‘প্রশান্ত দন’ : কসাক সম্প্রদায়ের কষ্টিপাথরে সোভিয়েত বিপ্লব (২)

শমীক সরকার

[সোভিয়েত বিপ্লবের শতবর্ষে ‘মনন’ পত্রিকার (সম্পাদক মতিলাল দেবনাথ) বিশেষ সংখ্যার জন্য আমার কাছ থেকে একটি লেখা চাওয়া হয়েছিল, চেয়েছিলেন এই বিশেষ সংখ্যাটির দায়িত্বে থাকা অমিত-দা। তারপর অমিত-দার সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। শেষমেশ একটা জাম্বো লেখা — ‘প্রশান্ত দন’ উপন্যাসটির পর্যালোচনা। মনন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এটা, ২০১৭-র জানুয়ারিতে। এখানে সেই লেখার দ্বিতীয় ও শেষ অংশ। — শমীক সরকার।

উপন্যাসটির পিডিএফ লিঙ্ক এখানে : প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় খণ্ড তৃতীয় খণ্ড চতুর্থ খণ্ড]

————————–

 

৭) বর্তমানের ইতিহাস
প্রশান্ত দন লেখা শুরু হয়েছিল ১৯২৫ সালে। ১৯২১-২২ সালে সবে শেষ হয়েছে গৃহযুদ্ধ। বিদ্রোহী উপাদান তখনও শেষ হয়ে যায়নি, যখন উপন্যাসটি লেখা চলছে। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, শোলখভ প্রথমে লিখতে শুরু করেছিলেন কর্নিলভের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির থেকে, অর্থাৎ ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মের থেকে। পরে তিনি মনস্থ করেন, যদি কসাকদের জীবন নিয়ে না লেখা যায়, যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কসাকদের অংশগ্রহণ নিয়ে না লেখা যায়, তাহলে পাঠক কিছুই বুঝবে না। তারপর উপন্যাসের কেন্দ্র হয় তাতারস্কি গ্রাম। উপন্যাসের শুরু হয় ১৯১২ সাল। অর্থাৎ, উপন্যাসটি লেখার কথা ভাবার সময়ই লেখকের মূল উৎসাহ ছিল রাশিয়ার বিপ্লব এবং কসাক বিদ্রোহ-র একটি কালানুপঞ্জী রচনার। অর্থাৎ বর্তমানের ইতিহাস লেখার। উপন্যাসে যে সমস্ত চরিত্র এসেছে, তাদের মধ্যে বেশ কিছু যেমন কাল্পনিক, তেমনি কিছু বাস্তব চরিত্র। যেমন পদতিওলকভ, কর্নিলভ, কালেদিন, ফোমিন ইত্যাদি। আর ঘটনাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই বাস্তব।
তাই এই উপন্যাস একইসাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দন-কসাকদের অংশগ্রহণ, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা, কর্নিলভের অভ্যুত্থানের চেষ্টা এবং সর্বোপরি কসাক-বিদ্রোহের (গৃহযুদ্ধ) ডকুমেন্টেশনও বটে। এখানে মূলতঃ কসাক বিদ্রোহের ইতিহাস উপন্যাস থেকে নিয়ে সংকলিত করা হলো —
ক) মহাযুদ্ধ শুরু, কসাকদের যোগদান
খ) মহাযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে রাশিয়া জুড়ে ইহুদী বিদ্বেষ, ইহুদীদের ব্যবসা লুঠ, হত্যা এবং ব্যবসায়ী-জাত ইহুদীদের পাশে বস্তুত কোনো শক্তিরই না দাঁড়ানো।
গ) গ্রামে এবং ফ্রন্টে কসাক ও অন্যান্যদের মধ্যে বলশেভিকদের সংগঠন ও মতাদর্শের বিস্তার — প্রথমে অবিশ্বাসের ঠান্ডা ইস্পাতে ধাক্কা খেলেও কর্মীরা পিছু না হটে কীভাবে দাঁত ফুটিয়ে দিয়েছিল, ফ্রন্ট ভেঙে কসাকদের ফিরে আসা, জারের পতন, কর্ণিলভের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা ও ব্যর্থতা, সোভিয়েত বিপ্লব
ঘ) ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মহাযুদ্ধ ফিরতি কসাকদের সভা কামেনস্কায়ায়, কসাক ফৌজি বিপ্লবী কমিটি গঠন, দনের ছেচল্লিশটি কসাক রেজিমেন্ট-এর তাতে যোগদান, লেনিন-এর বিল্পবী কসাক সরকার গঠনের ঘোষণা
ঙ) ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে সেত্রাকভ গ্রামে লাল ফৌজের গ্রামবাসী কসাকদের বাড়ি লুঠপাট ও মেয়েদের গায়ে হাত, আশপাশের গ্রামের কসাকদের রাতারাতি যুদ্ধসাজ, আচম্বিত হামলায় লাল ফৌজ বাহিনীকে খতম, কসাক-বিদ্রোহের বার্তা, সোভিয়েত রাজ হটিয়ে দিয়ে আতামান নির্ভর পুরনো শাসন কাঠামোয় সাময়িক দন সরকার গঠন, দনের উজান এলাকার বারোটা জেলা ও একটা ইউক্রেনীয় বিভাগ নিয়ে দনেৎস প্রদেশ ভেঙে নতুন স্বাধীন প্রদেশ গঠন।
চ) একদিকে ইউক্রেন থেকে আগুয়ান জার্মান হানাদার বাহিনী, অন্যদিকে দনের উজানের কিছু জেলা ও ভাটি এলাকা থেকে কসাক বিদ্রোহের চাপ, মাঝখানে বিল্পবী কসাকদের ‘দন গণকমিসার পরিষদ’-এর দনের উত্তরে খোপিওর ও উস্ত-মেদভেদিৎসা প্রদেশে (যেখানে তখনও কসাক-বিপ্লবের আগুন জ্বলছে) সৈন্য সংগ্রহের লক্ষ্যে অভিযান, বিদ্রোহের তেজ আন্দাজ করতে ব্যর্থতা, পদযাত্রা করে অভিযানের ভ্রান্তি ও পথশ্রমের ক্লান্তি, দনেৎস প্রদেশের একদম ভেতরে ঢুকে পড়া, ফাঁদে পা দেওয়া, বন্দী হওয়া, বিদ্রোহীদের আদালতে রক্ষণশীল কসাকদের হাতে বিচার, পুরো অভিযাত্রীদল এবং পদতিওলকভ সহ পুরো নেতৃত্ব খতম এবং পরিষদ ধ্বংস।
ছ) দনের ভাটির পুরোটা এবং উজানের অনেকটা অংশ থেকে লাল ফৌজের পশ্চাদপসরণ, ১৯১৮ সালের ২৮ এপ্রিল — ৩ মে নোভোচেরকাসস্ক-এ ‘দন মুক্তি পরিষদ’ নামে ফৌজি কাউন্সিলের বৈঠক, তাতে সাময়িক দন সরকার এবং ফৌজি ইউনিটগুলোর প্রতিনিধিদের সমাবেশ, নতুন স্বাধীন দন সরকার গঠন, ক্রাসনোভের নেতৃত্বে ‘সার্বভৌম ফৌজি পরিষদে’র হাতে শাসন — “বিপ্লবের ফলে মুক্ত কসাকজাতি কসাক জীবনের অপূর্ব প্রাচীন ধারা সম্পূর্ণ ফিরিয়ে আনবে, আর আমরাও তখন আমাদের সেকালের বাপ-ঠাকুর্দাদের মতো বুক ফুলিয়ে গলা উঁচিয়ে বলতে পারব : ‘মস্কোর কেল্লায় সাদা জার পাকাপোক্ত হয়ে থাকুন আর আমরা কসাকরা থাকি এই প্রশান্ত দনে!'”
জ) বিপ্লবী কসাকদের লাল ফৌজে যোগদান, দন-এ মিরোনভের লাল কসাক ফৌজ বনাম বলশেভিক বিরোধী বিভিন্ন শ্বেতরক্ষী বাহিনীর তুল্যমূল্য লড়াই — দন সরকার, আলেক্সেয়েভের নেতৃত্বে শ্বেতরক্ষী গেরিলা, দন-আর্মি, স্বেচ্ছাসেনাবাহিনী বা ক্যাডেট — ধীরে ধীরে এই নবগঠিত সৈন্যবাহিনীতে পুরনো জমানার সেনাবাহিনীর ওপরতলার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা
ঝ) ১৯১৮ র মে মাসের শেষের দিকে বৈঠকে দন ফৌজ তথা দন সরকারের নেতা ক্রাসনোভের জার্মানদের সঙ্গে হাত মেলানোতে রাশিয়ান স্বেচ্ছাসেনাবাহিনীর নেতা দেনিকিন-এর আপত্তি, শত্রুতা, এবং জুলাই মাসে ক্রাসনোভের জার্মান সম্রাটের প্রতি দন-ফৌজ ও দন-সরকারের তরফে মিত্রতার আহ্বান ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যের ডাক
ঞ) বলশেভিকরা কসাকদের জমি কেড়ে নেবে, খ্রিষ্টধর্ম কেড়ে নেবে, দেশছাড়া করবে — এই ভয় বিদ্রোহে মদত জোগাচ্ছে, লাল ফৌজের সঙ্গে তুল্যমূল্য যুদ্ধ কসাক দন-ফৌজের এবং অগ্রগমন, কসাক দন-ফৌজের লুঠতরাজ, নিজেদের এলাকা ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে যুদ্ধ করতে কসাকদের অনিচ্ছা, রণাঙ্গনে অফিসারদের এগিয়ে দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলার প্রবণতা
ট) ১৯১৮ র নভেম্বরের শেষে ইংরেজ-ফরাসী মিত্রজোটের সঙ্গে ক্রাসনোভের মিত্রতা স্থাপন, কিন্তু দন-ফৌজ ও স্বেচ্ছাসেনাবাহিনীর মিত্রজোটের কাছ থেকে রসদ ও গোলাবারুদ মিললেও সৈন্যসাহায্য না মেলা, ডিসেম্বরে শীতের আগমন এবং ফের কসাকদের ফ্রন্ট ছেড়ে পলায়ন শুরু, দন ফৌজের আঠাশ নম্বর, ছত্রিশ নম্বর রেজিমেন্ট ফ্রন্ট ছেড়ে বেড়িয়ে গেল ও লাল ফৌজকে ঢুকতে দিল, নিজেদের স্টোর লুঠ, উত্তর ফ্রন্টে দন সরকারের পশ্চাদপসরন
ঠ) লাল ফৌজের ভিওশেনস্কায়া জেলা অবদি ঢুকে পড়া, উজানি দন-এ নিয়ন্ত্রণ কায়েম, বিদ্রোহ দমন করতে বিদ্রোহী কসাকদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দন-ফৌজের আধিকারিকদের খুঁজে বের করে হত্যা, দন কসাকদের ওপর সম্পত্তি কর, কসাকদের নিরস্ত্রীকরণ, গ্রামে গ্রামে বিপ্লবী কমিটি গঠন, বলশেভিক ওপর মহল থেকে সামরিক-জাত দন-কসাকদের জোতদার অংশকে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জ্ঞান করে তাকে নিকেশ করে ফেলার চেষ্টা, ব্যবসায়ী ও পলাতক বড়োলোক কসাকদের বাজেয়াপ্ত সামগ্রী গরীব কসাকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কিন্তু তাতে গরীব কসাকদের অনাগ্রহ, ফের বয়স্কদের উসকানিতে কসাকদের মধ্যে বিদ্রোহের ইঙ্গিত
ড) ফের কসাক বিদ্রোহ দনের উজান-এ, লালফৌজের ফ্রন্টের পেছনের দিকে, গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব, আহ্বান — “তোমরা প্রশান্ত দনের সন্তানরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমাদের বাপ-ঠাকুর্দাদের ওরা গুলি করে মারছে, ধনসম্পত্তি কেড়ে নিচ্ছে, তোমাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে ইহুদীর বাচ্চা কমিসারগুলো … ইয়েলানস্কায়া জেলার ছেলে বুড়ো সবাই জেগে উঠেছে, ভিওশেনস্কায়ার লোকেরা লাল ফৌজিদের হটিয়ে দিয়েছে, আর তোমরা রিবিনস্কির কসাকরা, তোমরা কী করছে?”
ঢ) খোপিওর আর উস্ত-মেদভেদিৎস্কায়া বাদে দনের প্রায় সব জেলায় বিদ্রোহ, ভিওশেনস্কায়ায় সদর, আগের সরকারি কাঠামো বজায়, কিন্তু এবার জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল সোভিয়েত, এককালের গালি ‘কমরেড’ বলেই একে অপরকে সম্বোধন, ‘সোভিয়েত ক্ষমতার পক্ষে, কিন্তু কমিউন, গুলি করে লোকজন মারা আর লুঠতরাজের বিরুদ্ধে’ স্লোগান, টুপিতে একটা সাদা ডোরার বদলে একটা সাদা ও লাল আড়াআড়ি, বিদ্রোহীদের যুক্ত বাহিনী, ভিওশেনস্কায়ায় বিদ্রোহী বাহিনীর সেনাপতি কমবয়সী কুদিনভ ও সদর দফতরের কর্তা সাফোনভ, কিন্তু বিদ্রোহী বাহিনীর স্কোয়াড্রনগুলো প্রায় স্বাধীন
ণ) এই পর্যায়ের গৃহযুদ্ধ নৃশংসতম, ১৯১৯ এর মার্চ মাসে বিদ্রোহী বাহিনী সাফল্য পেল বটে, কিন্তু কসাকরা নিজেদের জেলা ছেড়ে যেতে অস্বীকার করল, ভিওশেনস্কায়া ডিভিশন সেনাপতি কুদিনভের দনেৎস প্রদেশ আক্রমণের আহ্বান শুনল না, লাল ফৌজের একদিকে দন-ফৌজের সঙ্গে মুখোমুখি ফ্রন্ট, আর পেছনে সুবিশাল বিদ্রোহী বাহিনী, এপ্রিলে বিদ্রোহী বাহিনী এবং দন-ফৌজ ও স্বেচ্ছাসেনাবাহিনীর মিলনের আশঙ্কায় প্রমাদ গণল সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিপ্লবী সামরিক পরিষদ, বিদ্রোহ দমনে ব্যাপক সৈন্য ও অস্ত্র সমাবেশ, বিদ্রোহী কসাক বাহিনীর অস্ত্রে টান, গ্রাম থেকে সীসে জোগাড় করে বুলেট বানানোর চেষ্টা
ত) নিজ জেলা ছেড়ে যেতে না চাওয়ায় বিদ্রোহী বাহিনী দনের উজান এলাকায় সীমাবদ্ধ, লাল ফৌজের পিষে ফেলা সময়ের অপেক্ষা, ক্লান্তি, কুদিনভ ইত্যাদি বিদ্রোহী বাহিনীর নেতাদের দন-ফৌজ এবং স্বেচ্ছাসেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলানো ও বশ্যতা স্বীকার করে বাঁচার চেষ্টা, কসাকদের একটা বামপন্থী অংশের লাল ফৌজ ও শ্বেত ফৌজ দু-দলকেই হটিয়ে দন প্রদেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে কমিউনিস্টদের বাদ দিয়ে স্বাধীন কসাক সোভিয়েত সরকার গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থানের চেষ্টা
থ) লাল-ফৌজেও বিশ্বাসঘাতকতা (সের্দোবস্ক রেজিমেন্টে), রেজিমেন্টের মধ্যে কমিউনিস্টদের বেছে বেছে খুন, দন-ফৌজ তথা দন-সরকারের কাছে বিদ্রোহী কসাক বাহিনীর বশ্যতা ও মৈত্রী, লাল-সাদা চিহ্ন (দন সরকারের চিহ্ন তেরঙা — নীল (কসাক), লাল (কসাকভূমিতে বাসরত বহিরাগত), হলুদ (কালমিক)) ও কমরেড সম্বোধনের জন্য বিদ্রোহী বাহিনীকে খোঁটা, লাল ফৌজকে কসাকরা গত বছর ফ্রন্ট ছেড়ে দেওয়ায় দন-সরকারের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে কুদিনভের চিঠি, দন-ফৌজের বর্তমান প্রধান সিদোরিন ও বিদ্রোহী বাহিনীর সেনাপতি কুদিনভের ঘনিষ্টতা
দ) ১৯১৯ এর মে মাসে দক্ষিণ ফ্রন্টে ফাটল ধরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সেক্রেতভের নেতৃত্বে দন-ফৌজের ঝটিকা বাহিনী গঠন, ঝটিকা আক্রমণে লালদের ফ্রন্ট ভেঙে বেড়িয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে একযোগে খোপিওর জেলা উদ্ধারের পরিকল্পনা, ইঙ্গ-ফরাসী মিত্রবাহিনীর রসদ ও গোলাবারুদ, ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান যোগান, খোপিওরে বিদ্রোহের ব্যর্থ চেষ্টা, দন-ফৌজের সঙ্গে লাল-ফৌজের পেরে না ওঠার কারণ যে লাল-ফৌজের ফ্রন্টের পেছনের বিদ্রোহ তা বুঝে বিদ্রোহ দমনে ট্রটস্কির নেতৃত্বে ব্যাপক সেনা সমাবেশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের, ট্রটস্কির নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমনের আহ্বান
ধ) ফের বিদ্রোহী কসাক বাহিনীতেও অফিসার খুন হতে শুরু করল সাধারণ কসাক সেনাদের হাতে, মে মাসের শেষের দিকে বিদ্রোহী বাহিনীর পিছু হটা, সেনারি ফেরারি হতে শুরু করল, গ্রাম ছেড়ে কসাক পরিবারের পলায়ন শুরু উদ্বাস্তু হয়ে, দন পাড় ভর্তি উদ্বাস্তু, ফের লাল ফৌজের নিয়ন্ত্রণ, এবার ধনীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া শুরু
ন) জুন মাসের মাঝামাঝি সেক্রেতভের দন-ফৌজ ঝটিকা বাহিনীর লাল ফৌজ্যের বুহ্য ভেঙে বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হলো ভিওসেনস্কায়ায়, বিদ্রোহী বাহিনীর কর্মাধ্যক্ষদের একসময় লাল ফৌজের দলে ভেড়ার জন্য ও লালদের ফটক খুলে দেওয়ার জন্য বেইমান ও বিশ্বাসঘাতক বলা, বিদ্রোহী বাহিনীর ওপর দন-ফৌজের দাদাগিরি, বিদ্রোহী বাহিনীর তেজ কমে যাওয়া, বিদ্রোহী বাহিনী ও দন-ফৌজের সুবিধাবাদী আঁতাত, দন-ফৌজের উস্ত-মেদভেদিৎস্কায়া দখল, কসাক গ্রামে দন-ফৌজের অত্যাচার ও কাছে টানার চেষ্টা, দন-ফৌজ ও বিদ্রোহী বাহিনীর যৌথ অভিযানে লাল ফৌজ বেকায়দায়
প) বিদ্রোহী বাহিনী ভেঙে দিয়ে দন-ফৌজের মধ্যে মিলিয়ে দেওয়া হলো পদাধিকারীদের প্রমোশন দিয়ে, দন-ফৌজের লুঠপাট, ব্যাপক দুর্নীতি, গ্রামে গ্রামে লুঠ, মেয়েদের ধর্ষণ, মজুত শস্য নষ্ট করছে, গোরুভেড়া জবাই করছে, মজুত সেনারা যুদ্ধ করতে অস্বীকার করায় বাচ্চা আর বুড়ো দিয়ে ভরাট করার চেষ্টা
ফ) ১৯১৯ এর জুলাই মাসে দন-ফৌজের খোপিওর প্রদেশ দখল, আরও উত্তরে এগিয়ে মস্কো দখলের পরিকল্পনা, কিন্তু খোপিওর প্রদেশ দখল করার পর আর এগোতে চাইল না উজান দন ও খোপিওরের কসাকরা, দন-ফৌজ তার মারমুখী শক্তি হারিয়ে ফেলল, জুলাই-এর শেষে ট্রটস্কির পরিকল্পনায় লাল-ফৌজের ঝটিকা বাহিনী গঠন শোরিনের নেতৃত্বে, লাল ফৌজের ব্যাপক আক্রমণ, দন-ফৌজের মামন্তভের নেতৃত্বে ঠেকানোর চেষ্টা, আগস্টের মাঝামাঝি দন-ফৌজ পিছু হটে দক্ষিণে দনের উজান এলাকায় চলে আসা, ফের দনের মাটিতে এসে দন-ফৌজ উজ্জীবিত, কারণ কসাকরা ফের দন-ফৌজকে শক্তিশালী করে তুলল শোরিনের লাল-বাহিনীর বিরুদ্ধে, কিন্তু লাল ফৌজের চাপে দন-ফৌজ ধীরে ধীরে দনের দিকে পিছু হটে এল
ব) ১৯১৯ এর সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ দনের ধারে এসে উপস্থিত হলো শোরিনের বাহিনী, দনের বাঁদিকের সমস্ত গ্রাম দখল করল লাল ফৌজ, কিন্তু কোনো গ্রামে কোনো বাড়িতে আগুন লাগানো হলো না এবার, কোনো ধনসম্পত্তি লুঠ করা হলো না, সোভিয়েত টাকায় কিনতে লাগল যা দরকার, দনের ডানদিকের কসাক ফৌজ অবাক হয়ে গেল, অক্টোবরে দন-ফৌজ কিছু জায়গা থেকে লাল ফৌজকে হটিয়ে দিল আরো উত্তরের দিকে
ভ) নভেম্বরের শুরুতে দক্ষিণ ফ্রন্টে স্তালিনের আগমন, তার পরিকল্পনায় দন প্রদেশের ভেতর দিয়ে না গিয়ে দনবাসের ভেতর দিয়ে আক্রমণ, ভরোনেজ-এ বুদিওন্নির লাল ফৌজ বাহিনীর তৎপরতায় দন-ফৌজের বাঁদিক ফাঁকা করে স্বেচ্ছাসেনাবাহিনী দক্ষিণে হটে যাওয়া, দন-ফৌজ বেসামাল, সৈন্যরা পালাতে লাগল দক্ষিণে, গ্রামকে গ্রাম উদ্বাস্তু হয়ে দক্ষিণ দিকে পলায়ন, সিভিলিয়ান আর সৈন্য একসাথে দক্ষিণে পিছু হটছে, টাইফাস রোগের মহামারী শুরু, কুবানে স্বেচ্ছাসেনাবাহিনী দেনিকিনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আভাস, কুবান আর তেরেক-এর কসাকরা দন-ফৌজের ওপরও খাপ্পা, পলাতক স্বেচ্ছাসেনাবাহিনী ও দন-ফৌজের মার্কামারাদের দক্ষিণে এসে সমুদ্রপথে তুরস্ক পালানোর তোরজোর, জর্জিয়ায় পালানোরও চেষ্টা, লাল ও সবুজ দলের এগিয়ে এসে দক্ষিণের বন্দর অবদি দখল নেওয়া
ম) দন-ফৌজের দফারফা, দন এলাকায় লাল-ফৌজের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, জরুরি কমিশন বসিয়ে বিদ্রোহী বাহিনী ও দন ফৌজের সমূলে উৎপাটন, নুনের আকাল, চোরাগোপ্তা বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে তখনো
য) ১৯২০ সালের হেমন্তকালে খাদ্যসংগ্রহ নীতি সফল করার জন্য সোভিয়েত সরকারের খাদ্যসংগ্রহ অভিযান বাহিনী গঠন, গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে অতিরিক্ত ফসল সংগ্রহ, এর বিরুদ্ধে কসাকদের স্বচ্ছল অংশের, পুরনো দন-ফৌজের পড়ে থাকা অংশ, অবলশেভিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ফেরারি সেপাইদের ‘ডাকাতদল’ গঠন, যারা খাদ্যসংগ্রহবাহিনীর লোকজনকে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে মেরে ফেলে, ডাকাতদলের দন-ফৌজ পুনর্গঠনের স্বপ্ন ও তা ভেঙে যাওয়া
বর্তমানের ইতিহাস রচনায় লেখকের মুন্সিয়ানা অসাধারণ। অন্তত তিনবার লেখক দু-ভাবে একই ঘটনার বর্ণনা দেন, কেবল দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তুলে ধরার জন্য। একবার সেত্রাকোভ গ্রামে লাল ফৌজের অত্যাচারের বর্ণনা, যা কসাক বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। একটি ঘটনায়, আরেকটি প্রতিফলনে। ঘটনার বর্ণনায় নাটকীয়ভাবে তুলে ধরা হয় লাল ফৌজির অত্যাচার ও মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া। প্রতিফলনে দেখানো হয়, সেটি লাল ফৌজের সাধারণ চিত্র নয়, বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু তা গুজব হয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় কসাক অস্মিতায়, কসাকদের মনোভাব ও অবস্থার সঙ্গে বলশেভিক মতবাদের যোজন দূরত্বের বারুদে। আরেকটি ঘটনা হলো গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাতারস্কি গ্রামের লাল ফৌজি কশেভয়ের গ্রামের বড়োলোক বাড়িগুলোতে আগুন লাগানো। ঘটনার বর্ণনায়, কশেভয়ের আগুন লাগানোর ভাবনার বর্ণনায় যেন মনে হয় গোটা তাতারস্কি গ্রামটাকেই পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিফলনে বোঝা যায়, বেছে বেছে কেবল বড়োলোক বাড়িগুলোতেই আগুন দেওয়া হয়েছে। লালফৌজিদের তাতারস্কির সাতজনকে বন্দী করে পাইন বনে নিয়ে গিয়ে কোতল করার ঘটনার বর্ণনা তিনভাবে করা হয়, প্রথমে ঘটনার পরম্পরা, পরে গ্রামবাসীদের বয়ান এবং স্টকম্যানের বয়ান। প্রথম দুটি বয়ানে যেন মনে হয়, লালফৌজিরা কসাকদের ধরে ধরে কোতল করতেই চায়। স্টকম্যানের মুখে ঘটনার ‘ন্যায্যতা’ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে লেখক বুঝিয়ে দেন, জাত-যোদ্ধা দন-কসাকদের জোতদার অংশটাকে কেন নিকেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সোভিয়েত সরকার, এবং কেন নিকেশ না করলে তা গ্রামের বিপ্লবী অংশটাকে নিকেশ করে দেবে।
ইতিহাস তো একসাথে ব্যক্তিগত এবং পাখির চোখে দেখা। দুটোর কোনোটাই ফেলনা নয়।

৮) যুদ্ধ ও মৃত্যু
উপন্যাসের একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে যুদ্ধের বর্ণনা, মহাযুদ্ধ এবং গৃহযুদ্ধ। বেশিরভাগ যুদ্ধ বর্ণনাতেই নায়ক গ্রিগোরি উপস্থিত। সেসব যুদ্ধ বর্ণনায় যুদ্ধে গ্রিগোরির বীরত্বের ও মুন্সিয়ানার বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি আছে নির্মমতা। কেন এত যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে? পাঠককে কী উপলদ্ধিতে পৌঁছে দিতে চান লেখক? এক যুদ্ধবিরোধী মনোভাবে উপনিত করতে চান লেখক। তাই যুদ্ধের বর্ণনার একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যুর বর্ণনা। এখানে আমি দুটো মৃত্যুর বর্ণনা দিচ্ছি, দুটোই মহাযুদ্ধের।

————-
একটা বাগানের লোহার রেলিংয়ের ধার দিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে টলতে টলতে ছুটে চলেছে এক অস্ট্রিয়ান। সঙ্গে কোন রাইফেল নেই, হাতে চেপে ধরে আছে টুপিটা। গ্রিগোরির চোখে পড়ল তার মাথার পেছন দিকটা — মুড়ি দেওয়া ভিজে কলারের ওপর, ঘাড়ের কাছে উচিয়ে আছে। গ্রিগেরি তাড়া করে অস্ট্রিয়ানটাকে ধরে ফেলল। চারপাশে যে তাণ্ডবলীলা চলছে তার ফলে উত্তেজিত হয়ে, ক্ষেপে গিয়ে সে তলোয়ার ওঁচাল। অস্ট্রিয়ান সৈন্যটি রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে ছুটছে, গ্রিগোরি জুতসই কোপ বসিয়ে তাকে দু-আধলা করতে পারছে না। তাই সে জিনের ওপর ঝুকে পড়ে তলোয়ারটা কাত করে চেপে ধরে অস্ট্রিয়ানের কপালের রগ লক্ষ্য করে তলোয়ার বসিয়ে দিল। লোকটা একটাও চিৎকার না করে আহত জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে তৎক্ষণাৎ রেলিংয়ের দিকে পিঠ করে ঘুরে গেল। গ্রিগোরি রাশ টেনে ঘোড়া থামাতে না পেরে তাকে পেরিয়ে চলে গেল, তারপর আবার দুলকি চালে ছুটিয়ে ঘুরে এলো। অস্ট্রিয়ানটার চারকোনা মুখখানা আতঙ্কে লম্বাটে হয়ে গেছে, ঢালাই লোহার মতো কালো হয়ে উঠেছে। হাতদুটাে প্যান্টের লম্বা সেলাই বরাবর ঝুলে আছে, ছাইরঙা ঠোঁটজোড়া ঘন ঘন কাঁপছে। রগের কাছটায় তলোয়ারের কোপ পিছলে যাওয়ায় সেখান থেকে খানিকটা চামড়া খসে গেছে, গালের ওপরে লাল একটা ছিলকে ঝুলঝুল করছে। গায়ের উর্দির ওপর আঁকাবাঁকা ধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
অস্ট্রিয়ানটার চোখে চোখ পড়ল গ্রিগোরির ; মৃত্যুর আতঙ্কমাখা চোখদুটি তার দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। লোকটার হাঁটুজোড়া ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। তার গলার ভেতরে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ উঠল। গ্রিগোরি চোখ কুঁচকে তলোয়ারের কোপ মারল। টেনে মারা বিপুল সেই কোপে মাথার খুলিটা দুফাঁক হয়ে গেল। অস্ট্রিয়ানটা দু’হাত ছড়িয়ে পড়ে গেল – দেখে মনে হল যেন পা পিছলে পড়ল। তার মাথার খুলির দুটো আধখানা সদর রাস্তার পাথরের ওপর ধাপ করে আছড়ে পড়ল।
————- (প্রথম খণ্ড, তৃতীয় পর্ব, পরিচ্ছদ পাঁচ)

প্রসঙ্গত, এটি যুদ্ধে গ্রিগোরির দ্বিতীয় হত্যা। হত্যার পরই গ্রিগোরি ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে গেল হেঁটে অস্ট্রিয়ান সৈন্যটার দিকে। তাকাল তার ছেলেমানুষ মুখটার দিকে, দেখতে পেল যন্ত্রণা বিকৃত ঠোঁটদুটো, ভিক্ষে চাওয়ার মতো বাড়িয়ে দেওয়া নোংরা হাতের চেটো। প্রবল বিতৃষ্ণা আর বিমূঢ়তা ঘিরে ধরল তাকে। যুদ্ধে শত্রুর প্রতি অদম্য কৌতুহলের জন্ম দিল গ্রিগোরির মধ্যে।

আরেকটি মৃত্যু এক কসাক সৈন্যের।

————–
ওরা বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সামনের ঘরে খাট থেকে স্প্রিংয়ের গদি তুলে মেঝেয় পেতে তার ওপর শুয়ে নাক ডাকাচ্ছিল ইয়েগোর জারকোভ। ঘরদোরের বিশৃঙ্খলা অবর্ণনীয়। বাড়ির মালিক যে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ছেড়ে গেছে এ যেন তারই নীরব সাক্ষ্য দিচ্ছে।
… …
“বে-রি-য়ে এসো” গেটের বাইরে চিৎকার শোনা গেল। কসাকরা চামচ ফেলে বাইরে ছুটে এলো। মাথার ওপর দিয়ে অনেকটা নীচুতে মন্থরগতিতে পাক খাচ্ছে একটা এরোপ্লেন। তার শক্তিশালী ইঞ্জিনটা ভয়ানক গর্জন করছে।
“বেড়ার গা ঘেঁষে শুয়ে পড় সবাই! এক্ষুনি বোমা ফেলতে শুরু করবে। পাশেই একটা ব্যাটারি আছে!” কুঁটিওয়ালা চিৎকার করে বলল।
“ইয়েগোরকে জাগিয়ে দাও! নরম গদিতে ঘুমুতে ঘুমুতেই না অক্কা পেয়ে যায়।”
… …
গ্রিগোরি চোখ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকাতে দেখতে পেল ভয়ানক গর্জন করতে করতে বিশাল পাখিটা ছোঁ মারার জন্য তেড়ে আসছে; সেই মুহূর্তে ওখান থেকে প্রচণ্ড বেগে কী যেন একটা খসে পড়ল, সূর্যের কিরণে কলসে উঠল। ভয়ঙ্কর শব্দে বোমা ফাটল, ছোট্ট বাড়িটা এবং বাড়ির দেউড়ির সামনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা কসকরা কেঁপে উঠল তাতে।
… …
… অর্ধেক বাড়িটাই উড়ে গেছে, একটা কদর্য রকমের এলোমেলো লাল ইটের স্তুপ পড়ে আছে, তার মাথার ওপর উড়ছে গোলাপী রঙের ধুলোর একটা কুণ্ডলী। দেউড়ির ধাপগুলো ভেঙেচুরে ওলট-পালট হয়ে গেছে, তারই তলা থেকে দুহাতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে ইয়েগোর জারকোভ। তার গোটা মুখখানা যেন চিৎকারে ফেটে পড়তে চাইছে, চোখদুটাে কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছে, সেখান থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তমাখা চোখের জল। মাথাটা কাঁধের ভেতরে গুঁজে গুড়ি মেরে এগোতে লাগল সে। মৃত্যুপাণ্ডুর ঠোঁটজোড়া না খুলেই যেন সে চিৎকার করে যেতে লাগল।
“আ-ই-ই-ই-ই! অা-ই-ই-ই-ই! আ-ই-ই-ই-ই!’
উরু থেকে একখানা পা ছিঁড়ে গেছে, আড়াআড়ি ভাবে আগুনে ঝলসে যাওয়া প্যান্টের পায়ার কাছে পাতলা চামড়ার গায়ে সেই পা-টা ঝুলছে। পা-টা পেছন পেছন ঘসড়াতে লাগল সে। আরেকখানা পা নেই। আস্তে আস্তে হাতে ভর দিয়ে সে এগিয়ে চলেছে, তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ছে বাচ্চাদের নাকি নাকি গলার ঘনঘ্যানে কান্নার মতো চিৎকার। শেষকালে তার চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল, ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। ঘোড়ার নাদ ছড়ানো, ভাঙাচোরা ইটে ছাওয়া বিশ্রী স্যাঁতসেঁতে অকরুণ মাটির বুকে মুখ গুঁজল। কেউ এগোল না তার কাছে।
গ্রিগোরি তখনও হাতের তালু দিয়ে বাঁ চোখ চেপে ধরে আছে! সেই অবস্থাতেই সে চিৎকার করে বলল, “ওকে তোমরা কেউ তোলো!”
… …
জারকোভের চার পাশে ভিড় জমে উঠল। ভিড়ের মধ্যে গলে গেল গ্রিগোরি, দেখতে পেল তখনও নিঃশ্বাস পড়ছে জারকোভের, তখনও মৃদু আর্তনাদ করছে, তার দেহটা থরথর করে কাঁপছে। মৃত্যুর পাণ্ডুর ছোঁওয়া লাগা কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম!
“আরে তোল ওকে ! তোমরা কী ? … মানুষ না জানোয়ার ?”
লম্বা এক পদাতিক সেপাই খেঁকিয়ে উঠল।
“অমন চেল্লাচেল্লি শুরু করে দিয়েছ। কেন ? তোল, তোল, … আরে তুলে নিয়ে যাবে কোথায় ? দেখছ না শেষ হয়ে আসছে ?
“দুটো পা-ই ছিঁড়ে গেছে।”
“ওঃ কী রক্ত ! …”
“ষ্ট্রেচার বওয়ার লোকজন সব কোথায় গেল ?”
“তাদের দিয়ে এখন আর কী হবে ? . . .”
” কিন্তু এখনও তা জ্ঞান আছে ওর।”
ঝুঁটিওয়ালা পেছন থেকে গ্রিগোরির কাঁধ স্পর্শ করল। গ্রিগেরি পিছন ফিরে তাকাল।
“ওকে নাড়াচাড়া করো না”, ফিসফিস করে সে বলল, “ওপাশে ঘুরে গিয়ে দেখে এসে একবার।”
ফৌজী শার্টের হাতা ধরে টানতে টানতে গ্রিগোরিকে অন্য ধারে এনে সামনের লোকজনের ভিড় ঠেলে এগিয়ে দিল তাকে। একবার শুধু তাকিয়ে দেখল গ্রিগোরি, তারপর ঘাড় গুঁজে চলে গেল গেটের দিকে। জারকোভের পেটের নীচে গোলাপী আর নীল নাড়িভুঁড়ি ঝুলছে, সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে। কুণ্ডলী পাকানো নাড়িভুঁড়ির শেষপ্রান্তটা বালি আর ঘোড়ার নাদের মধ্যে গড়াগড়ি যাচ্ছে, নড়াচড়া করছে, মাঝে মাঝে ফুলে বড় হয়ে উঠছে। মৃত্যুপথযাত্রীর হাতখানা একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, যেন মাটি খামচে তুলতে চাইছে। . . .
“ওর মুখটা ঢেকে দাও”, কে একজন বলল।
জারকোভ হঠাৎ দুহাতে ভর দিয়ে উঠল, মাথাটা পেছন দিকে হেলাল, তার বেঁকে যাওয়া দুই কাঁধের মাঝখানে মাথার পেছনটা ধাক্কা খেল, তারপর ভাঙা ভাঙা কর্কশ গলায় অমানুষিক চিৎকার করে বলল, “ভাই, আমাকে মেরে ফেল তোমরা ! … ও ভাই ! … অমন করে কী দেখছ? … আ-হা-হা! … মেরে ফেল, আমাকে মেরে ফেল ভাই তোমরা! … ”
—————– (প্রথম খণ্ড, তৃতীয় পর্ব, পরিচ্ছদ ২০)

 

তবে মহাযুদ্ধের মৃত্যুর বর্ণনার মধ্যে যেমন আছে অন্তর্লীন যুদ্ধবিরোধিতা, তেমনি নিশ্চিত-মৃত্যু-না-হওয়ার মধ্যেও আছে। তার একটুকরোও তুলে ধরা দরকার।

—————-
গোলাম ফস করে দেশলাই জ্বালাল। প্রথম যে সুড়ঙ্গ-ঘরটি পড়ল খোলা দরজা দিয়ে তার ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু পরীক্ষণেই ছুটে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে, যেন কেউ তাকে ঠেলে বার করে দিয়েছে – ভেতরে এ ওর গায়ে আড়াআড়ি করে পড়ে আছে দুটাে মড়া। তিন-তিনটে সুড়ঙ্গ-ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল, কিন্তু কোন ফল হল না। লাথি মেরে চতুর্থটার দরজা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল ; ভেতর থেকে ভেসে এলো বিদেশী কোন এক লোকের খনখনে গলায় আওয়াজ : “Wer ist das ?”
গোলামের সারা দেহে যেন কেউ জ্বলন্ত উনুনের গরম ছাই ঢেলে দিল ।  … অলস ভঙ্গিতে কাঁধ নাচিয়ে কাঁধের ওপর ফেলে রাখা গ্রেটকেটটা ঠিক করে নিতে নিতে সুড়ঙ্গ-ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জার্মানটা।
‘হ্যাণ্ডস আপ! হ্যাণ্ডস আপ! ধরা দাও!” কর্কশকণ্ঠে চিৎকার করে কথাগুলো বলে গুড়ি মেরে বসে পড়ল গোলাম – দেখে মনে হল যেন যুদ্ধে নামার আদেশ পেয়েছে। বিস্ময়ে জার্মানটার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে হাত তুলল, এক পাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। তার দিকে বাগিয়ে ধরা সঙ্গীনের তীক্ষ্ণ চকচকে ডগাটার দিকে। গ্রেটকেটটা কাঁধ থেকে পড়ে গেল। গায়ের ধূসর-সবুজ ফৌজী উর্দিটা টান পড়ে বগলের কাছে কুঁচকে রইল। খেটে-খাওয়া-মানুষের মতো বড় বড় হাতদুটাে মাথার ওপর ওঠানো অবস্থায় কাঁপতে লাগল। আঙুলগুলো নড়তে লাগল, যেন অদৃশ্য কোন তারে ঝঙ্কার তুলছে। ভঙ্গি পরিবর্তন না করে গোলাম এক ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। জার্মানটার লম্বা মজবুত দেহটা, তার উর্দির পেতলের বোতাম, পাশ দিয়ে সেলাই করা খাটাে বুটজোড়া, সামান্য কাত-করে-পরা কানাতহীন টুপিটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎই কেন যেন ভঙ্গি পরিবর্তন করল, দুলে উঠল, যেন তার বিদঘুটে গ্রেটকোটটার ভেতর থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে এলো; একটা অদ্ভুত ঘড় ঘড় আওয়াজ বার করল গলা দিয়ে – সেটা না কাশির না ফোঁপানির। জার্মানটার দিকে পা বাড়াল গোলাম। নিরাবেগ ভাঙা গলায় বললঃ “পালাও ! পালাও জার্মান ! তোমার ওপর কোন রাগ নেই আমার। গুলি করব না। ”
————— (দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ পর্ব, পরিচ্ছদ তিন)

মহাযুদ্ধ আর গৃহযুদ্ধ এক নয়। মহাযুদ্ধে যারা নেমেছে পরস্পরকে মারতে, তারা কেউ জানে না অপরকে কেন মারছে। কিন্তু গৃহযুদ্ধে একে অন্যের বিরুদ্ধে জেনেশুনে অস্ত্র ধরেছে, ওই যুদ্ধ বাস্তব যুদ্ধ, বিবদমানতার প্রকাশ, তার ফয়সালা হওয়া চাই। তাই এই যুদ্ধে মর্মান্তিক মৃত্যু বর্ণনা তুলনায় কম হয়ত, কিন্তু তবু আছে, বিশেষত বন্দীদের মেরে ফেলার বর্ণনা। শোলকভের যুদ্ধ-বিরোধী মন গৃহযুদ্ধের রাজনৈতিক আবশ্যকতাকে কোথাও কোথাও তীক্ষ্ণ প্রশ্নবানে বিদ্ধ করে। গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক গ্রিগোরি ক্লিমভকার কাছে যুদ্ধে লাল ফৌজের চার জাহাজীকে তাড়া করে তরোয়াল দিয়ে কেটে ফেলার পরেই বিলাপ করে, “এ আমি কাকে খুন করলাম”। প্রোখর জিখভ খুঁজে পেতে এক বারবণিতার কাছ থেকে গণোরিয়া রোগ বাগায়, এবং পল্টন থেকে অব্যাহতি পায়। অথবা গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে দন-ফৌজের এক গোলন্দাজের বলা কথাগুলোতে, ” … যুদ্ধ ত নয়, ক্লান্তির একশেষ। কোন রং চং নেই। কাদামাখাই সারা! মোট কথা – কোন অর্থই দেখি না। আমার সাধ্যি থাকলে আমি ওই ওপরওয়ালা নেতাগুলোকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলতাম, ‘এই যে আপনাদের জন্যে একজন সার্জেন্ট-মেজর – মিস্টার লেনিন। অস্ত্র কী ভাবে হাতে নিতে হয় তাঁর কাছ থেকে শিখুন। আর আপনি, মিস্টার ক্রাসনোভ, আপনি যে পারেন না তার জন্যে লজ্জা হওয়া উচিত আপনার!’ তারপর যা হয় হোক গে। — ডেভিড আর গলিয়াথের মতো ফাটাফাটি করুক দুজনায় — যে জিতবে, ক্ষমতা তার হাতে। কে তাদের শাসন করছে না করছে সাধারণ লোকের কাছে সব সমান।”
৯) আদর্শ বনাম বাস্তব
মতাদর্শের তো একটা ধারনাগত চরিত্র আছে। বাস্তব সম্পর্কে একটা ধারনা করে নেওয়া হয়। তারপর সেই ধারনার ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়ে মতাদর্শ। কিন্তু বাস্তবের পরিসর তো অসীম এবং সদা বদলশীল। তাই যে ধারনা বাস্তবের সবচেয়ে কাছাকাছি, তার ওপর দাঁড়ানো মতাদর্শও বাস্তবের থৈ পায় না। বাস্তবের বৈচিত্র্য এবং বদলশীলতার কাছে নাস্তানাবুদ হয়। এইখানেই এম্পিরিক্যাল গবেষণা, নৃতাত্ত্বিক গবেষণা এবং অবশ্যই প্রশান্ত দন জাতীয় উপন্যাসের মহিমা। কয়েক বছর আগে চিনের ‘চেন গ্রাম’ নামে একটা গ্রামের নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষার রিপোর্ট পড়েছিলাম। মোটামুটি মাও জে দং-এর নেতৃত্বে বিপ্লব থেকে অধুনা সেজ — চিনের এই পঞ্চাশ ষাট বছরের ইতিহাস ওই গ্রামটির চোখ দিয়ে দেখা গিয়েছিল ওই রিপোর্টে। তবে ওই রিপোর্টের চেয়েও চিত্তাকর্ষক ও চমকপ্রদ শোলখভের এই উপন্যাসের তাতারস্কি গ্রামের প্রতিফলনে সোভিয়েত বিপ্লব।

 
উপন্যাসে নানা মতাদর্শের কথা আছে, মতাদর্শধারী মানুষজন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সেগুলো তুলে ধরেছে। যেমন ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ও জারের পতনের পরই তাতারস্কি গ্রামের একমাত্র যার নিজের বাড়ি নেই, সেই স্কুল মাস্টার বালান্দা গ্রামের বারোয়ারিতলায় কসাকদের এক ভিড়ে বক্তৃতা দিচ্ছে উত্তেজিতভাবে, ” … রক্তচোষা জারের চাকরী করার কলঙ্ক থেকে তোমরা রেহাই পেলে। সংবিধান সভা হবে শোষণমুক্ত নয়া রাশিয়ার হর্তাকর্তা। সংবিধান সভাই গড়ে তুলতে পারবে আরেক জীবন — সে জীবন হবে আলোর জীবন।” কসাকরা শুনে হাসছে, বিদ্রূপ করছে। বালান্দার প্রেম সংবিধান সভার প্রতি। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি। কিন্তু মহাযুদ্ধের রাশিয়ায় কেরেনস্কির সরকার টিঁকল না, সংবিধান সভা ব্যর্থ হলো। জাতিতে জাতিতে মহাযুদ্ধ বন্ধ করতে চাইল না সংবিধান সভা। কসাকদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছুটি হলো না।
রাজতন্ত্রী বা জারতন্ত্রী মতাদর্শও বিদ্যমান এই উপন্যাসে। ধারক ইয়েভগেনি লিস্তনিৎস্কি। ইয়াগদানোয়ের জমিদার বাড়ির সন্তান। কসাক। বংশগতভাবে জারের দেওয়া তিরিশ হাজার বিঘা জমির মালিক। জারের পতনের পর পেত্রোগ্রাদে বলশেভিকদের দমন করার জন্য আনা বাহিনীর অফিসার হিসেবে গেল সে, দেশের সীমান্তে প্রতিরক্ষার কাজে না থেকে। ফেব্রুয়ারিতে মাগিলিওভে সিংহাসনচ্যুত সম্রাট যখন মোটরগাড়ি করে আর্মি হেডকোয়ার্টার ছেড়ে যাচ্ছিল বিষণ্ণ মুখে, তাই দেখে লিস্তনিৎস্কি বরফের ওপর পরে বাচ্চা ছেলের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। পেত্রোগ্রাদে তার উপলদ্ধি — “হ্যাঁ, এটা তো ঠিকই, খোলাখুলি বলতে গেলে (ফেব্রুয়ারি) বিপ্লবকে আমি মেনে নিতে পারছি না, গ্রহণ করতে পারছি না। আমি মনেপ্রাণে তার বিরুদ্ধে। … পুরনো ধ্যানধারণার জন্য দরকার হলে আমি প্রাণ দেব, এতটুকু দ্বিধা না করে, নিজেকে বিন্দুমাত্র জাহির না করে স্রেফ একজন সৈনিকের মতো প্রাণ দিয়ে দেব। …” কেরেনস্কি সরকারের আমলে কর্নিলভ সেনাপ্রধান মনোনীত হলে স্পষ্ট হয়ে যায়, বলশেভিক ও কেরেনস্কির মতো কর্নিলভও অন্য একটা পক্ষ, কেরেনস্কির লোক সে নয়। বরং জার জমানা ফিরিয়ে আনার পক্ষে সে। লিস্তনিৎস্কি পেত্রোগ্রাদে অফিসারদের সভায় বক্তৃতা রাখতে গিয়ে বলে, ” … কমিটিগুলির প্রভাব থেকে ছিনিয়ে আনতে হবে কসাকদের। …উচিত হবে কসাকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক পাতানো।” কমিটি বলতে বলশেভিক প্রভাবিত ফৌজি বিপ্লবী কমিটি এবং/অথবা সৈনিক সোভিয়েত। কিন্তু এই মতাদর্শও সফল হয় না। কসাক সৈনিকরা চাইছিল বাড়ি যেতে, যুদ্ধ আর না করতে। বলশেভিকরা ঠিক সেই দাবি তুলেছিল, তাই কসাকদের মন পেয়েছিল। জারতন্ত্রীর পক্ষে সাধ্য কি সেই বাস্তবতাকে অতিক্রম করা? অফিসারদের মিটিং-এর ক’দিন পরে নিজের রেজিমেন্টের এক কসাক সেনা ও ফৌজি বিপ্লবী কমিটির এক সদস্য লাগুতিনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে যায় লিস্তনিৎস্কি। তাকে কমিটির কথা জিজ্ঞেস করে, ক্ষেতখামারির কথা জিজ্ঞেস করে। বাজিয়ে দেখতে চায়, বলশেভিকরা যদি কসাকদের জমিজমা কেড়ে নিতে আসে তাহলে তাদের সঙ্গে কী করা উচিত, জিজ্ঞেস করে। জবাবে শুনতে পায় লাগুতিন বলছে, “বলশেভিকরা আমার জমির শেষ টুকরোটা কেড়ে নিতে যাবে না। এক ভাগের যতটা পাওনা ঠিক ততটাই আছে আমার, আমার জমি তাদের কোন দরকার হবে না। … কিন্তু এই ধরুন, আপনার কথা যদি বলেন, অধীনের অপরাধ নেবেন না হুজুর … আপনার বাবার আছে আশি হাজার বিঘা জমি।” লিস্তনিৎস্কি সংশোধন করে দেয়, আশি নয়, তিরিশ। লাগুতিন বলে,

—————-
“ওই একই হল। ধরলাম না হয় তিরিশই – সেটা কি খুব একটা কম হল ? বলি, এটা কী রকম ব্যবস্থা ? আর সারা রাশিয়ার কথা যদি ধরেন, আপনার বাবার মতো লোকের সংখ্যা মোটেই কম নয়। তাহলেই একবার বিবেচনা করে দেখুন মেজর, পেটের খিদে কার না আছে? আপনি খেতে চান, আর সবাইও খেতে চায়। তা সে যে লোকই হােক না কেন। একমাত্র জিপসীই আমাদের শিখিয়েছে ঘোড়াকে খাওয়ানোর দরকার নেই – দানাপানি ছাড়া নাকি তার অভ্যোস হয়ে যাবে। কিন্তু তার সেই আদরের ঘোড়াটি অনেকদূর পর্যন্ত ওই ভাবে থাকা অভ্যেস করতে করতে শেষকালে দশ দিনের দিন দুম করে টেঁসে গেল ! . . . জারের আমলে ব্যবস্থা বলতে যা ছিল সবই একপেশে, বাঁকা, গরিব মানুষের পক্ষে একেবারে জঘন্য। …  আপনার বাবামশায়ের ভোগের জন্য ওরা কেটে দিয়েছেন বিশাল এক টুকরো – তিরিশ হাজার বিঘা। অথচ দেখুন, একটা বৈ দুটো পেট ওঁর নেই। আমাদের আর দশটা লোকের মতো ওঁরও একটাই পেট । তাই লোকের কথা ভেবে দুঃখ হয় বৈ কি ! … বলশেভিকরা ঠিক পথেই যাচ্ছে, আর আপনারা বলছেন কিনা লড়াই করতে হবে! … ”
————— (দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ পর্ব, পরিচ্ছদ বারো)

লিস্তনিৎস্কি রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, লাগুতিন কি বলশেভিক? লালফৌজ প্রতিনিধিদের সোভিয়েত তাহলে এইসব মাথায় ঢোকাচ্ছে? লাগুতিন সরল জবাবে বুঝিয়ে দেয়, ‘মাথায় ঢোকাতে’ হয় মতাদর্শ, বাস্তব জীবনের উপলদ্ধিকে কথায় প্রকাশ করা মতাদর্শ নয়, বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা মাত্র — “না মেজর, জীবন নিজেই আমাদের মতন ধৈর্য্যবান লোকদের ভেতরে এসব পুরে দিয়েছে, বলশেভিকদের হাতে কেবল সলতেটা ধরানোর অপেক্ষা — এই যা।”

 
কিন্তু কেরেনস্কি বা জারতন্ত্রী মতাদর্শ শুধু নয়, সে সময় বিকশিত হয়েছিল কসাক স্বায়ত্বশাসনের মতাদর্শও। সৈন্যবাহিনীর প্রতিভাধর ও জনপ্রিয় অফিসার ইজভারিন এই মতাদর্শের উগ্র বার্তাবহ। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব তাকে নাড়া দেয়। ইতিহাসে তার অগাধ জ্ঞান। অত্যুৎসাহী হলেও স্বচ্ছ দৃষ্টি ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী ছিল সে। তার মতাদর্শ দনের ভাটি এলাকার অবস্থাপন্ন কসাকদের নাড়া দিত। রাশিয়া ছাড়া দন-কসাকরা বাঁচবে কী করে? গম ছাড়া যে কিছুই নেই? কেন, শুধু দন-কসাক তো নয়, তেরেক আর কুবান কসাক ও ককেশাসের পাহাড়িদের সঙ্গে মিলে ফেডারেল কসাক রাজ হবে। কয়লা? হাতের কাছেই তো আছে দনেৎস্ক খনি অঞ্চল। যদি সেটা রাশিয়াতে থেকেও যায়, তাহলেও দমে যাওয়া নয়। কসাকদের ফেডারেটিভ ইউনিয়নটি সেক্ষেত্রে কলকারখানা ভিত্তিক হবে না। হবে কৃষিভিত্তিক। যে কয়টা ছোটো ছোটো কারখানা থাকবে, তার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে না হয় কিনেই নেওয়া যাবে কয়লা। তার বদলে দেওয়া হবে গম আর তেল। চারশ বছর ধরে রাশিয়ার জারতন্ত্র কসাকদের যে সব পুরনো ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে, সেগুলোর পুনর্জাগরণ করা হবে। বিদেশীদের হটানো হবে। কিন্তু বলশেভিকরা কি কসাকদের বন্ধু নয়? — “আমাদের যা দরকার তা হলো আমাদের নিজস্ব জিনিস, আর সবচেয়ে বড়ো কথা, সমস্ত রকম অভিভাবকের হাত থেকে রেহাই পাওয়া — তা সে কর্নিলভ হোক, কেরেনস্কি হোক, আর লেনিনই হোক। নিজের দেশের মাটিতে এইসব হোমরা চোমরা লোকজন ছাড়াও আমাদের চলে যাবে। ভগবান আমাদের বন্ধুদের হাত থেকে রেহাই দিন, শত্রুর মোকাবিলা আমরা নিজেরাই করতে পারব।”

 

ইজভারিন নিজেও মতাদর্শের কথা বলছে, কিন্তু বাস্তবজ্ঞান তার তুখোড়। তাই সে বলশেভিক মতাদর্শের সঙ্গেও কসাকদের আগামী দিনে বিরোধ বাধবে তার ভবিষ্যৎবাণী করে দেয় নভেম্বর বিপ্লবে সময়েই —

————-
“… বলশেভিকরা শান্তি চায়, এক্ষুণি শান্তি চায়, আর লড়াই বসে আছে কসাকদের এই এখানে (ঘাড়ে) … এই কারণেই কসাকদের গায়ে বলশেভিকদের গন্ধ … কিন্তু যে মুহুর্তে লড়াই শেষ হবে আর বলশেভিকরা কসাকদের ভূসম্পত্তির দিকে হাত বাড়বে তখনই কসাক আর বলশেভিকদের পথ আলাদা হয়ে যাবে। এটা অমূলক নয় – এ হল এক ঐতিহাসিক অনিবার্যতা ! কসকদের জীবনযাত্রার বর্তমান বিধিব্যবস্থা আর সমাজতন্ত্র – বলশেভিক বিপ্লবের শেষ পরিণতি – এ দুয়ের মাঝখানে এক দুস্তর খাদের ব্যবধান। …”
———— (দ্বিতীয় খণ্ড, পঞ্চম পর্ব, দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)

কিন্তু কসাক আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে কী? ইজভারিনের প্রত্যয় গ্রিগোরির মুখের কথায় ভাষা পায়, পদতিওলকভকে সে বলে, “লড়াই শেষ হলে আমাদের এক নতুন ধরনের জীবন শুরু হবে। ইউক্রেনে সরকার চালাবে রাদা, আর আমাদের এখানে সরকার চালাবে ‘কসাক ফৌজি কাউন্সিল’।” কসাক ফৌজি কাউন্সিল হলো কয়েকশো বছর আগেকার কসাকদের মধ্যেকার এক ফৌজি পরিষদ, কসাকদের সর্বোচ্চ সভা। কিন্তু পদতিওলকভ বাধ সাধে, কসাক ফৌজি কাউন্সিল মানে তো এখনকার আতামান-এর-ই শাসন। তার আর অন্যথা কি? অর্থাৎ সাধারণ কসাক ও খেটে খাওয়া কসাকদের ওপর এখন যেমন অত্যাচার করে কসাক আতামান, সেইটাই বহাল থাকবে। সত্যিই তো, প্রাচীন কসাক জীবন ফিরিয়ে আনা, কসাক ফৌজি পরিষদকে সর্বোচ্চ বলে মেনে নেওয়া মানে তো আতামানতন্ত্র। কসাক জাতীয়তাবাদ কি তার থেকে আলাদাকিছু ব্যবস্থা দিতে পারে? বাস্তবতাটাকেই টিকিয়ে রাখা আর বাস্তবতার মধ্যে থেকে বাস্তবতাকে অতিক্রম করা — এই দুটো তো এক নয়। কিন্তু গ্রিগোরি যখন পদতিওলকভকে পাল্টা প্রশ্ন করে, কসাকদের জমির কী হবে? বলশেভিকরা তো সেগুলো নিয়ে নেবে? তখন পদতিওকলভ বিব্রত হয়ে পড়ে। না, কসাকরা চাষীদের জমি দেবে না। কসাকরা জমিদার কসাকদের জমি নিয়ে নেবে, নিজেদের মধ্যে বিলিবন্টন করবে। আর কসাক সরকার চালাবে কসাকদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। আতামান কালেদিনদের ফেলে দেওয়া হবে। উপন্যাসের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, পদতিওলকভের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গত রেখেই চলছে ঘটনাপ্রবাহ। পদতিওলভ বলশেভিক নয়। গৃহযুদ্ধ শুরুর সময় পদতিওলকভের নেতৃত্বে যখন বিপ্লবী ফৌজি কমিটি তৈরি হচ্ছে, রাশিয়ান সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহী কসাক ইউনিটগুলোর মধ্যে থেকে, তখন সেই নতুন বিপ্লবী ফৌজি কমিটিকে নতুন বিপ্লবী কসাক সরকার বলে স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন লেনিন।
উপন্যাসে দেখা যায় না, কিন্তু সেই সময় রাশিয়ায় বলশেভিক মতাদর্শ শক্তি পেয়েছিল শ্রমজীবি ও চাষিদের মধ্যে। কসাকদের মধ্যে সে মতাদর্শ অনেকটাই ওপরপরা। কসাক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। উপন্যাসের তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডে কসাক বাস্তবতার সঙ্গে বলশেভিক মতাদর্শের ফারাক বারবার চোখে পড়ে। তাতারস্কি গ্রাম লাল ফৌজের কব্জায় এলে গ্রিগোরির শ্বশুর মিরোন সহ গ্রামের জনা সাত আটেক বিদ্রোহের নেতৃস্থানীয় কসাক, লাল ফৌজ হত্যাকারী এবং দন ফৌজের অফিসারকে ভিওশেনস্কায়ায় নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হয় বলশেভিকদের নির্দেশে। কিন্তু লাল ফৌজের একনিষ্ঠ সৈনিক তাতারস্কি গ্রামের আলেক্সেয়েভিচ সেটা ভালো মনে মেনে নেয়নি। স্টকম্যান তাকে তিরস্কার করে। পরের বার যখন ফের তাতারস্কি লাল ফৌজের কব্জায় আসে, তখন আর শত্রুকে মেরে ফেলার ভুল করেনি বলশেভিকরা, বরং গ্রেপ্তার করে কমিশনের সামনে হাজির করার বন্দোবস্ত করা হয়। গ্রামে বড়োলোকদের বাড়ি আগুন দেওয়া হয়েছিল প্রথমবার, পরেরবার তা করা হয়নি।
১০) রাজনীতি বনাম রাজনৈতিক
মতাদর্শ যেমন আছে, তেমনি এই উপন্যাসে আছে রাজনীতিও। মহাযুদ্ধ, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে রাজনীতি। তাই স্বাভাবিকভাবেই তা খুবই ঝাঁঝালো। কিন্তু তা কি শুধু ঝাঁঝালো? না। গোপন রাজনীতি। সন্ধিক্ষণের রাজনীতি। মোটেই চলমান কোনো রাজনীতি নয়, যা বয়ে চলেছে গায়ে লাগছে না। বরং উপন্যাসে রাজনীতি ফ্ল্যাশ-এর মতো। রাজনীতির থেকেও, রাজনীতির লোকের থেকেও, পরিস্থিতির বিচারে লোকের রাজনৈতিক হয়ে পড়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

 
জাতিগুলির শ্রমিকশ্রেণীর মৈত্রীর কথা বলে বলশেভিকরা, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলে, সেই বলশেভিক বুনচুক তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছে স্বেচ্ছায়। কাঠখড় পুড়িয়ে অফিসারও হয়েছে। কতজন জার্মান মজুর খুন হয়েছে তার হাতে, তীব্র কষাঘাত করে প্রশ্ন করে সহ-অফিসার লিস্তনিৎস্কি। উত্তরে অফিসারদের বুনচুক পড়ে শোনায় লেনিন-এর প্রবন্ধ, যা রাজনীতির নীতিবাগীশপনার পরিপন্থী, কিন্তু রাজনৈতিক। নেতিবাচকতার সফল প্রয়োগ, ইতিবাচকতায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। সমাজের গতিশীলতার জন্য। ডায়লেকটিক্স। দ্বান্দ্বিকতা।

————–
“আধুনিক ফৌজের কথাই ধরা যাক। সংগঠনের অন্যতম ভালো দৃষ্টান্তু। এই সংগঠন ভালো একমাত্র এই কারণেই যে ইহা নমনীয়, সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষকে একটিমাত্র ইচ্ছার অনুবর্তী করিবার ক্ষমতা রাখে। আজ সেই লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্ব স্ব গৃহে অধিষ্ঠান করিতেছে। কাল সৈন্য সমাবেশের হুকুম আসিবামাত্র তাহারা বিভিন্ন নির্দিষ্ট কেন্দ্রে সমবেত হইবার আয়োজন করিতেছে। আজ তাহারা ট্রেঞ্চে রহিয়াছে, সময় সময় হয়ত বা মাসের পর মাস তাহাদিগকে পড়িয়া থাকিতে হইতেছে; আবার কাল অন্য এক আদেশের বলে তাহারা আক্রমণ করিতে চলিয়াছে। আজ গুলিগোলা হইতে আত্মরক্ষা করিয়া তাহারা তাক লাগাইতেছে ; কাল তাহারা তাক লাগাইতেছে উন্মুক্ত স্থানে যুদ্ধ করিয়া। আজ তাহদের অগ্রবর্তী দলগুলি মাটির নীচে মাইন পুঁতিতেছে; কাল তাহারা মাথার উপর উড়ন্ত বিমানবহর হইতে বৈমানিকদের নির্দেশক্রমে মাইলের পর মাইল আগাইয়া চলিতেছে! ইহাকেই বলে সংগঠন। সংগঠন তাহাকেই বলে যখন একটিমাত্র লক্ষ্যের বশবর্তী হইয়া, একটিমাত্র ইচ্ছায় উদ্বুদ্ধ হইয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ তাহদের যোগাযোগ ও কর্মের ধারা পরিবর্তন করে, ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্র ও পদ্ধতি পরিবর্তন করে, পরিবর্তিত অবস্থা ও সংগ্রামের প্রয়োজন অনুসারে অস্ত্রশস্ত্র ও হাতিয়ার পরিবর্তন করে।

বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। আজ প্রত্যক্ষ ভাবে এমন কোন বৈপ্লবিক পরিস্থিতি নাই, … এমন কোন অবস্থা নাই যাহাতে জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনার সঞ্চার হইতে পারে, তাহদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পাইতে পারে ; আজ তাই হাতে ধরাইয়া দিতেছে ভোটের কাগজ – উহাকেই শিরোধার্য করিয়া লও ! জেলের ভয়ে যাহারা চেয়ার অাঁকড়াইয়া বসিয়া থাকে, পার্লামেন্টে আরামের জায়গায় তাহাদিগকে ঢুকাইবার বদলে শত্রুর উপর আঘাত হানিবার অস্ত্রস্বরূপ উহাকে গ্রহণ করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ হও । কাল হয়ত ভোটের কাগজ কাড়িয়া লইয়া তোমার হাতে ধরাইয়া দিল রাইফেল কিংবা দ্রুত গোলা ছুঁড়িবার উপযোগী অতি উন্নত ধরনের আধুনিকতম কোন কামান – মৃত্যু আর ধ্বংসের এই অস্ত্র হাতে তুলিয়া লও। যাহারা যুদ্ধের ভয়ে ভীত তাহদের ভাবাবেগপূর্ণ কাঁদুনিতে কর্ণপাত করিও না। পৃথিবীতে এখনও প্রচুর পরিমাণে এমন সমস্ত বস্তু রহিয়া গিয়াছে, শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির জন্য যাহাকে অগ্নি ও তরবারি দ্বারাই ধ্বংস করিতে হইবে ; আর জনসাধারণের মধ্যে যদি ক্রোধ ও নৈরাশ্য ক্রমবর্ধমান হইয়া ওঠে, যদি বৈপ্লবিক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ হইয়া ওঠে তাহা হইলে নূতন নূতন সংগঠন গড়িয়া তুলিবার জন্য প্রস্তুত হও, মৃত্যু ও ধ্বংসের এই বিপুল পরিমাণ কার্যকরী অস্ত্রকে নিজের দেশের সরকার ও নিজের দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ কর। … ”
————- (দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ পর্ব, পরিচ্ছদ এক)

পরে এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় আরেক বলশেভিক পথের সৈনিক, ইউক্রেনীয় গারানজার কথায়, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যে গ্রিগোরির দোস্ত বনে গিয়েছিল — “সাধারণ মানুষ বয়রা — কানে শোনে না। যুদ্ধে তাগো ঘুম ভাঙব। কালা মেঘ থাইক্যাই বজ্রবিদ্যুতের শ্যেষে ঝড়বৃষ্টি লামে। …”
বুনচুক যখন অফিসারদের পড়ে শোনাচ্ছে লেনিনের প্রবন্ধ, সেটাও রাজনৈতিক। কেন সে অফিসারদের, যারা কি না নির্ধারকভাবে পুরনো জমানার পক্ষের লোক, তাদের এসব পড়ে শোনাচ্ছে। কারণ সে ইচ্ছে করে নিজের পরিচয় দিয়ে দিচ্ছে অফিসার মহলে। তারপর পালাচ্ছে। উদ্দেশ্যটা কী? অফিসাররা একথা সেনাবাহিনীর ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানালো, সেনাবাহিনীর ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে বুনচুকের মেশিনগান ব্রিগেডের সমস্ত সৈনিককে বিভিন্ন ফ্রন্টে বদলি করে দিল। কারণ, হয়ত এর মধ্যে তাদের মাথা খেয়েছে বলশেভিক বুনচুক, এবং এতগুলো মাথা খাওয়া মেশিনগানার যদি একসাথে এক ইউনিটে থাকে, তাহলে যে কোনো সময় তারা ‘শ্রেণীশত্রু’ অফিসারদের খতম করে দিতে পারে। ভয়টা এখানেই। … কিন্তু এটাই তো চাইছিল বুনচুক। সে মেশিনগানারদের মধ্যে বলশেভিজমের বীজ বুনে দিয়েছে। এবার তারা ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন ইউনিটে। সেখানে তারাও বীজ বুনবে। এই জন্যই তো বুনচুকের নিজেকে প্রকাশ করে দেওয়া অফিসার মহলে!
হ্যাঁ, রাজনীতির রেটোরিক বা বাঁধা বুলি নয়, রাজনৈতিক কাজ। সবাই সেই কাজ করে চলে। মতাদর্শের খোলস যখন খসে পড়ে, শ্রেণী ইত্যাদি অবস্থান যখন চালিত করে, সেটাই রাজনৈতিক। কসাকদের বিপ্লবী ফৌজি কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে তাতারস্কির যুদ্ধফেরতাদের মধ্যে থেকে যখন মনোনীত হয় মিতকা-র নামও, তখন তাতারস্কির সবচেয়ে বড়োলোক চাষী মিরোনের ছেলে মিতকা কোরশুনভ বেঁকে বসে। কসাকদের দন ফৌজের আতামান ক্রাসনোভ রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মান আক্রমণকারীদের সাথে হাত মেলায়। লাল ফৌজ যখন কসাকদের অতিরিক্ত ফসল অধিগ্রহণ করছে তখন লাল ফৌজের বিশ্বস্ত সেনাপতি নেতৃত্বলোভী ফোমিন বিদ্রোহ করে লাল জমানার বিরুদ্ধে। লাল ফৌজের বিরুদ্ধে কসাক বিদ্রোহের আঁচ যখন এসে পৌঁছয় তাতারস্কিতে, তখন যুদ্ধফেরতা বলশেভিক দিনমজুর গোলাম, রেল কারখানায় কাজ করা আলেক্সেয়েভিচ, আর মিশকা কশেভয় পালায় — যা সেই সময়ের রাজনৈতিক কাজ। কিন্তু তাদের কসাক ফৌজি বিপ্লবী কমিটির কমরেড গ্রিগোরি, খ্রিস্তোনিয়া ইত্যাদিরা পালায় না, গ্রামে থেকে যায়। গ্রিগোরি গোলামকে ব্যাঙ্গ করে, “তোমার আগুও নেই পিছুও নেই, যেখানে খুশি যেতে পারো। কিন্তু আমাদের ভালো করে ভেবেচিন্তে দেখতে হবে। আমার বৌ আছে, দুটো বাচ্চা আছে। … গোলাবারুদের গন্ধ তোমার চেয়ে আমাকে অনেক বেশি শুঁকতে হয়েছে।” গোলাম বিরক্তি প্রকাশ করে, “ওসব কসাক মেজাজ ছাড় … ছি ছি ছি মেলেখভ।” গোলাম কেন রাজনৈতিক হতে পারে, আর গ্রিগোরি, খ্রিস্তোনিয়া পারে না? —

————–
“আমার যা থাকার সবই আমার সঙ্গে।” গোলাম মুখ বাঁকাল। “কোন চালচুলো নেই, দালানকোঠা জমিদারি কেনার মতো উপার্জনও করি নি! … গত পনেরো দিনের মাইনেটাও পাই নি! তা যাক গে, আমাদের ভুঁড়িওয়ালা মোখভ ওই নিয়ে বড়লোক হােক গে। আমি আমার মাইনে নিই নি দেখে ব্যাটা আনন্দে দু’হাত তুলে নাচবে।”

————-
গৃহযুদ্ধের শেষদিকে ফোমিন-এর ভ্রাম্যমান বিদ্রোহী ফৌজ যখন ধ্বংস হয়ে গেল ফোমিনের বোকামিতে, এবং বেঁচে থাকা পাঁচ জন মিলে দনের মধ্যের একটা দ্বীপে গোপন আশ্রয় নিল, ফোমিনের সহনেতা কাপারিন দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার প্রস্তাব দিল গ্রিগোরিকে, আলাদা করে ডেকে। অজ্ঞাতবাসের কঠিন জীবন ও দল ভেঙে যাওয়ার হতাশা থেকে কাপারিন ধরা দেওয়ার প্রস্তাব দিল এবং বাকিদের (ফোমিন, চুমাকভ ইত্যাদি) মেরে ফেলে, নিজেরা বাঁচার জন্য। যদিও কাপারিন-ই প্রথম ফোমিনকে উসকে ছিল কসাকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফসল জোর করে নিয়ে নেওয়ার বলশেভিক নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য। প্রস্তাব দেওয়ার সময় এলিট ঘরের কাপারিন নিজের সম্বন্ধে দু-এক কথা বলল গ্রিগোরিকে — “আমি এককালে অফিসার ছিলাম। সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী দলের সদস্যও ছিলাম। পরে আমি ভেবেচিন্তে আমার রাজনৈতিক মতামত পুরোপুরি পালটে ফেলেছি। … একমাত্র রাজতন্ত্রই রাশিয়াকে বাঁচাতে পারে। একমাত্র রাজতন্ত্র।” ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গ্রিগোরি তার হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে তাকে তিরস্কার করল, “তোমাদের মতো শিক্ষিত লোকদের কাছ থেকে সবই আশা করা যেতে পারে … একেবারে আসল কালকেউটে তুমি। …” কাপারিন গ্রিগোরির কাছে কান্নাকাটি করায় সে ফোমিনদের কাছে কাপারিনের ফন্দি বলে দিল না বটে, কিন্তু কাপারিনের রাইফেলের চাবি খুলে নিজের কাছে রেখে দিল। পরে কাপারিনকে খুন করার পর গ্রিগোরির কাছ থেকে সব শুনে ফোমিন যখন গ্রিগোরির কাছে জানতে চাইল, কেন সে কাপারিনের অভিসন্ধির কথা বলেনি, তখন গ্রিগোরি বলল, “… ওর ওপর আমার একটু মায়া হয়েছিল বলতে পারো।”
আমার বিচারে গ্রিগোরি হলো সেই চরিত্র, যে না রাজনীতিতে থাকতে পারে, না রাজনৈতিক থাকতে পারে। সে খুবই ব্যক্তিগত সংবেদন দিয়ে চলে। রাজনৈতিক থাকতে না পারার জন্যই সে উপন্যাসের শেষে নিঃস্ব রিক্ত। উপন্যাসের পরতে পরতে সে বিভ্রান্ত একজন মানুষ, কিন্তু তা যে তার রাজনৈতিক থাকতে না পারার জন্য তা সে বোঝে না। নিজের শ্রেণী অবস্থানের কারণে তৈরি হওয়া অভ্যেসগুলোকে সে সমালোচনা করে না কখনো। নিজের অশিক্ষাকে কখনো দোষ দেয় ভুল করে। মতাদর্শ ভিত্তিক রাজনীতির দ্বারস্থ হতে গিয়ে সে কখনো কসাক জাতীয়তাবাদী, তারপর সে গারানজা বা পদতিওলকভের কথায় মেনে গিয়ে বলশেভিক, ফের সে বলশেভিক নৃশংসতার বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়ে কসাক দন ফৌজের সেপাই, আবার তারপর সে সেখান থেকে সটকে পড়ে বলশেভিকদের খপ্পরে, ফের মোহভঙ্গ, সে বিদ্রোহী কসাক নেতা, আবার মোহভঙ্গ এবং কিছুদিন পরে সে ফের লালফৌজে। গৃহযুদ্ধের প্রথম দিকে পদতিওলকভের নৃশংস ভাবে বন্দী অফিসারদের একটা দলকে খুন করে ফেলার ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে লাল ফৌজ ছেড়ে সে যখন চলে আসে, তখন সে একইসাথে রাজনীতির প্রতিও চরম বীতশ্রদ্ধ।

 

সেই বীতশ্রদ্ধা থেকেই সে বিপ্লব ও বলশেভিক সম্পর্কে সন্দিহান। যখন দন ফৌজ থেকে পালিয়ে এসে গ্রামে ফিরে বলশেভিক বন্ধু আলেক্সেয়েভিচের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে, সন্দেহের ও অবিশ্বাসের কথা বলে, তখন শুনতে হয়, ইভান তাকে বলছে, “তুমি বিপ্লবের শত্রুদের মতো কথা বলছ।” ওই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এমনকি গ্রিগোরির আরেক বন্ধু বলশেভিক মিশকা কশেভয়কে পর্যন্ত রাজনীতি সম্পর্কে বিরক্ত করে তোলে — “ধুত্তোর, কী বিচ্ছিরি জিনিস এই রাজনীতি, আলেক্সেইয়েভিচ”, কিন্তু মিশকা সেই সময়ের রাজনৈতিকতাটি দ্রুত ধরে নেয়, “এখানে, এই যুদ্ধে ভাই বন্ধু বলে কিছু নেই। একটা পথ বেছে নাও — তারপর সিধে চল!” কিন্তু গ্রিগোরি নিতে পারে না। তাই সে বিদ্রোহী কসাক অফিসার হয়েও ছোটোবেলার বন্ধু মিশকা বা আলেক্সেয়েভিচকে বাঁচানোর জন্য ফ্রন্ট ছেড়ে দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে আসে গ্রামের দিকে। কিন্তু পরে লাল ফৌজের জমানা গেঁড়ে বসার পর মিশকা গ্রিগোরিকেই জরুরি কমিশনের হাতে তুলে দিতে তৎপর হয়। তাই বলে এই নয় যে গ্রিগোরি মারাত্মক মানবিক। তার জাহাজীদের কুপিয়ে মারা, একসময়ের রেড আর্মির দোস্ত পদতিওলকভের মৃত্যুদণ্ডে পদতিওলকভকে নিষ্ঠুরভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে পদতিওলকভও বন্দী অফিসারদের মেরে ফেলেছিল, লিস্তনিৎস্কির আত্মহত্যার খবরে বিচলিত না হওয়া — এগুলোর মধ্যে মানবিক নয়, মানুষিক গ্রিগোরির দেখা মেলে। রাজনীতিতে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়ে গ্রিগোরি একসময় সিদ্ধান্ত করে নেয়, জীবনে একমাত্র সত্য বলে কিছু নেই, প্রত্যেকের সত্য প্রত্যেকের নিজস্ব — “ওরা লড়াই করছে যাতে ওদের নিজেদের জীবন ভালো হয়, আমরা লড়েছি আমাদের ভালোর জন্য। জীবনে একমাত্র সত্য বলে কোনো সত্য নেই। দেখা যাচ্ছে যে যার ওপর জেতে তাকে গিলে খায়। …আমি যে সত্য খুঁজতে গিয়েছিলাম সেটা নেহাৎই বাজে। তার জন্যে মনে দুঃখ পেলাম, এপথে ওপথে ঘুরে বেড়ালাম। …”
গ্রিগোরির এই অরাজনৈতিক, অরাজনীতিক, মানুষিক ও ব্যক্তিগত সংবেদন ভিত্তিক পথচলার ভ্রান্তিটি উপন্যাসের বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে। কিন্তু তা তুলে ধরেও কোথাও যেন লেখক শোলকভ নিজেই দুর্বল হয়ে যান মানুষ গ্রিগোরির প্রতি। তাই হয়ত শেষ পৃষ্ঠায় গ্রিগোরিকে ফিরিয়ে আনেন গ্রামে, নিজের ঘরের সামনে, দিনের বেলায়, কোলে তুলে দেন ছেলে মিশাতকাকে। আমরাও প্রায় প্রেমে পড়ে যাই গ্রিগোরির। তার অপর-এর প্রতি অপার কৌতুহলের। তার সত্য খুঁজতে চাওয়ার। যা রাজনীতি তো বটেই, এমনকি রাজনৈতিককেও ছাপিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখায়।
কিন্তু শোলকভের রোমান্টিক সংলগ্নতা রাজনৈতিকের প্রতি। অথবা বলা ভালো — একই সাথে যে রাজনৈতিক এবং মানবিক — তার প্রতি। উপন্যাসে সেই একমাত্র চরিত্র মোখভের আটাকলের মজুর গোলাম (না, বুনচুক বা স্টকম্যান-ও তা নয়)। তাই গোলামের বন্দী অবস্থায় পেছন থেকে গুলি খেয়ে অনাড়ম্বর মৃত্যুর বর্ণনার পরে তার কবরের বর্ণনায় তৈরি করেন স্বর্গীয় সুষমা —

——————
দু সপ্তাহের মধ্যে কচি সোমরাজগুল্ম আর বুনোঝোপে ঢেকে গেল ছোট্ট টিবিটা। টিবির মাথায় দুলতে লাগল বুনো জইয়ের ডাঁটা, একপাশে সরষে জাতীয় গাছের ফুলে ফুলে জমকাল হলুদ রং ধরল, এখানে ওখানে ফুত্‌নার মতো ঝুলতে লাগল রঙবেরঙের নানা ফুল। ‘টিম’ লতা ‘স্পার্জ’ আর অন্যান্য মিষ্টি লতাপাতার গন্ধে বাতাস ভরে উঠল। এর কিছুকাল পরেই কাছের এক গ্রাম থেকে এক বুড়ো সেখানে এসে হাজির হল। কবরের মাথার ওপর গর্ত খুঁড়ে সদ্য চাঁছা ওকগাছের একটা খুঁটি পুঁতে তার ওপর এক ভজনালয় খাড়া করল। ভজনালয়ের তিনকোনা চালার নীচে অন্ধকারের মধ্যে মৃদু দীপ্তি দিতে লাগিল দেবজননীর বিষাদপ্রতিমা । নীচে, চালের কার্ণিশের গায়ে কলো রঙের প্রাচীন স্লাভনিক অক্ষরে সুন্দর কারুকাজ করে লেখা একটা বাণী :
অনাচারে যবে সব যায় রসাতলে,
সেদিন কি ভাই ভায়ের বিচার চলে ?
বুড়ো ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল। কিন্তু স্তেপের উন্মুক্ত প্রাস্তরে সেই ভজনালয় তার চিরন্তন বিষণ্ণ রূপ নিয়ে রয়ে গেল – যারাই ওই পথ দিয়ে যাবে তাদের চোখে ধরিয়ে দেবে বিষাদের ঘন ছায়া, মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলবে এক অস্পষ্ট অব্যক্ত আকুলতা।
তারও পরে সেই মে মাসেই ভজনালয়ের সামনে দুটাে পুরুষ-তিতির মারামারি করতে লাগল, পাকা শ্যামাধানের শ্যামল রাশি তছনছ করে নীল সোমরাজ ঝোপের মধ্যে সঙ্গিনীর অপেক্ষায় খানিকটা ফাঁকা জায়গা করে ফেলল। মাদী পাখির জন্য, বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য, প্রেম-ভালোবাসা আর বংশবৃদ্ধির অধিকারের জন্য তারা লড়াই করে চলল। তারও কিছুকাল পরে ওই ভজনালয়েরই সামনে লম্বা লম্বা ঘাসের গোছা আর বুড়ো ঝাঁকড়া সোমরাজের আচ্ছাদনের নীচে মাদী তিতির ধোঁয়াটে নীল ছিটছিট নয়টা ডিম পাড়ল, চকচকে পালকভর্তি ডানার আড়ালে ঢেকে, নিজের দেহের উষ্ণতা দিয়ে তা দিতে বসল সেই ডিমের ওপর।
——————- (দ্বিতীয় খণ্ড, পঞ্চম পর্ব, পরিচ্ছদ বত্রিশ)

১১) ঔপন্যাসিক কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন

উপন্যাসের তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড, অর্থাৎ যখন কসাক বিদ্রোহের কথা শুরু হলো, সেগুলো ছাপানো সোজা হয়নি শোলকভের। শোলকভের মেন্টর ও উৎসাহদাতা এবং প্রথম দুটি খণ্ড ছাপানোর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যার উদ্যোগ ছিল, সেই বিখ্যাত সোভিয়েত লেখক সেরাফিমোভিচ বৃদ্ধ ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শোলকভের প্রতি রাশিয়ার প্রলেতারিয়ান লেখক সংঘ মোটেই সদয় ছিল না। প্রশান্ত দন-এর প্রথম দুটি খণ্ড পড়ে তারা রায় দিয়েছিল — কৃষক লেখক, প্রলেতারিয়ান আদর্শে শিক্ষিত করে তোলা দরকার একে। কিন্তু তৃতীয় খণ্ডে ভিওশেনস্কায়ার কসাক বিদ্রোহের শুরু ও তার বর্ণনা পড়ে সরাসরি উপন্যাসটা ‘ভিওশেনস্কায়া বিদ্রোহ’কে ন্যায্যতা দিচ্ছে বলে ‘অক্টোবর’ পত্রিকা তা আর ছাপতে চাইল না। বই হিসেবে তো আরো ছাপা যাবে না, জানিয়ে দিল তারা। অক্টোবর-এর সম্পাদক ফাদিভ জানিয়ে দিলেন, গ্রিগোরির চরিত্রে যদি এই এই পরিবর্তন না করা হয়, তাহলে ছাপা যাবে না। সেটা ১৯৩০ সাল। ফলে শোলকভ পরের দিকের অংশগুলি ছাপতে লাগলেন অনামী বিভিন্ন প্রকাশনায়, ‘ক্রাসনায়া নিভা’, ‘অগন্যক’, ‘ত্রিশ দিন’ ইত্যাদি। অক্টোবর পত্রিকা থেকে ফাদিভ সরে গেলে ফের প্রশান্ত দনের বাকি অংশ সেখানে ছাপানোর জন্য পাঠালেন শোলকভ। কিন্তু নয়া সম্পাদকও ছাপতে চাইল না। শোলকভ তখন মহামতি গোর্কির কাছে পাঠালেন উপন্যাসের প্রকাশিতব্য অংশ, সঙ্গে একটি চিঠি, যাতে বলা ছিল, কেন এই উপন্যাসটা ‘ভিওশেনস্কায়া বিদ্রোহ’কে জাস্টিফাই করছে না। গোর্কির উপন্যাসটা পড়ে ভালো লাগলো না, প্রচুর আদর্শনৈতিক সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেলেন তিনি উপন্যাসে, কিন্তু তবুও মত দিলেন, উপন্যাসটা এতটুকু কাটছাঁট না করে ছাপা হোক। কিন্তু তবুও অক্টোবর পত্রিকা ছাপলো না। অবশেষে ১৯৩১ সালের জুলাই মাসে শোলকভ গোর্কির মধ্যস্থতায় সর্বাধিনায়ক স্তালিনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান, এবং মনে করা হয়, স্তালিনের হস্তক্ষেপেই উপন্যাসটি বই আকারে ছাপার ব্যবস্থা করা হয়। শোনা যায় স্তালিন নাকি বলেছিলেন, ‘উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডে যে ঘটনাপ্রবাহ দেখানো হয়েছে, তা আমাদের বিপ্লবের পক্ষে। এটা ছাপানো হোক’। ফলে ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ফের অক্টোবর পত্রিকায় বেরোতে শুরু করল প্রশান্ত দন, ষষ্ঠ পর্বের ১৩ নম্বর পরিচ্ছদ থেকে। যদিও পরে বই হয়ে বেরোনোর সময় শোলকভকে বেশ কিছু পরিবর্তন করতে হলো তৃতীয় খণ্ডে, যাতে লালদের কিছুটা ভালো এবং সাদাদের কিছুটা খারাপ ভাবে দেখানো হয়, যাতে লাল বনাম সাদা বা সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র বনাম কসাক — এই বিরোধের বদলে গরীব বড়োলোকের বিভাজনটা বেশি দেখানো হয়। তথাপি বই থেকে বাদ গেল ২৩ নম্বর পরিচ্ছদ, যেখানে পেত্রো গ্রিগোরির শ্বশুর মিরোন কোরশুনভের গুলি খাওয়া লাশ উদ্ধার করে আনে; ৩৯ নম্বর পরিচ্ছদে যেখানে লাল ফৌজের কমিশনার মালকিন দাড়ি রাখার অপরাধে লিনিওক নামে এক বুড়োকে গুলি করে মেরে ফেলার হুকুম দিয়েছিল বলে একটা গল্প শোনানো হয় মিশকা আর স্টকম্যানকে; ইত্যাদি আরো কিছু কিছু।
চতুর্থ খণ্ড লেখার কাজ করতেই শোলকভের ৬ বছর সময় লেগেছিল। অন্তত ৬-৭ বার নাকি বদলেছিল সে পাণ্ডুলিপি। পরে সে স্তালিনকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, ভিওশেনস্কায়ার পরিস্থিতি এত খারাপ যে সে লিখে উঠতে পারছে না। উল্লেখ্য, শোলকভ থাকত ভিওশেনস্কায়ায়। ফের স্তালিনের প্রত্যক্ষ মদতে সে ছাড় পায়। ভিওশেনস্কায়া ফিরে ১৯৩৮ সালে শোলকভ চতুর্থ খণ্ডের অষ্টম পর্ব লেখা শুরু করে। উল্লেখ্য, চতুর্থ পর্বে সপ্তম ও অষ্টম দুটি পর্ব। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে উপন্যাসটা লেখা শেষ করে শোলকভ। ওই বছরের প্রথম দিকে সে ‘অর্ডার অব লেনিন’ প্রাইজ পায়।

(এই ঘটনাগুলোর কথা আমি জানতে পেরেছি উইকিপিডিয়ার রাশিয়ান এডিশনের ‘প্রশান্ত দন’ পৃষ্ঠাটি থেকে। মেশিনে ইংরাজি অনুবাদটি পড়েছি। )
তবে যাই হোক, আমাদের ‘প্রশান্ত দন’ বাংলা অনুবাদ শোলকভের মূল লেখার অনুবাদ। সেখানে কিছুই বাদ যায়নি।
১২) কেন সোভিয়েত বিপ্লবের শতবর্ষে এই উপন্যাসটা পড়া দরকার
উপন্যাসটা আমি প্রথম পড়েছিলাম বছর কুড়ি আগে। তখন সোভিয়েত সাহিত্যের আরো বেশ কিছু কিছু পড়েছিলাম। লেনিনের লেখাপত্রও (এবং মার্ক্সের) বেশ কিছু পড়েছিলাম তখন। বয়সের তুলনায় সে বিষয়ে বেশ পাকা-ই ছিলাম। তারপর কমিউনিস্ট বিপ্লব সম্পর্কে কৌতুহলের চেয়ে আমার কৌতুহল বাড়ল সমাজ সংসারকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার প্রতি। গত প্রায় দশ বছর ধরে সেই জানা চেনার পর, যখন সোভিয়েত বিপ্লবের শতবর্ষ নিয়ে কিছু লেখার ডাক পেলাম, আমার প্রথমেই মনে পড়ল এই বইটার কথা।
যেকোনো বড়োসরো ঘটনার কষ্টিপাথর কী? এককথায় বললে জনসমাজ। সেই জনসমাজের ভালো মন্দের মধ্যে দিয়েই বিচার করতে হয় সেই ঘটনাকে। সোভিয়েত বিপ্লবও তার ব্যতিক্রম নয়। নিঃসন্দেহে এই বিপ্লবে রাশিয়ার নিপীড়িত শ্রেণীগুলির উত্থান হয়েছিল। কিন্তু বৈচিত্র্যময়, নানাবিধ সমাজ বৈশিষ্ট্যের রাশিয়ায় বিপ্লব সব জায়গাতে নিপীড়িতের সংগ্রামের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে আসেনি, এসেছিল ধাক্কা হিসেবে। নয়া ক্ষমতা তুফানের মতো ভু-পাতিত করে দিয়ে গিয়েছিল কসাক সমাজকে। তখন হয়ত দুনিয়াজুড়ে পরিবর্তনকামী মানুষরা তাকে মনে করেছিল ইতিহাসের চাকা। কিন্তু আজ শতবর্ষ পরে যখন দুনিয়া থেকে কমিউনিস্ট বিপ্লব ও কমিউনিস্ট জমানা অন্তর্হিত; যখন সম্পদের বন্টনের অসমানতা সারা বিশ্বজুড়েই ঐতিহাসিক সর্বোচ্চ মাত্রার দিকে ছুটছে দ্রুত গতিতে (পিকেটি-র ফরাসিতে লেখা বই ‘একবিংশ শতকে পুঁজি’ (২০১৩)); যখন একশ’ বছর আগে বিত্তের বন্টনের সমতার লক্ষ্যে ঘটা বিপ্লবকে ব্যঙ্গ করে রাশিয়া আজ দুনিয়ায় একনম্বর, মহাধনীদের (১ শতাংশ) হাতে সম্পদের ঘনীভবনে (৭৪.৫ শতাংশ) (ক্রেডিট সুইস-এর ২০১৬ সালের রিপোর্ট); তখন সেই বিপ্লবকে তো ‘কী পেলাম’ তার নিরিখে বিচার করতেই হবে। এবং তা করতে হবে নেতিবাচক কোনো অবস্থানে (যেমন ‘কমিউনিস্ট বিরোধী’, ‘পরিবর্তন বিরোধী’, ‘যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ’ ইত্যাদি) না গিয়েই।
এক তো সোভিয়েত বিপ্লব-কে ফিরে দেখার জন্য। আরও একটা কারণে এটা অবশ্যপাঠ্য — তা হলো, রাজনীতির আড়াল থেকে রাজনৈতিক-কে খুঁজে নেওয়ার জন্য। যার আলোচনা আমি করেছি লেখাটির মধ্যে। মোটামুটি রাজনীতির এখন ঘোরতর বদনাম, যত দোষ নন্দ ঘোষ, এবং অরাজনীতি ও ব্যক্তিগত সংবেদনের মারাত্মক ক্রেজ। রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত সংবেদন — এই দুটি ভ্রান্তির মধ্যে থেকে এবং ওই দুটি থেকেই রসদ নিয়ে পথ তৈরি করে রাজনৈতিক।
আরো একটা কারণে বইটি অবশ্যপাঠ্য। কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দিয়েই তো আমরা কমিউনিজমের ধারনায় সমাজবদলের কথাগুলোকে চিনি। এবার পার্টি ও ব্যক্তির ভালো মন্দের সাথে সাথে কমিউনিজমের কথাগুলোও ভালো বা মন্দ হয়ে যায়। তত্ত্বের বই পড়ে ভালো বোঝা যায় না সবকিছু। প্রশান্ত দন -এ কমিউনিজমের ধারনায় সমাজবদলের কিছু জ্যান্ত উদাহরণ আছে ঘটনাবলী, কথোপকথন ও গল্পের মধ্যে দিয়ে। আপনি কমিউনিস্ট হোন বা না হোন, একেবারে ‘স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে’ মার্কা যদি না হোন, তাহলে কমিউনিজমের ধ্যানধারনাগুলি ভালো করে জানলে অপকৃত হবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *