শঙ্কর সরকার চিকিৎসক হিসেবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত তার নিজের জেলা পশ্চিম বর্ধমান-এ। এছাড়াও এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমমূলক করোনা মোকাবিলাতেও তিনি সামিল। তার কাছ থেকে আমরা শুনলাম, কীভাবে তিনি দেখছেন এই অতিমারিকে প্রত্যক্ষ মোকাবিলার মধ্যে দিয়ে। এখানে সেই সাক্ষাৎকারের সম্পাদিত অংশ — প্রথম ভাগ।
অতিমারির গতবছর এবং এবছর : ফারাক
গতবছর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করার সুবাদে যেটা দেখেছিলাম, শুরুতে আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনোরকম টেস্টিং এর ব্যবস্থা ছিল না। তখন এই কোভিড-১৯ এবং তার অতিমারি নিয়ে আমাদেরও কোনো জ্ঞান ছিল না। নতুন রোগ। সেইসময় আমরা দেখলাম, প্রশাসনের তৎপরতাই বেশি ছিল। জেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য অধিকর্তারা ছিল জেলাশাসক। এটা আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা — স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশাসনে জেলাশাসককে মুখ্য ভূমিকায় দেখতে পেয়েছিলাম। আর ছিল পুলিশ-প্রশাসনের লোকদেরও তৎপরতা। যেহেতু ওইসময় লকডাউন ঘোষণা হয়েছিল এবং ট্রান্সপোর্ট পরিষেবা বন্ধ ছিল, আর এক জেলা থেকে অন্য জেলা বা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যারা কাজ করতে এসেছিল। আমি যে ব্লকে কাজ করি, সেখানে বিভিন্ন জেলা ও বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ কাজ করত। তাদের বিভিন্ন স্কুলে রাখা হয়েছিল। রোগটা যাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে যেতে যাতে না পারে, তার জন্য। তখন এই প্রশাসনিক ও সরকারি তৎপরতার মধ্যে দিয়েই অতিমারিকে দেখছিলাম। কিন্তু এই রোগটা কীরকম, কী হচ্ছে না হচ্ছে — সেটা অনলাইনে, ফেসবুকের মাধ্যমে এবং টিভিতে টুকটাক নজরে আসছিল। তার মধ্যে বিশেষ করে নজরে এসেছিল শ্বাসকষ্টের বিষয়টা। এটা ম্যানেজ করার জন্য নাকি ভেন্টিলেটরের প্রয়োজনীয়তা খুব বেড়ে গেছিল। ভারতবর্ষের হিসেব করে দেখা যাচ্ছিল, এমনকি আমেরিকাতেও হিসেব করে দেখা যাচ্ছিল ভেন্টিলেটর যত প্রয়োজন, তার তুলনায় কম আছে।
চিকিৎসা পরিষেবাগতভাবে এটাকে প্রত্যক্ষ মোকাবিলার যে বন্দোবস্তটা করা হয়েছিল, জেলার স্বাস্থ্যবিভাগের প্রধান যিনি, তার অধীনে। আমাদের যেহেতু সীমান্তবর্তী জেলা, তাই সীমান্তে একটা তৎপরতা হয়েছিল, একটা জেলা থেকে অন্য জেলায় এবং অন্য রাজ্য থেকে কারা আসছে, তার ওপর নজরদারি। যারা আসছিল বাইরে থেকে, তাদের নিয়ে স্কুলে রাখা হচ্ছিল। আর তাদের মধ্যে যাদের কোনো অসুস্থতা নজরে আসছিল, আইএলআই বা ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইনফেকশন — অর্থাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো যাদের সিম্পটম ছিল, জ্বর সর্দি কাশি তাদের আসানসোলের একটি বেসরকারি হাসপাতালকে অধিগ্রহণ করে রাখা হচ্ছিল। আর কোভিড হাসপাতাল হিসেবে দূর্গাপুরে সনকা বলে একটি বেসরকারি হাসপাতালকে অধিগ্রহণ করেছিল সরকার। ওইখানে লেভেল ওয়ান বলে চিহ্নিত করে যাদের সিম্পটম রয়েছে, তাদের ভর্তি করা হচ্ছিল প্রশাসনিকভাবেই। সেখানেই তারপর আরটিপিসিআর টেস্ট শুরু হয়েছিল। যাদের পজিটিভ ধরা পড়ছিল, তাদের রাখা হয়েছিল লেভেল টু-তে। লেভেল টু মানে হল দুর্গাপুরের কোভিড হাসপাতাল। আর লেভেল ওয়ান হল আসানসোলের হাসপাতাল। পশ্চিম বর্ধমান জেলার ক্ষেত্রে। ভারতবর্ষে এইভাবে ঢালাও হারে কোনো ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করার মতো টেস্ট আমি জীবনে দেখিনি। একমাত্র পুণে-তে এই ফ্যাসিলিটি ছিল আগে। ভাইরাসের নিশ্চিতকরণ আগে আমি স্থানীয় স্তরে হতে দেখিনি। পুণেতে স্যাম্পল নিয়ে যাওয়া হত। এবারেই দেখলাম, একটি ভাইরাসঘটিত রোগ, যার নিশ্চিতকরণটি একটি টেস্টিং এর মাধ্যমে হচ্ছে। এটা একটা নতুন বৈশিষ্ট্য। এই ভাইরাসটার নাম দেওয়া হয়েছিল সার্স-কোভ-টু। যেহেতু আগে একটা রোগ এসেছিল সার্স নামে, ২০০৩ সালে। তারপর ঘাঁটাঘাটি করে জানলাম, তখনও কিছু টেস্ট হয়েছিল, কিন্তু এরকম ঢালাও হারে নয়। এবং একশ’ বছর আগে যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারি হয়েছিল, যার নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্লু, তখনও তো হওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তখন কিন্তু এই রোগটাকে ডায়গনসিস করা বা চিহ্নিত করা যা কিছু ডাক্তারি চোখ দিয়েই করা হত। ফলতঃ এখানে একটা বিশাল ফারাক ঘটে গেল। অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল ডায়গোনসিসের বদলে ল্যাবরেটরি ডায়গনসিসের ওপরই মূলতঃ দাঁড়ালো এটা। অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল ডায়গোনসিস করে যদি মনেও হয়, তাকে ল্যাব ডায়গনসিস করে যদি পজিটিভ না পাওয়া যায়, তাকে কিন্তু কোভিড রোগী হিসেবে ধরা হয়নি।
দেখলাম, ডাক্তাররাও এপিডেমিকের সংজ্ঞা ভুলে বসে আছে। এপিডেমিক মানে মহামারি। আর প্যানডেমিক মানে অতিমারি, যখন এপিডেমিক একটা দেশ ছাড়িয়ে আবিশ্ব ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ মহামারি বা এপিডেমিক বলতে বোঝে, এমন একটা রোগ, যা হলেই লোকে মারা যাবে, এবং শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারা যাবে। কিন্তু এপিডেমিকের সংজ্ঞা তাতে কিন্তু মৃত্যুর কোনো উল্লেখই নেই। অদ্ভুতভাবে দেখলাম, টিভিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডাক্তাররাও ঠিকমতো উত্তর করতে পারছিল না। তারা যা বলছিল, তার সঙ্গে সংজ্ঞা মিলছিল না। প্রসঙ্গতঃ কয়েক বছর আগে একজনের সঙ্গে তর্কের সময় আমি তাকে বলেছিলাম সোসাল মিডিয়াতে — আমেরিকায় আজ যদি একজনের কলেরা হয়, তাহলে কলেরাকে এপিডেমিক বলে ঘোষণা করা হবে। সে তো মানতে চাইল না। আমি তাকে তখন মান্য যে টেক্সটবুক, তার পাতা স্ক্যান করে পাঠিয়েছিলাম। অদ্ভুতভাবে দেখলাম এবারে, ডাক্তাররাও এসব ভুলে বসে আছে। কেন এরকমটা হল? কারণ ডাক্তারিতে মেডিসিন, সার্জারি, গায়নোকলজি এসব পড়ানোর পাশাপাশি তো আরেকটা বিষয়ও পড়ানো হয়। কমিউনিটি মেডিসিন। এই বিষয়টা কেবল মুখস্ত করে পাশ করার জন্যই। কারণ পাশ করার পর সবাই যে ব্যাপারটার সঙ্গে যুক্ত হয়, তা হল হসপিটাল চিকিৎসা, বা ক্লিনিক্যাল মেডিসিন। ফলে এই দিকটা অবহেলিত থেকে গেছে। এই জিনিসটা আশির দশকের পর থেকেই ক্রমাগতঃ ঘটে ঘটে গেছে। আজ এটা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। এই রোগটা অনেক কিছুকেই উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমাদের চেতনার মান কী, সেটা যেমন উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একটা নতুন রোগকে কীভাবে মোকাবিলা করব, আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কোন পর্যায়ে আছে — সেটাকেও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এপিডেমিকের সংজ্ঞা কী দেওয়া আছে? ক) যদি কোনো একটা রোগ নতুন আসে, এবং খ) যদি সেটা দ্বিতীয় কোনো মানুষের মধ্যেও পাওয়া যায়, তাহলেই সেটিকে এপিডেমিক বলে ঘোষণা করতে হবে। অথবা, পুরনো কোনো একটা রোগ চলছে, সেটি যদি আগেকার রেকর্ডকে ছাপিয়ে যায়, তাহলেও সেটাকে এপিডেমিক বলে ঘোষণা করতে হবে। এপিডেমিক ঘোষণা করা মানেই হচ্ছে, সেটাকে মোকাবিলা করার জন্য কিছু ব্যবস্থাপনা করতে হবে। যে ব্যবস্থাপনাটা আমরা কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে দেখলাম। কিন্তু এটা সম্পর্কে যেহেতু জনগণ ওয়াকিবহাল নয়, এমনকি এই চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত যারা প্রত্যক্ষভাবে, তারাও বোঝা গেল যে ওয়াকিবহাল নয়; ফলে সবাই ভাবছে — এটা এমন কী রোগ, টিবিতে এত লোক মারা যায়, ম্যালেরিয়াতে এত লোক মারা যায়, তার জন্য কিছু হয় না, অথচ এটার জন্য হচ্ছে! এই নিয়ে একটা বিভ্রান্তি কিন্তু কাজ করতে শুরু করল।
যাই হোক, বাধ্যতামূলক মুখোশ পরা কিন্তু শুরুতে ছিল না। শুরুতে বলা হয়েছিল, যাদের সিম্পটম আছে, শুধুমাত্র তারাই মাস্ক পরবে। তারপর কিন্তু যখন রোগটা আরো ছড়াতে শুরু করল, তখন কিন্তু সবাইকেই বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তারপর লকডাউন সরকার থেকেই করেছিল। প্রথমদিকে হাতড়ে হাতড়ে চিকিৎসা চলছিল। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ওপর জোর পড়েছিল। কারণ ১৯৮৩ সালে আন্তর্জাতিকভাবে মান্য টেক্সটবুকের ২০ তম সংস্করণে আছে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে কোষে ঢুকতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে এটার ওপর নির্ভর করেই কিন্তু হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু এর কোনো নিশ্চিত প্রমাণ সেভাবে ছিল না। কিন্তু আর তো কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ওটা দিয়েই কাজ শুরু হয়েছিল। আর ছিল অক্সিজেন আর ভেন্টিলেটর। তারপর তো ইতালিতে আমরা দেখলাম, কতজন পেশেন্ট মারা গেল। ডাক্তারও হতাশ। অনেক ডাক্তারও মারা গেল। কোনো কোনো দেশে তো দেখা গেল, রাস্তাতেও মানুষ মরে পরে রয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে সেভাবে মৃত্যুটা অতটা নজরে আসেনি। যারা মারা গেছিল গত বছর, এক, তারা পঞ্চাশের ঊর্ধে। এবং দুই, তাদের আগে থেকেই কোনো না কোনো রোগ ছিল। যার জন্য একটা কথা চালু হয়েছিল — কো-মর্বিডিটি। ফলে সবাই ধরে নিল যে এটা করোনায় মৃত্যু, এবং পাল্টা একটা কথা চালু হল, মারা গেছে অন্য রোগে, বলে দিচ্ছে করোনা। এভাবেও অনেকে এটা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করল। ফলে এই করোনা সম্পর্কে নানা রকমের মত ঘোরাফেরা করল। তারপর আস্তে আস্তে একটা সময় পর এটা মিলিয়ে গেল। আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আরটিপিসিআর টেস্টের জন্য সোয়াব কালেশন শুরু হয়েছিল। তারপর র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের কিট এল। তাতে আমরা খুব কম সময়ে ওখানেই ডায়গনসিস করে নিতে পারছিলাম, ফলে আমরা পেশেন্টকে কোভিড হাসপাতালে পাঠাতেও পারছিলাম সরাসরি। এটাও সুবিধা হয়েছিল। একটা কথা বলতে পারি, গত বছর সরকারিভাবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থাপনা করা হয়েছিল, তা কিন্তু অতীতে কোনো রোগের ক্ষেত্রে আমি দেখিনি। মানে পেশেন্টের জন্য ফ্রি-তে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া, তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, হাসপাতাল থেকে ছুটি হলে আবার গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। সমস্তটার ফ্রি-সার্ভিস কিন্তু সরকার থেকে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আরেকটা ব্যবস্থাপনা করা হয়েছিল। আস্তে আস্তে টেস্ট করতে করতে একদলের দেখা যাচ্ছে পজিটিভ বেরোচ্ছে, কিন্তু তাদের সেভাবে কোনো উপসর্গ নেই। কিন্তু তাদেরকে যেহেতু সেপারেট রাখতে হবে, আলাদা রাখতে হবে, ঘরে যাদের আলাদা রুম নেই, তাদেরকে সেফ হোম বলে একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেইখানে রাখা হল। তাদের অ্যাম্বুলেন্স-ও যেত, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের গাড়িও যেত। সেই বাড়িকেই ঘিরে দেওয়া হত বাঁশ দিয়ে। ফলে মানুষের মধ্যে নানা রকমের আতঙ্ক এবং নানা রকমের ধারনা তৈরি হয়।
এর প্রভাবটা আমরা এ বছরে দেখলাম। মানুষ আর টেস্ট করতে চাইছে না। টেস্ট করলে পজিটিভ হলে পুলিশ ধরে নিয়ে ভর্তি করে দেবে। কিছু না হলেও ভর্তি করে দেবে। এই একটা ধারনা থেকে লোকে এবছরে টেস্ট করেনি। আরেকটা জিনিস হয়েছে। মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখা। বিচ্ছিন্ন। সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এই ঘটনাগুলি ঘটতে দেখেছি। ঠিক যেরকম লেপ্রসি বা কুষ্ঠ রোগীর ক্ষেত্রে হয়। বা কারোর এইডস হয়েছে শুনলে যেমন হয়। ঠিক সেরকম টাইপের এক্ষেত্রেও হয়েছে। যাই হোক, তারপর একসময় লকডাউন উঠে গেল। পুজো ঈদ মহরম সমস্তটাই পেরিয়ে গেল। তারপর সবাই ধরে নিল। সরকারি তরফ থেকেও বলা হল — করোনা শেষ হয়ে গেছে। জনগণও সেরকম স্বাভাবিক জীবনযাপনে চলে গেল। আমার যদিও ব্যক্তিগতভাবে হিসেব ঠিক মিলছিল না। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমিও দেখছিলাম, আমাদের হসপিটালে তো রেগুলার একটা মিনিমাম টেস্টিং হত। একটা সময় দেখলাম যে পজিটিভ আর প্রায় বেরোচ্ছেই না।
হঠাৎ তারপরে সম্ভবতঃ মার্চ মাসের পর থেকে হঠাৎ দেখা গেল, টেস্ট করতে করতে পজিটিভের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এমন হয়ে গেল, যত পেশেন্টকে ডায়রিয়াতে ভর্তি করা হচ্ছে, তাদের টেস্ট করে দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবাই পজিটিভ। এমনকি ডেলিভারি পেশেন্টকে ভর্তি করা হচ্ছে। ডেলিভারি হয়ে যাচ্ছে। টেস্ট করে দেখা যাচ্ছে, সেও পজিটিভ। ডেলিভারি হবার আগে টেস্ট করছি তো পজিটিভ। এরকমও হয়েছে, যারা টেস্ট করছে তারা করেছে — বলছে, একদিনে যদি দেখি সবাই পজিটিভ, তাহলে তো অবস্থা খারাপ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরকম করা হয়েছে — আজকের ডেট-এ যাকে পজিটিভ পেলাম, তাকে আগামীকালের ডেট-এ দেখালাম। এরকমও করতে হয়েছে। যে টেস্ট করে তার সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝেছিলাম, সত্তর শতাংশের বেশি পজিটিভিটি। একশ’ জন যদি টেস্ট করে, সত্তর জন পজিটিভ। এদিকে বেড়ে যাচ্ছে পজিটিভিটি। আর অন্যান্য রাজ্যে খবর পাচ্ছি, ঢালাও হারে মরতে শুরু করেছে। অক্সিজেনের প্রচন্ড ক্রাইসিস। ফলে এই দ্বিতীয় ঢেউ-এ এর তীব্রতা যেভাবে নজরে এল, যেটা প্রথম ঢেউ-এর ক্ষেত্রে ছিল না। এখানে একটা কথা শোনা যাচ্ছে যে, এই দ্বিতীয় ঢেউ-টা যে ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে হয়েছে, সেটার নাকি ইনফেকশন ছড়ানোর ক্ষমতা অনেক বেশি। এটা একটা হতে পারে। পাশাপাশি এটাও ঘটনা, প্রথমবারে যেভাবে লকডাউনটা হয়েছিল, যার জন্য মানুষের গ্যাদারিংটা বন্ধ ছিল, অন্ততঃ কমে গেছিল, বাজার খোলা ছিল, ফলে ইনফেকশন ছড়াচ্ছিল, এটা ঠিকই। কিন্তু যে তীব্রতায় ছড়াতো, সেটা ছড়াতে পারেনি। আর এবারে যেহেতু পুরোটাই ওপেন ছিল, কী রাজনৈতিক সমাবেশ, কী ধর্মীয় সমাবেশ — সমস্ত রকম সমাবেশই চলছিল যেহেতু খুব ফ্রি-লি, ফলে এই সমাবেশের কারণেই ছড়িয়েছে বেশি সেটাও হতে পারে। আবার যারা বলছে এই ভ্যারিয়েন্টটা আরো বেশি সংক্রামক, সে কারণেও হতে পারে। বা দুটোর সম্মিলিত কারণেও হতে পারে। কারণ, আমাদের ওখানে যত পজিটিভ কেস, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে, তারা ওই সময়টায় গাজন উৎসব চলছিল, সেই গাজন উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিল। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিটিক্যাল সমাবেশ। এই ইতিহাসগুলো পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে বোঝা যাচ্ছিল, গ্যাদারিং-এর ফলেই জিনিসগুলো ছড়িয়েছে। হ্যাঁ, গত বছরে দেখা গেছিল, একটা বাড়িতে হয়ত একজনের হয়েছে, কি দুজনের হয়েছে। এবারে দেখা গেল, একজনের হবার পর বাকিদেরও হয়ে গেছে। অবশ্য গতবছর বাড়িতে একজনের পজিটিভ হলে বাকিদের বাধ্যতামূলক টেস্টিং করা হচ্ছিল। এবারে অবশ্য এত বাধ্যতামূলক ছিল না। আগে পুলিশ দিয়েও টেস্টিং করানো হয়েছিল। এবারে কিন্তু সেরকম কিছু করা হয়নি। কিন্তু ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, এবারেরটাতেই বোঝা গেল একটা ঢেউ। গতবার আমরা ঢেউ বলে কিছু বুঝিনি। লোকে যে অতিমারির সংজ্ঞা চাইছিল, যে সংজ্ঞাতে তারা সন্তুষ্ট হতে চাইছিল — এবারে তারা তা পেয়ে গেল — যে রাস্তাতে লোক মরে পরে থাকবে, তবেই তা অতিমারি। কিন্তু এর থেকে একটা ভুল বার্তা চলে গেল যে অতিমারি হচ্ছে এইরকম। তা কিন্তু নয়।
গত বছর এবং এই বছরের মধ্যে এই যে ফারাক — শুধু মানুষের চেতনাগত দিক থেকে ফারাক তা নয়, মানুষের প্রস্তুতিগত দিক থেকেও যে ফারাক — তাও দেখা গেল। আরেকটা জিনিস উন্মুক্ত করে দিয়েছে, এই যে কো-মরবিডিটি কথাটা খুব চালু হয়ে গেল, সেটা হচ্ছে যে, পৃথিবীর কত মানুষ এবং ভারতবর্ষের প্রচুর মানুষ ডায়বেটিসে ভুগছে। এটাও উন্মুক্ত হয়ে গেল। যেটা আগে কখনও এইভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। কারণ চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রত্যেকেরই ব্লাড সুগার টেস্ট করতে হয়েছে। তাতে ধরা পড়ছে যে সব ডায়বেটিসে ভুগছে। মানে খাদ্যাভ্যাসের এমন পরিবর্তন ঘটেছে যে একটা ইয়ং জেনারেশনের মধ্যেও ডায়বেটিস ঢুকে গেছে। এই ভাইরাসটি কিন্তু মানুষের এই অবস্থাটাকে সামনে নিয়ে চলে এসেছে। এই অতিমারি মানুষের চেতনাগত অবস্থান, ডাক্তারি বিজ্ঞান সম্পর্কে তার বোধাবোধ — এই সমস্তকিছুকে যেমন উন্মুক্ত করেছে। তেমন এটা এগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ব্যবসাগত — সেগুলিকেও সামনে হাজির করেছে।
“এপ্রিল মে মাসে সারা দেশে সাতাশ লক্ষ” মৃত্যুর পরিসংখ্যানটা বিশ্বাসযোগ্য
গতবছরও কিছু কিছু কেস দেখেছিলাম, এত ঢালাও হারে দেখিনি। এই রোগের সিম্পটম বিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে যখন অভিজ্ঞতা হতে থাকলে, দেখলাম, টেস্ট করে নেগেটিভ পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু সিম্পটম গুলো কোভিডের সঙ্গে ম্যাচ করছে। এরকম হয়। যেমন টিউবারকুলোসিস বা টিবি। এর জন্য যে কফ পরীক্ষা হয়, সেই কফ-এ সবসময় পজিটিভ পাওয়া যায় না। মানে ব্যাকটিরিয়াটি পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলে আমরা বলি, পজিটিভ পালমোনারি টিউবারকুলোসিস। এবার এক্স রে করে দেখা হল, তখন দেখা গেল যে টিউবারকুলোসিস-এর মতো মনে হচ্ছে। আগে যেভাবে মাইক্রোস্কোপের তলায় পরীক্ষাটা হত, এখন আরো উন্নত টেস্টিং-এর ব্যবস্থা বেরিয়েছে। এখন আরটিপিসিআর টেস্টের মতোই কম্পিউটার-এর সাহায্যে টেস্ট করা হয় কফ, সিবিন্যাট বলে। ঠিক যেভাবে এক্স-রে -র পর সিটিস্ক্যান এসেছে, সেরকমই এক্ষেত্রে আরো সূক্ষ্ম টেস্টের মাধ্যমে আমরা ধরে ফেলতে পারছি। এবারে এমনও পাওয়া গেছে, যে, টিউবারকুলোসিস শুধু যে ফুসফুস-এ হয় না, ফুসফুসের বাইরেও হয়। সেক্ষেত্রে এই কোনো টেস্টের মধ্যে না পাওয়া গেলেও ক্লিনিক্যালি তার অনেক কিছু ম্যাচ করে যায়।
এছাড়া, প্রথম ঢেউ-এর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এই দ্বিতীয় ঢেু-তে মানুষ কিন্তু টেস্ট করায়নি। গঙ্গাতে যত লাশ ভেসেছে, কোনোটাই কিন্তু কোভিড মৃত্যু হিসেবে ঘোষিত নয়। কারণ তাহলে তো তাদের প্যাকেটে মুড়ে ব্যবস্থা করত। তাহলে তারা মরল কী করে? এত এত হঠাৎ করে মরে গেল কী করে? যেমন, গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মধ্যে ধারনা হয়েছিল যে এই রোগটা বড়োলোকদের রোগ। এটা শ্রমিকদের রোগ নয়, এটা কৃষকদের রোগ নয়, যারা কায়িক পরিশ্রম করে তাদের এই রোগটা হবে না। এরকম একটা ধারনা ছিল। এবারে দেখা গেল, ঢালাও হারে শ্রমিকদেরও হচ্ছে, কৃষকদেরও হচ্ছে, যারা গ্রামে থাকে তাদেরও হচ্ছে। এবং ইউপি বিহারের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইউপি-এর ঘটনাগুলো যেভাবে সামনে এসেছে, মধ্যপ্রদেশেও সামনে এসেছে, তাতে করে দেখা যাচ্ছে যে গ্রামের মানুষদের মধ্যে অনেকেরই কিন্তু এই রোগের সিম্পটমগুলো হয়েছে। কিন্তু তারা যেহেতু টেস্ট করায়নি। বা টেস্ট করিয়ে পজিটিভ বেরিয়েছে, কিন্তু তারা ঘরেই থেকেছে, ঠিকঠাক মতো চিকিৎসা হয়নি। হয়ত ঘরেই মারা গেছে, কিন্তু মারা যাবার পর যে নথিভুক্ত হবে, সেগুলো হয়নি। ফলে একসঙ্গে এতগুলো মানুষ মারা যাবার পর কী হচ্ছে, সে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে মৃতদেহ পোড়াবে, তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, এমনকি কাঠ পাচ্ছে না। শ্মশানের যে স্পেস, তার মধ্যেও জায়গা হচ্ছে না। অন্য জায়গায় পুড়িয়ে দিতে হচ্ছে। এমনকি শেষে সরকার সেই জায়গাটাকে ঘিরে দিচ্ছে, যাতে সাংবাদিকরা ফটো তুলতে না পারে। এটা আগে কখনও হয়নি। এবার দেখা যাচ্ছে, যারা সেই কাঠটুকুও পেলো না, তারা কী করবে, জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে মৃতদেহ। এই ঘটনাগুলো ইঙ্গিত করছে, রেজিস্টার্ড যেগুলো, অর্থাৎ যারা আরটিপিসিআর বা র্যাট টেস্টের মধ্যে দিয়ে পজিটিভ হয়েছে, তারপর মারা গেছে, এই কেসগুলো কোভিড মৃত্যু হিসেবে চিহ্নিত হল। কিন্তু বাকিগুলো হল না।
এছাড়া আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, গতবছর টিভি মিডিয়া পুরোটা কভারেজ করেছিল। সরকারের প্রশংসা হোক, নিন্দা হোক — সবকিছু টিভি মিডিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়েছিল। তাদের ক্যামেরা কিন্তু ওদিকটা ঘুরছিল। হসপিটালে ঘুরছিল। এবারে কিন্তু তা হয়নি। তারা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এবারে কিন্তু স্বাধীন সাংবাদিকরা এবং সামাজিক গণমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে আমরা পেতে শুরু করি। গুজরাতে কী হচ্ছে, মধ্যপ্রদেশে কী হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে কী হচ্ছে — তা কিন্তু বড়ো মিডিয়া দেখায়ওনি, বলেওনি। প্রচলিত সাংবাদিকতার বাইরে থেকে আমরা জানতে পেরেছি। কোনো কোনো সাংবাদিক নিজস্ব উদ্যোগে সংখ্যা নেওয়া শুরু করে — কতজন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, কতজন মারা যাচ্ছে। করতে গিয়ে তারা দেখে, গড়ে এই সময়ে মানে এই এপ্রিল-মে মাসে কতজন ভারতবর্ষে মারা যায় এবং ওই রাজ্যে কতজন মারা যায় — তার তথ্য এবং শ্মশানে কত মৃতদেহ সৎকার হয়েছে, তা মিলিয়ে দেখে কিছু কিছু সাংবাদিক বার করেছিল — কম করে সাতাশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মধ্যপ্রদেশের ক্ষেত্রে একটি দৈনিকের সাংবাদিক গোটাটাকে পর্যালোচনা করে এই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল। তারপর অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এইসব জায়গাতে করেছিল। আর বিদেশের যে পত্রিকাগুলো, সেগুলোও নাকি একধরনের সমীক্ষা করেছিল। ওদের হিসেব অনুযায়ী তো একচল্লিশ লক্ষ বিয়াল্লিশ লক্ষ লোক মারা গেছে এই এপ্রিল-মে মাসে। আমি একজন ভারতীয় প্রাক্তন সাংবাদিক, সে এখন স্বরাজ ইন্ডিয়া বলে একটা দল করে, সে বারবার উল্লেখ করত এই সাতাশ লক্ষ হিসেবটা, তার সোর্স ধরে — আমি সেটাই ধরছি। বিদেশি সাংবাদিকদের তথ্য ধরছি না। সে নিজেও তার নিজের বাড়ি হরিয়ানার যে গ্রামে, সেখানেও লক্ষ্য করেছে যে মৃত্যুটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। এই যে বেশি মৃত্যু, সবকটাকে কোভিড মৃত্যু বলা যাবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু যখন কোনো মহামারি বা অতিমারি চলে, তখন মৃত্যুর প্রধান কারণ কিন্তু ওইটিই সাধারণতঃ হয়। এবং কোথাও যে ফুড পয়জনিং হয়ে গেছে বা কলেরা হয়ে গেছে এরকমও কোনো ব্যাপার নেই। সবজায়গাতেই যদি একইসঙ্গে মৃত্যু বেশি দেখা যায়, তাহলে ধরে নিতে হয় সেটা ওই মহামারির কারণেই। আমাদের এখানেও কিন্তু শ্মশানগুলো মৃতদেহে বোঝাই হয়ে যাচ্ছিল। এবং মৃতদেহ সৎকারের জন্য কালোবাজারি শুরু হয়ে গেছিল, পাঁচশ’ টাকা ফিজ-টা পাঁচ হাজার দশ হাজার হয়ে যাচ্ছিল। এর কারণটা কী? যেহেতু সংখ্যাটা বাড়ছে। এলাকায় রাণিগঞ্জের শ্মশান ঘাট, দুর্গাপুরের শ্মশান ঘাট — এগুলোর টুকটাক যা খবরাখবর পেয়েছি, তাতে কিন্তু এই “এপ্রিল মে মাসে সারা দেশে সাতাশ লক্ষ” মৃত্যুর পরিসংখ্যানটা বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়েছে।
চলবে
One thought on ““দেখেছিলাম, এমনকি ডাক্তাররাও এপিডেমিক-এর সংজ্ঞা ভুলে বসে আছে””