বিজেপির কারণ (১) : — পুরুষের প্রতিক্রিয়া

শমীক সরকার

সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের নেপথ্যের নেপথ্যে কী? নির্বাচন মানে ভোট। সেই ভোট তৈরি হয়। ভোট তৈরি হয় সমাজে। ভোট গঠনে ভূমিকা নেয় সামাজিক টানাপোড়েন। নানা পার্টির মধ্যের নানা সমীকরণ, প্রচার, টাকা, প্রশাসন — এসব তো আছেই। আছে মানুষের প্রতিনিধি নির্বাচনের বদলে শাসক নির্বাচন, যেহেতু আমাদের দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোটির বেশিরভাগটাই ওপর থেকে চাপানো, মানুষের অর্জন নয়। প্রতিনিধির বদলে শাসক নির্বাচন, সমীকরণ, সরকারের ভূমিকা, প্রশাসন, প্রচার, টাকা — এসবের কারণেই একটা লোকের একটা ভোটের যদি আশি শতাংশ বানানো হয়, তবুও কুড়ি শতাংশ তার সামাজিক টানাপোড়েনের গঠন। একটা মানুষের একটা ভোটের এই কুড়ি শতাংশই আমাদের মাথাব্যাথার বা ইন্টারেস্টের কারণ, বাকি আশি শতাংশ নিয়ে আমাদের ইন্টারেস্ট নেই, কারণ তা আমাদের আওতায় নেই।

একটা মানুষের একটা ভোটের এই কুড়ি শতাংশ কেন বিজেপি হতে পারে? হচ্ছে? তার নেপথ্যের নেপথ্যে কী তা খুঁজতে গিয়ে যা যা পেলাম, তার কয়েকটা উল্লেখযোগ্য দিক আছে। একটি কারণ, ওই শিরোনামে যা আছে, পুরুষের প্রতিক্রিয়া। আসুন দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে জন্ম নিচ্ছে এই পুরুষের প্রতিক্রিয়া। তার নেপথ্যে কী আছে?

১) উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়া

বিশ্বায়নের সময় থেকেই আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের দ্রুত অন্তর্ভুক্তি শুরু হতে থাকে। সাধারণতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়, ১৯৫০-৫১ সালে যখন কলেজে প্রতি ১০০ জন কলেজছাত্রছাত্রীর মধ্যে সাকুল্যে ১১ জন ছিল মেয়ে, বাকি ৮৯ জন ছেলে; সেই অবস্থাটি বদলাতে বদলাতে, মানে মেয়েদের কলেজছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মেয়েদের অংশীদারী বাড়তে বাড়তে ১৯৯০-৯১ তে এটা পৌঁছয় ৩১ শতাংশে। অর্থাৎ কলেজছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৬৯ জন ছেলে আর ৩১ জন মেয়ে। দশক পিছু বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ৫ শতাংশ-বিন্দুর মতো। সেই অংশীদারী এই ২০১৭-১৮ তে পৌঁছেছে প্রায় ৪৮ এ। অর্থাৎ এখন কলেজছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৫২ জন ছেলে ৪৮ জন মেয়ে। গত প্রায় তিন দশকে সেটার দশক পিছু বৃদ্ধির গড় হার ছিল ৬ শতাংশ-বিন্দুর বেশি। ২০০০-২০০১ থেকে ২০১০-২০১১ এই দশকে বৃদ্ধির দশক পিছু হার সাত শতাংশ-বিন্দুর বেশি (সারণী-১)। যদিও যুবক যুবতীদের মধ্যে কলেজ ভর্তির হার এখনও যথেষ্ট কম, ২০১৭-১৮ সালে ১৮-২৩ বছর বয়সীদের মধ্যে এখনও মাত্র উচ্চশিক্ষার কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ভর্তির হার (GER) ছিল ২৫.৮ শতাংশ। তবে এই হার প্রতি বছরই বাড়ছে, ২০০৩-৪ এ GER ছিল এখনকার অর্ধেক, মাত্র ১৩.২২ শতাংশ। এবং এখনও যুবকদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির হার (২৬.৩ শতাংশ) যুবতীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির হার (২৫.৪ শতাংশ) এর তুলনায় এখনও কিছুটা বেশি, কিন্তু যদি অতীত দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে, এমনকি ২০১০-১১ সালেও যুবক ও যুবতীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির হারের তফাত ছিল প্রায় ৩ শতাংশ-বিন্দু (যথাক্রমে ২০.৮ এবং ১৭.৯), তা এই ২০১৭-১৮ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১ শতাংশ-বিন্দু-রও কম-এ (সারণী-২)। এ থেকেই বোঝা যায়, বিশ্বায়নের সময়সাময়িক দুই দশক (৮০ ও ৯০ এর দশক) এবং তার পরবর্তী গত দুই দশক ধরে মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় অভূতপূর্ব অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উল্লেখ্য, উচ্চশিক্ষায় অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত প্রায় এক দশকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকশিক্ষিকার মধ্যে মেয়েদের হার এবং শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে মেয়েদের হারও উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। ২০১০-১১ সালে শিক্ষক ও শিক্ষিকার অনুপাত ছিল ৬৩ : ৩৭। আর ২০১৭-১৮ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ৫৮ : ৪২ । ২০১০-১১ সালে প্রতি ১০০ জন পুরুষ অশিক্ষক শিক্ষাকর্মী পিছু মহিলা কর্মী ছিল ৩০ জন। ২০১৭-১৮ তে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি ১০০ পুরুষ কর্মী পিছু ৪৭ জন মহিলা কর্মী।

সারণী — ১

সাল উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের অংশীদারী (ছাত্রী শতাংশ)
১৯৫০-৫১ ১১.৫ দশক-পিছু শতাংশ-বিন্দু বৃদ্ধি
১৯৬০-৬১ ১৭.৪ ৫.৮
১৯৭০-৭১ ২১.৯ ৪.৫
১৯৮০-৮১ ২৬.৫ ৪.৬
১৯৯০-৯১ ৩১.৫
২০০০-০১ ৩৬.৭ ৫.২
২০১০-১১ ৪৩.৮ ৭.১
২০১৭-১৮ ৪৭.৬
২০২০-২১ ৪৯.৩ (সাম্ভাব্য) ৫.৫

সারণী-২

সাল GER (ছেলে) (শতাংশ) GER (মেয়ে)(শতাংশ) ছেলে মেয়ের ফারাক (শতাংশ-বিন্দু)
২০১০-১১ ২০.৮ ১৭.৯ ২.৯
২০১১-১২ ২২.১ ১৯.৪ ২.৭
২০১২-১৩ ২২.৭ ২০.১ ২.৬
২০১৩-১৪ ২৩.৯ ২২ ১.৯
২০১৫-১৬ ২৫.৪ ২৩.৫ ১.৯
২০১৬-১৭ ২৬ ২৪.৫ ১.৫
২০১৭-১৮ ২৬.৩ ২৫.৪ ০.৯
GER হল গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও (১৮২৩ বছর বয়সীদের মধ্যে কতজন উচ্চশিক্ষার কোনো না কোনো ক্ষেত্রে (কলেজ, ইউনিভার্সিটি, ইনস্টিটিউট, এবং আন্ডার গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, পিএইচডি) ভর্তি হয়েছে)

বিঃ দ্রঃ ওপরের সূত্রগুলি হল ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের উচ্চশিক্ষা সমীক্ষার বাৎসরিক রিপোর্টগুলি। aishe.nic.in তে পাওয়া।

উচ্চশিক্ষা বা কলেজশিক্ষা শুধু শিক্ষাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য উল্লেখযোগ্য, তা নয়। তা বরং অন্য নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকলে আর ইউনিফর্ম পড়তে হয় না সাধারণতঃ। কলেজে ঢুকলে যেটা মেলে, তা হল স্বাধীনতা। নিজের মতামত। আত্মবিশ্বাস। তাই উচ্চশিক্ষার শিক্ষার চেয়ে অনেক বড় সামাজিক ভূমিকা রয়েছে আমাদের দেশে। নিজের বাসনার কিছুটা হলেও মেটে কলেজে গেলে। এই কলেজ জনতার মধ্যে মেয়েদের অনুপাত ছেলেদের তুলনায় সামান্য থেকে সমান সমান হয়ে যাওয়ারও তাই সামাজিক প্রভাব আছে। যে শিক্ষা-স্বাধীনতার একমাত্র হকদার ছিল ছেলেরা, শিক্ষিত মানুষ বলতে মনের মধ্যে ছুপিয়ে থাকত পুরুষের মুখ, সেই ঐতিহ্যে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে মেয়েরা। ছেলেদের বেশি জানা বেশি বোঝা এবং বেশি এক্সপোজারের গুমর আর থাকছে না। মেয়েরাও আর ছেলেদের আদরের জানু থাকছে না, যেখানে মেয়েরা ‘নেবে’ আর ছেলেরা ‘দেবে’। মেয়েরা কুঁইকুঁই করবে, ছেলেরা তাদের রক্ষা করবে। ছেলেরা মেয়েদের থেকে যে নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং নির্ভরতা প্রত্যাশা করত, তার যে অনেকটাই মেয়েদের পূর্বেকার অসহায়তা প্রসূত, তা হাড়ে হাড়ে বুঝছে। শিক্ষিত ছেলেদের সমাজে এক্সট্রা হাবভাবে চোনা লাগছে। এসে গেছে শিক্ষিত মেয়ে। এবং তা সমানে সমানে প্রায়।

মেয়েদের উচ্চশিক্ষাজগতে এই হইহই করে ঢুকে পড়া শিক্ষিত তথা শিক্ষার কদর করা পুরুষ সমাজে একটা গোপন ত্রাসের সঞ্চার করেছে। সে পড়েছে সঙ্কটে, এতদিনকার গরিমা হারিয়ে। গঠন হয়েছে পুরুষ প্রতিক্রিয়া।

মেয়েদের এই উচ্চশিক্ষাজগতে হইহই করে ঢুকে পড়া কি শুধু মেয়েদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সম্ভব হয়েছে? না। শুধু সরকারি উদ্যমে সম্ভব হয়েছে? একেবারেই না। শুধু মিডিয়ার প্রভাবে হয়েছে? না। তবে এই সবেরই ভূমিকা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা আছে কার? অবশ্যই মেয়েদের। মেয়েরা সামাজিক বিষয়ী হিসেবে নিজেরা কলেজে ঢুকেছে। কেউ বলতে পারে, ছেলেদের দেখাদেখি গেছে। যেমন সাধারণতঃ ছেলেরা বলে থাকে ‘আজকালকার’ মেয়েদের কার্যকলাপ সম্পর্কে — মেয়েরা কেন ছেলেদের দেখাদেখি ছেলে সাজতে যাবে? সিগারেট খাবে? উত্তর হল, মেয়েরা যা প্রাণে চায় তা-ই করবে। এখানে মেয়েরা নিজেরা যা প্রাণে চায় তাই একটু একটু করে করতে পেরেছে এই কলেজে ঢুকে পড়ার মধ্যে দিয়ে। কারণ সে ছেলেদের দেখে বুঝে গেছিল, অন্ততঃ কলেজে ঢুকে পড়লে, আরো একটু বেশি যা প্রাণে চায় তা করতে পারবে।

২) মেয়েদের চাকরি

এ তো গেল উচ্চশিক্ষার কথা, যেখানে ঢুকে পড়া মেয়েদের বেশ খানিকটাই নিজের হাতে ছিল। এবার আসা যাক চাকরির কথায়। আপাতদৃষ্টিতে রোজগেরে মেয়ে যেন কমেছে গত কয়েক বছরে। অন্ততঃ এনএসএস-এর পর্যায়ক্রমিক সমীক্ষা সেই কথাই বলে। কিন্তু শুধু কি তাই? এনএসএস এর সমীক্ষা থেকেই পাওয়া যায় নিম্নলিখিত টেবিলটি (সারণী – ৩)। স্বনিযুক্তি এবং চুক্তি রোজগারের চেয়ে তুলনায় নিরাপদ এবং নিয়মিত রোজগার বা চাকরিতে শিফট করেছে মেয়েরা। শহরের ক্ষেত্রে ১৯৮৭-৮ সালে কর্মরতা মেয়েদের যত শতাংশ চাকরি করত, ২০১৭-১৮ তে সেই শতাংশ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এবং ভুললে চলবে না, এই সময়কালে শহরের জনসংখ্যাও বেড়েছে গ্রামের তুলনায় এবং এখন ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ শহরবাসী, গ্রামবাসী নয় [এডিট : আংশিক সময়ের অভিবাসন ধরে]। স্বনিযুক্তি হল কৃষিকাজ সহ ঘরোয়া কাজ। সেই কাজে যুক্ত থাকা মেয়েদের (ঘরের পুরুষদের তুলনায়) স্বাধীন ও স্বাবলম্বনের মনোভঙ্গী তৈরি করে না। কারন এগুলো ঘরের পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল। না তাদের অর্থনৈতিকভাবে জোরালো পায়ে দাঁড় করায় যেখান থেকে তারা ঘরের পুরুষদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। ক্যাজুয়াল কাজও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে অক্ষম।

কেন ঘরের পুরুষদের তুলনায় স্বাধীন ও স্বাবলম্বনের মনোভঙ্গীর কথা বললাম? কারণ, মহিলাদের পুরুষের অধীনতা মূলতঃ ঘরে বা চেনা পুরুষদের কাছে। মহিলাদের চেনা মহল বা সমাজ হল পুরুষতান্ত্রিক, মানে যেটাকে স্বাভাবিক সমাজ বলে মনে হয়, সেটা গোটাটাই পুরুষটির কথা ভেবে পুরুষটির বানানো। তাই মেয়েদের স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বনের প্রাথমিক বাধা ঘরের পুরুষরা, চেনা পুরুষরা। তার কাছের সমাজ। সেখানে চোখে চোখ রেখে কথা বলার স্পর্ধা তৈরি হওয়া, সেখানে আপন বাসনার প্রকাশ, সেই চেনা সমাজ-কে নিজের (মেয়েদের) সুবিধা অসুবিধা বিচার করে পুনর্গঠন করা — এটাই পুরুষতন্ত্র বলা হোক বা পিতৃতন্ত্র বলা হোক, তার বিরুদ্ধে আঘাত এবং ঠিক এই জায়গাতেই ছেলেদের সাথে মেয়েদের সংঘর্ষের জায়গা। ঠিক এই জায়গাতেই মেয়েদের সক্ষমতা ছেলেদের বিচলিত করে। নিচের টেবিলটা (সারণী-৩) ভালো করে খেয়াল করুন। ১৯৯৯-২০০০ সালে শহরে রোজগেরে পুরুষদের মধ্যে ৪১.৭ শতাংশ ছিল চাকরিরত (ব্র্যাকেটের মধ্যে সংখ্যাটা দেওয়া আছে)। তখন শহরে রোজগেরে মহিলাদের মধ্যে ৩৩.৩ শতাংশ ছিল চাকরিরত। আর ২০১৭-১৮ সালে শহরে রোজগেরে পুরুষদের মধ্যে ৪৫.৭ শতাংশ চাকরিরত, কিন্তু রোজগেরে মহিলাদের মধ্যে শতাংশের মাত্রাটা বেড়ে হয়েছে ৫২.১ শতাংশ, অর্থাৎ পুরুষের শতাংশকে ছাপিয়ে গেছে, এবং শহরের মোট রোজগেরে মহিলাদের বেশিরভাগই এখন চাকরিরত। যদিও এখনো (২০১৭-১৮) শহরে রোজগেরে পুরুষের (মোট শহরবাসী পুরুষের ৫৭ শতাংশ) তুলনায় রোজগেরে মহিলা (মোট শহরবাসী মহিলার ১৫.৯ শতাংশ) অনেক কম, তিন ভাগের এক ভাগও নয় (এবং এই অনুপাত ও শতাংশগুলি বিশ্বায়নের প্রথম দশকেও প্রায় একইরকম ছিল (১৯৯৩-৯৪ — পুং ৫৪ ম ১৬.৫; ১৯৯৯-২০০০ — পুং ৫৪ ম ১৪.৭)), তবু এটা স্পষ্ট যে স্বনিযুক্ত বা ক্যাজুয়াল রোজগারের মাধ্যমে পুরুষের সংসারে ফুটিফাটা ঢাকা দেওয়ার কাজের বদলে শহরের মেয়েরা স্বাবলম্বনের জন্য স্বাধীনতার জন্য চাকরি করতে চাইছে এবং এই প্রবণতা একটি ক্ষুদ্র হলেও বাসনায় খুব শক্তিশালী একটি মেয়ে সমাজ তৈরি করে দিচ্ছে, যা ছেলেদের অস্বস্তির কারণ হচ্ছে।

সারণী-৩ রোজগেরে মহিলাদের কাজ বা চাকরির ধরন, মূল রোজগার ও আংশিক রোজগার মিলিয়ে

শহরের মহিলা (শতাংশ) শহরের মহিলা (শতাংশ) শহরের মহিলা (শতাংশ) গ্রামের মহিলা (শতাংশ) গ্রামের মহিলা (শতাংশ) গ্রামের মহিলা (শতাংশ)
সাল চাকরি স্বনিযুক্তি ক্যাজুয়াল চাকরি স্বনিযুক্তি ক্যাজুয়াল
১৯৮৭-৮৮ ২৭.৫ ৪৭.১ ২৫.৪ ৩.৭ ৬০.৮ ৩৫.৫
১৯৯৩-৯৪ ২৮.৪ ৪৫.৮ ২৫.৮ ২.৭ ৫৮.৬ ৩৮.৭
১৯৯৯-২০০০ ৩৩.৩ (পুং ৪১.৭) ৪৫.৩ ২১.৪ ৩.১ ৫৭.৩ ৩৯.৬
২০০৪-০৫ ৩৫.৬ ৪৭.৭ ১৬.৭ ৩.৭ ৬৩.৭ ৩২.৬
২০০৯-১০ ৩৯.৩ ৪১.১ ১৯.৬ ৪.৪ ৫৫.৭ ৩৯.৯
২০১১-১২ ৪২.৮ ৪২.৮ ১৪.৩ ৫.৬ ৫৯.৩ ৩৫.১
২০১৭-১৮ ৫২.১ (পুং ৪৫.৭) ৩৪.৭ ১৩.১ ১০.৫ ৫৭.৭ ৩১.৮

(সূত্র : শর্মা ও সাহা, The NEHU Journal, Vol XIII, No. 2, July-December 2015, pp-17-30, এবং ১৯৯৯২০০০ ও ২০১৭১৮ র এনএসএস রিপোর্ট)

বিশ্বায়নের সময় থেকে ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে উচ্চশিক্ষায় ছেলেদের সঙ্গে প্রায় একাসনে এসে যাওয়া এবং চাকরিক্ষেত্রে ভাগ বসানো — এই দুইয়ের মাধ্যমে মেয়েদের, বিশেষতঃ শহরবাসী মেয়েদের (আবার মনে করিয়ে দিই, এখন ভারতে গ্রামবাসীর তুলনায় শহরবাসী বেশি এবং সংখ্যাটা বাড়ছেই [এডিট : আংশিক সময়ের অভিবাসন ধরে]) খুব ছোট্ট হলেও নিজের মতো করে, আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক কিন্তু তলিয়ে দেখলেই পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুনর্গঠনের সক্ষমতা হাজির হওয়া পুরুষের নজর এড়ায়নি। অস্বস্তি বেড়েছে।

এখানে ফের বলা যাক — এই যে চাকরির দুনিয়া, যা কিনা ছিল মূলতঃ পুরুষদের মুক্তাঞ্চল, সেখানে মেয়েদের ভাগ বসানো — এ কি শুধু মেয়েদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সম্ভব হয়েছে? না। শুধু সরকারি উদ্যমে (সংরক্ষণ ইত্যাদি) সম্ভব হয়েছে? একেবারেই না। শুধু মিডিয়ার প্রভাবে হয়েছে? না। তবে এই সবেরই ভূমিকা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা আছে কার? অবশ্যই মেয়েদের। সামাজিক বিষয়ী হিসেবে মেয়েরা চাকরিক্ষেত্রে ভাগ বসাচ্ছে, বসাতে চেয়েছে। এখনও নিঃসন্দেহে অনেকটা পথচলা বাকি আছে, কিন্তু গতি নির্ধারকভাবে ঊর্ধমুখী।

কিন্তু তাহলে ছেলেদের প্রতিক্রিয়া সরাসরি মেয়েদের বিরোধী হচ্ছে না কেন ? হচ্ছে তো। এত বেশি ধর্ষন শ্লীলতাহানির খবর কিসের ইঙ্গিত ? যে সমস্ত মতামত (নারীবাদ, উদারবাদ ইত্যাদি) মেয়েদের এই সামাজিক বিষয়ী হবার বাসনায় মদত দিচ্ছে, সেগুলির প্রতি পুরুষের ঘৃণা কীসের ইঙ্গিত ? পুরুষদের যে এই ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ সুলভ হাকান্দেপনা, তা কীসের ইঙ্গিত ? ফেলে আসা সময়ের পিতৃতান্ত্রিক / পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-পরিবার-পাড়ার আশ্লেষ নয় তো কী? তবে হ্যাঁ, রাজনৈতিকভাবে এই পুরুষ-প্রতিক্রিয়া কখনোই মেয়েবিরোধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে না এখনো। মেয়েদের বিরুদ্ধে ছেলেদের সংগঠন তৈরি হয়েছে ইতিউতি, কিন্তু তার বড়োসরো রাজনৈতিক প্রকাশ নেই। ঠিক এইখানেই লুকিয়ে আছে, আধিপত্যকারী সামাজিক শক্তির প্রতিক্রিয়া কীভাবে চলতি রাজনীতির একটি ছকে নিজেকে প্রকাশ করে, তার চমৎকার উদাহরণ। প্রতিক্রিয়া যথাযথভাবে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটাবে, তা কিন্তু নয়। প্রকাশ কী? প্রকাশ কাকে বলে? প্রকাশ মানেই হল ঠিক যেটা প্রকাশ হতে চাইছে সেটা প্রকাশিত হওয়া নয়, বস্তুত যেটা প্রকাশিত হতে চাইছে সেটা কখনোই প্রকাশিত হতে পারে না। প্রকাশ পায় প্রকাশযোগ্য রূপে। সেই প্রকাশযোগ্য রূপটি কী? সেই প্রকাশযোগ্য রূপটিই হল বিজেপি। সেই প্রকাশযোগ্য রূপটিই হল সংঘ পরিবারের রাজনীতির রূপ, যা কখনোই সাধারণভাবে মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠতে পারেনি, যদিও প্রায় ১০০ বছর হয়ে গেল তা বেশ ভালোমতোই রয়েছে ভারতের সমাজে। সেই প্রকাশযোগ্য রূপটিই হল গেরুয়া হনুমানের মতো কাল্পনিক একটি প্রাণী, যা হুপহাপ করে নিজের ল্যাজের আগুন দিয়ে নানা স্থানে আগুন লাগিয়ে বেড়ায়। ততক্ষণ তা আগুন লাগিয়ে বেড়াবে, যতক্ষণ না নিজের ল্যাজের আগুনের আঁচ লাগবে নিজের, তখন সেই আগুন নেভাতে গিয়ে নিজের গেরুয়া মুখ পুড়িয়ে ফেলে পোড়ামুখো রক্তমাংসের বাস্তব হনুমান হয়ে উঠবে এই পুরুষ প্রতিক্রিয়া (চিত্র – ১)।

চিত্র — ১ : বাঁদিকে, কাল্পনিক গেরুয়া হনুমান। মাঝে, রূপকথার হনুমানের নিজের ল্যাজের আগুন দিয়ে (বি)দেশ জ্বালানো। ডানে, ল্যাজে আগুনের তাপ উপলদ্ধিতে এলে তড়িঘড়ি ফুঁ দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলার পর অনুশোচনা দগ্ধ রক্তমাংসের ভারতীয় ল্যাঙুর হনুমান। তিনটে ছবি গুগল সার্চ থেকে পাওয়া — আমি জোড়া লাগিয়েছি পাশাপাশি।

আজ যদি সমস্ত আন্দোলন, সমস্ত ছোট্ট ছোট্ট সক্রিয়তা, শৈল্পিক প্রকাশ, চিন্তা, ভাবনা, আচরণ, সম্ভাষণ, সামাজিকতা, সরকারিতা, ব্যবসা, মিডিয়া — সমস্ত কিছুতে যদি এই মেয়েদের স্বাধীনতা, স্বাবলম্বন ও স্বরক্ষার বাসনাকে, সমাজটাকে মেয়েদের নিজেদের মতো করে বদলে নেবার বাসনাকে, মেয়েদের সক্ষমতার এই অঙ্কুরকে জায়গা দিতে না পারে, অংশীভূত করতে না পারে অর্থাৎ নিজের গঠনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে তাকে জায়গা দিতে না পারে — তাহলে তা দেখতে যতই যা কিছু হোক — এই পুরুষ প্রতিক্রিয়ার অঙ্গীভূত হবার নিয়তি থেকে তার রেহাই পাওয়া মুশকিল।

[সতর্কীকরণ : এরকম কোনো থিসিস দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে না যে ছেলেরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছে আর মেয়েরা বিরোধীদের। আমি সেফোলজি করিনি এই প্রবন্ধে, আর এরকম কোনো কিছুর সন্ধান কোনো সেফোলজিস্ট দিয়েছে বলেও শুনিনি। তবে ছেলেদের আর মেয়েদের ভোটের ট্রেন্ড নিয়ে সেফোলজি হতেই পারে, খুবই ইন্টারেস্টিং হবে বলে আমার ধারনা। কারণ, নির্বাচনের আগে, মধ্যে, পরে ও ফল বেরোনোর পরে, আমি মূলতঃ ছেলেদের মধ্যে বিজেপি নিয়ে যে উচ্ছ্বাস দেখেছি, মেয়েদের মধ্যে তার বিন্দুমাত্রও চোখে পড়েনি।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *