করোনা ও সুরাতের হীরের গয়না

নিজস্ব প্রতিবেদন, ২৮ এপ্রিল

ভারত পালিশ করা হীরা রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম। এই ব্যবসা পশ্চিম ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। গুজরাতি ব্যবসায়ীদের। মুম্বই হল ভারতের তথা বিশ্বের হীরে বুর্জোয়াদের রাজধানী। মূল ক্রেতা ছিল আমেরিকা ইউরোপ হংকং। এই যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লিস্টে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাঙ্কঋণখেলাপীদের এক নম্বর মেহুল চোক্সি — ইনাকে একজন আদর্শ হীরে বুর্জোয়া ধরা যেতে পারে।

সম্প্রতি হীরে ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে ওঠার দিকে এগোচ্ছিল গুজরাত। সুরাতে গড়ে উঠছিল বিশাল সুরাত ডায়মন্ড বোর্স। এমনিতেই সুরাত ভারতে আমদানি হওয়া হীরে পালিশের কেন্দ্র, নিরানব্বই শতাংশ হীরে পালিশ হয় এখানে। এখানে পালিশ হয়ে মুম্বই হয়ে বা সরাসরি হীরে যায় সারা পৃথিবীতে। সুরাত থেকে সরাসরি যায় হংকং। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে হংকং হীরে বাজার বন্ধ হয়ে গেলে। গুজরাতি হীরে ব্যবসায়ীরা প্লেনে করে হংকং থেকে ফিরতে শুরু করল আমেদাবাদ। বছরে সুরাত থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার হীরে যায় হংকং।

প্রায় দশ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করে সুরাতে। তার মধ্যে সাড়ে পাঁচ লক্ষ হীরে শ্রমিক। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে যেমন আদিবাসী এবং অনগ্রসর জাতের গ্রামগুজরাতবাসীরা আছে, তেমনি আছে বিহার, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা শ্রমিকরা।

লকডাউনের আগে থেকেই হীরা রপ্তানিতে টান চলছিল ভারতে। ২০১৯ জুড়ে। করোনা লকডাউনে আমেরিকা ইউরোপ হংকং-এ হীরে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে বিশাল বিশাল বিল্ডিং-এর হীরে নগরী তৈরি হচ্ছে সুরাতে। গুজরাতের ফ্ল্যাগশিপ রপ্তানি-শিল্পনগরী। সারা পৃথিবীর আশি শতাংশ হীরে পালিশ হয় সুরাতে। এই সুরাতেই যদি হীরা-বাণিজ্যও হয়, তাহলে আর দেখে কে? হংকং এবং মুম্বই — দুটোকেই পাল্লা দেওয়া যাবে। কিন্তু করোনা লকডাউনে আমেরিকা ইউরোপে ভাঁটার টান আন্দাজ করে বৎসোয়ানার কাঁচা হীরের খনিও বন্ধ হয়ে গেল। তারপর সেখানেও শুরু হল করোনা লকডাউন।

আর সুরাতে মন্দাক্রান্ত হীরে ব্যবসার শ্রমিকরা (পালিশ থেকে কনস্ট্রাকশন) গুটি গুটি পায়ে বাড়ির রাস্তা ধরল। দু-আড়াই লাখ চলে গেল। যাদের দূরে বাড়ি, অন্য রাজ্যে, তারা পরে রইল। তিন তিনবার বিক্ষোভ করল এই এক মাসে। গাড়ি পোড়ালো। রেললাইনে দাঁড়িয়ে পুলিশকে খোয়া ছুঁড়ে মারা হল। ৮০ জন অ্যারেস্ট হল। তারা আর কাজ করতে চায় না। তারা বাড়ি যেতে চায়। তারা বকেয়া মাইনে চায়।

বাধ্য হয়ে লকডাউন চলাকালীন পাশ্ববর্তী রাজ্য মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে, উত্তরপ্রদেশে শ্রমিকদের ফেরত পাঠালো গুজরাত সরকার, কেন্দ্রেও যেহেতু গুজরাতেরই সরকার। এরই মধ্যে গুজরাত সরকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ১২ ঘন্টা ওয়ার্কিং হাওয়ার, কিন্তু মাইনে একই, ওভারটাইম নয়। ইউনিয়নকেও নিষিদ্ধ করার কায়দা হয়ে গেছে। কেন্দ্রের ‘গুজরাত সরকার’কে দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি, তাদের দিয়ে কাজ করানোর পার্মিশনও আদায় হয়ে গেছে। হিসেবটা এরকম, ন্যুনতম পরিযায়ী শ্রমিক দিয়ে ১২ ঘন্টা খাটিয়ে বিল্ডিং-গুলো বানিয়ে নেওয়া। পালিশ কাটিং আপাততঃ বন্ধ থাক। হীরে বুর্জোয়ারা, দেশে যাতে আর কাঁচা হীরে না ঢোকে পালিশের জন্য, তার জন্য কেন্দ্র সরকারের কাছে তদ্বির করে ফেলেছে। আর স্টিমুলাসের দাবিও করা হয়ে গেছে, এই বারো ঘন্টা খাটানো হচ্ছে যাদের জোর করে ধরে রেখে, তাদের মাইনে বাবদ।

ব্যবস্থা কমপ্লিট।
কিন্তু বাধ সাধল সেই পরিযায়ী শ্রমিকরাই। তারা বাড়ি যেতে চায়। আজও তারা পাথর ছুঁড়ল। পুলিশ এল। তারা কাজ করতে চায় না। বাড়ি যেতে চায়। দেশের বাড়ি। গ্রামে ফিরতে চায় তারা। ওড়িশা, বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *