসের মধ্যে আলাদা ও একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। আমার একটি অভিযোগ আমার কোনো  অনুমতি না নিয়ে ও আই সি সি কে না জানিয়ে কর্তৃপক্ষ পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।  অভিযোগের দিন থেকে……  আমরা সবচাইতে অমানবিক হেনস্থা ও হুমকির শিকার। ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশ্যে মদ খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ার পর ক্ষিপ্ত  জনতার হতাশার শিকার হই আমি।

https://www.youtube.com/watch?v=Evjl-KAvq-A

এই ভিডিওটিতে দেখা যাবে আমার হোস্টেলের রুমের সামনে সকাল ৬ টার সময় কি করা হচ্ছে। …. এখানে আমাকে ‘যাকে শুনা দেনা আপ্নে বেহান কা লাউড়ি কো’ কথাটা আমার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, যখন আমি সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম। এদের মধ্যে তিনজনকে  হোস্টেল থেকে সাময়িকভাবে  বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমি যখন এই চিঠিটা লিখছি তখনো তারা আমার কয়েক মিটার দূরে হোস্টেলের একটি  ঘরে বসে মদ খাচ্ছে। তিন চারদিন আগে এই এদেরই  এক বন্ধু, যার ক্যাম্পাসে মহিলা পেটানোর ‘সুখ্যাতি’ আছে, সে  ক্যাম্পাসের বাইরে, পাঁচিলের গায়ে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘বেহান কি লাউড়ি’, ……… ‘ওয়াট আ ফাক’ বলেছিলো আমাকে, আরো বলেছিলো ‘আমি ক্যাম্পাসের বাইরে আছি, তুমি কিছু করতে পারবে না ‘। যখন আমি ডিরেক্টর আর  চেয়ারপার্সন কে এই ঘটনাটা  জানিয়ে অভিযোগ করতে যাই , চেয়ার পার্সন আমাকে জানান যে, ‘তালি এক হাত সে নাহি বাজতা’।”

————————————————-

দোষীরা হাইকোর্টে যান। হাইকোর্টে অভিযুক্ত বনাম প্রতিষ্ঠান মামলা শুরু হয়।  ২০১৫-র শেষের দিকে যে অভিযোগগুলি হয়েছিলো তার মধ্যে একটি অভিযোগের তদন্ত চালাচ্ছিলো আইসিসি। এই নির্দিষ্ট অভিযোগটিতে ধর্ষণ ছাড়াও আরো নানা ধরণের যৌন হেনস্থার কথা ছিলো একজন প্রফেসরের বিরুদ্ধে। পুরো অভেযোগটি ইংরাজীতে এই লিঙ্কে গেলে পাওয়া যাবে https://docs.google.com/…/17Zz-vyStfLUuS6KpY-Z2YeYfF5…/edit…

২রা মার্চ, ২০১৭ ধর্ষণ বাদ দিয়ে অন্যান্য যৌন হেনস্থার অভিযোগের  তদন্ত-রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিলো আইসিসির। ধর্ষণের অভিযোগটি অভিযোগকারীর কোনো অনুমতি  ছাড়াই পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটি। ২রা মার্চের তদন্ত-রিপোর্টে কী আছে, তা অভিযোগকারী জানতে পারেনি, কারণ সেটি অভিযোগকারীর হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। অন্য কোনোভাবে প্রকাশও করা হয়নি।

২০১৭ র ১০ই মার্চ প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং কাউন্সিলের মিটিং-এ ২রা মার্চের তদন্ত-রিপোর্টের ওপর দাঁড়িয়ে অভিযোগ ও অভিযুক্ত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল। এই গভর্নিং কাউন্সিলের মিটিং-এ  সভাপতিত্ব করছিলেন আমালা আক্কিকেন্নি ও মধুর ভান্ডারকার। সেই গভর্নিং কমিটির মিটিং-এ আইসিসি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় এই আই সি সি নাকি ‘পুরুষ-প্রফেসর বিরোধিতার’ দিকে ঝোঁকা!! আই সি সি র আহ্বায়ককেও সরিয়ে দেওয়া হয়। একটি আই সি সি র আয়ু তিন বছর, অর্থাৎ এই আইসিসির ২০১৮ অব্দি কাজ করে যাওয়ার কথা ছিলো। মাত্র এক বছরের একটু বেশী সময়ের মধ্যেই সেটিকে তুলে দেওয়া হলো কেন?  এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে জানানো হয়নি। উপরন্তু ২রা মার্চের তদন্ত-রিপোর্টে কী ছিলো তাও প্রকাশ্যে আনা হয়নি।

ফলে বর্তমানে গোটা ব্যাপারটা একটা জটিল চেহারা নিয়েছে — আইসিসি বা ‘আভ্যন্তরীন অভিযোগ কমিটি’  ফিল্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নিজের তৈরি।  প্রতিষ্ঠানটি সেই আই সি সি-র রায় কে সমর্থন করছে হাইকোর্টে। আবার প্রতিষ্ঠানটি সেই আই সি সি-কেই তুলে দিয়েছে!! আশ্চর্য!! যদিও দোষীদের ওপর শাস্তি বহাল থাকছে।

গোটা ঘটনাটা জানিয়ে ও আইসিসি তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে অভিযোগকারীদের পক্ষ থেকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ‘মৈত্রী’ ( নারী-অধিকার আন্দোলোনের সংগঠন ও কর্মীদের একটি সাধারণ মঞ্চ)-র পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটি-র ডিরেক্টরকে চিঠি দেওয়া হয়, আচমকা এই আইসিসি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে।  উত্তরে প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর, যিনি নিজে একজন মহিলা, যে চিঠিটি দেন ‘মৈত্রী’কে, তার কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলঃ

“এটা সবাইকে মানতে হবে যে  … একজন মহিলা হিসেবে আমি আমার ছাত্রীদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে সমানভাবে চিন্তিত। … আমার সবসময় মনে হয়, সমস্ত ধরণের হেনস্থা থেকে একজন ছাত্রীর নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি একজন ছাত্রীকেও বুঝতে হবে যে আইনের অভিসন্ধিমূলক অপব্যবহার কোনোভাবেই অনুমতিসাপেক্ষ নয় বা সহ্য করা হবে না। কিছু দিকভ্রষ্ট খামখেয়ালী মেয়ের, গোটা নারী সমাজকে অসম্মান করার অসাধু প্রচেষ্টার মুখে দাঁড়িয়ে আমরা দার্শনিক নির্বিকারত্ব রক্ষা করার বিলাসিতা করতে পারি না। এরকম অনেক নিদর্শন আছে যেখানে নাগরিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি আইনের অপব্যবহার হয়েছে। আইপিসি-র সেকশন ৪৯৮এ ও আরটিআই এইরকম অপব্যবহারের কিছু উদাহরন।

 দয়া করে নিশ্চিত থাকুন, নতুন আইসিসি গঠনের যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। আপনাদের এটা বিশ্বাস করতে অনুরোধ করব যে, যে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন আমার নেতৃত্বে চলছে তা  এমন কিছু করতে পারে না বা করবে না যা আইনবিরুদ্ধ অথবা আমার প্রিয় ছাত্রীদের, যারা প্রকৃত অর্থেই যৌন হেনস্থার শিকার, তাদের বিচারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অস্বীকার করা হবে। যাই হোক, যেখানে অন্য কোনো সমস্যার সমাধান হিসেবে কোনো মহিলার দ্বারা আইনের সুযোগের অপব্যবহারের কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া হবে আমি সেখানেও শক্ত থাকব।”

এমনিতেই অভিযোগকারীদের ওপর চলছে বিভিন্নধরণের অত্যাচার, হেনস্থা। চলছে অভিভাবকদের অপদস্থ করা। শেষ বছরে প্রোজেক্ট শেষ করতে গিয়ে নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে অভিযোগকারীদের। তার উপরে আইসিসি তুলে দেওয়া ও তার কারণ দেখিয়ে ডিরেক্টরের এই চিঠি!  একজন ডিরেক্টর হিসেবে অভিযোগকারী ও তার অভিযোগ সম্পর্কে এই ধরণের শব্দচয়ন তীব্রভাবে নিন্দার যোগ্য, এমনটাই মত নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মীদের।

২রা মার্চ-এর রিপোর্ট অভিযোগকারীকে কেন দেখনো হল না ? কেন তুলে দেওয়া হল আইসিসি? তবে কি এইভাবে আইসিসি তুলে দেওয়া সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? ভারত তথা গোটা বিশ্বের এক বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালকের নামাঙ্কিত একটি নামী কেন্দ্রীয় সরকারী ফিল্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইধরনের ঘটনা সেই প্রতিষ্ঠানের দৈন্যকেই কি তুলে ধরেনা ? প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোতেই কি তবে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে? তবে কি ঘুঘুর বাসায় পরিণত হয়েছে এই গর্বের প্রতিষ্ঠানটি?

এসব প্রশ্ন উঠছে সঙ্গত কারণেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *