সর্বজনীন বিদ্যুৎ পরিষেবা: সাধারণ নির্বাচনে যে ইস্যুটা নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না


আধুনিক জীবনে বিদ্যুতের প্রয়োজন সম্পর্কে সবাই একমত হবেন। অক্সিজেন, জল, খাবার ছাড়া যেমন প্রাণ বাঁচে না, তেমনি বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন বাঁচে না। পরের পর কেন্দ্রীয় সরকার সারা ভারতে পূর্ণাঙ্গ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা নিলেও সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনও অবদি দেশের ৯৭ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। আবার, বিদ্যুৎ পৌঁছলেও লোডশেডিং এর কারণে সেই বিদ্যুৎ সংযোগ অধরাই থেকে যায় দিনের অনেকটা সময়। এখনও দেশের গ্রামাঞ্চলে দিনে ৬-৭ ঘন্টা থেকে শুরু করে ১০-১২ ঘন্টা অবদি লোডশেডিং থাকে। গরমকালে যখন বিদ্যুতের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়, তখন পরিস্থিতি আরো সঙিন হয়। তার ওপর ট্রান্সফর্মার বা বিদ্যুতের লাইন -এ কোনও ত্রুটি দেখা দিলে, সেই ত্রুটি মেরামত করতে করতে অনেক সময় চলে যায়। এছাড়াও আছে লো-ভোল্টেজের সমস্যা। ভারতবর্ষের বহু গ্রামে দিনে যতটা সময় কারেন্ট থাকে, তার বেশিরভাগটাই সিঙ্গল ফেজ -এর বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। এই সব সমস্যার কারণেই ‘দেশের ৯৭ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছনো’র সরকারি পরিসংখ্যান আসলে ততটাও মনোগ্রাহী নয়। ‘বছরে প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টা তিন ফেজ-এর বিদ্যুৎ’ — বিদ্যুৎ পরিষেবা বলতে এটাই।

এখানে উল্লেখযোগ্য, গ্রিডে যে বিদ্যুৎ আসে না, অর্থাৎ বাড়ির সোলার প্যানেল ইত্যাদির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ইত্যাদিকে বিদ্যুৎ পরিষেবা বলে ধরাই উচিত না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তিগত সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের চল আছে, কিন্তু তার গুণমান বেশ খারাপ। একইভাবে, জেনারেটর চালিত বিদ্যুৎকেও ধরা উচিত না, কারণ তা বিশেষ ব্যবস্থা মাত্র। বাড়িতে সোলার প্যানেল বসিয়ে, বা জেনারেটর চালিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে নিজের বাড়ির বিদ্যুৎ নিজেই উৎপাদনের চেষ্টা কেউ করতেই পারেন। তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, ভিন্ন যাপন। কিন্তু গ্রিডের মধ্যে দিয়ে যে বিদ্যুৎ আসছে, সেটাই আমাদের এখানে আলোচ্য। সেটাই সামাজিক বিদ্যুৎ।

এতো গেল, কাকে আমরা বিদ্যুৎ পরিষেবা বলব। কিন্তু সর্বজনীন বিদ্যুৎ পরিষেবা? এটা কিন্তু বিদ্যুতের টেকনিক্যালিটির বিষয় নয়। এটা রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যাপার।

বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে আমাদের বিদ্যুৎ কিনতে হয়। আমাদের বলতে যাদের বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন আছে। ‘মিটার’ নামক যন্ত্রে ওঠে, কতটা বিদ্যুৎ এই মাসে আমরা ব্যবহার করেছি। সেই পরিমাণ বিদ্যুতের নির্ধারিত দাম আমাদের দিয়ে দিতে হয়। বিদ্যুতের বিল বাকি পড়ে গেলে লাইন কেটে দেবার হুমকি সম্বলিত একটি বিল আসে সাধারণতঃ। নানা রাজ্যে নানা সরকারি, এবং কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা এই গ্রিডের বিদ্যুৎ পরিষেবার জন্য নিয়োজিত। আমাদের রাজ্যে যেমন WBSEDCL প্রায় ২.২ কোটি ঘরের বিদ্যুৎ পরিষেবা দেয়, যা সরকারি সংস্থা। আবার কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কিছু অংশে বিদ্যুৎ পরিষেবা দেয় CESC নামে একটি বেসরকারি সংস্থা, যাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ ঘর। বিদ্যুৎ সংযোগের মধ্যে যেমন আছে গৃহস্থালীর পরিষেবা, তেমনি আছে বাণিজ্যিক পরিষেবাও। গৃহস্থালীর পরিষেবা মানে, যা ঘরের প্রয়োজনে। আর বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ লাইন মানে যা ব্যবসায়িক কাজে লাগে, যেমন দোকানের বিদ্যুৎ লাইন। একটি ঘরে গোটা আষ্টেক বাতি ও ফ্যান থাকলে এবং ফ্রিজ টিভি চললে মাসে প্রায় দেড়শ’ ইউনিট মতো বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। এক ইউনিট মানে এক কিলোওয়াট ঘন্টা। একটি রান্না করার প্যাড যদি দেড় হাজার ওয়াটের হয়, তাহলে সেটি দিনে এক ঘন্টা করে চালালে একদিনে ঘরচ হয় দেড় ইউনিট বিদ্যুৎ, মাসে ৪৫ ইউনিট বিদ্যুৎ। এইরকম।

আমাদের দেশে গ্রিড বিদ্যুৎ সমস্ত ঘরে পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প যে প্রায় প্রতিটি সরকারই নিয়েছে, তা আমরা আগেই বলেছি। সেই লক্ষ্যে কখনও কখনও বিদ্যুৎ বিল ফ্রি বা বিনাশুল্ক করেও দেওয়া হয়েছে অনেক সময়। বিশেষ করে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাদপদ মানুষদের জন্য। অনেক সময় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রেও কয়েক মাসের জন্য কিছু ইউনিট বিদ্যুৎ বিনাশুল্ক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ সবই হয়েছে, বিদ্যুৎ গ্রিড-এ যাতে আরো বেশি মানুষ আসে এবং এসে থেকে যায়, তার জন্য। আমাদের দেশে আগে শক্তির ব্যবস্থা ছিল মূলতঃ কাঠ কুটো জ্বালিয়ে, বা কেরোসিন তেল বা রেডির কিংবা সরষের তেলের বাতি জ্বালিয়ে রাখা; হাত পাখা ইত্যাদি। পরে সেখান থেকে বিদ্যুৎ গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে শক্তির বন্দোবস্ত হয়। এই নতুন বন্দোবস্তে যাতে দেশের সব মানুষ আসে তার জন্য কিছু স্কিম হিসেবে ছিল বিনাশুল্ক বিদ্যুৎ।

‘সবার জন্য একটা ন্যুনতম পরিমাণ বিদ্যুৎ বিনাশুল্ক’ — এই ব্যবস্থা সরকারি পরিষেবার মধ্যে প্রথম আনে দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকার। ২০১৯ সালে দিল্লির আপ সরকার ঘোষণা করে, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল বিনাশুল্ক। এবং যাদের বিল ২০০ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত, তাদের বিলের অর্ধেক পরিমাণ বিনাশুল্ক। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে দিল্লির প্রায় ২২ লক্ষ পরিবার পুরোপুরি বিনাশুল্ক বিদ্যুৎ পরিষেবা পেয়েছে, এবং তা প্রায় লোডশেডিং বিহীন। আরো প্রায় আঠারো লক্ষ পরিবার বিদ্যুৎ বিলের অর্ধেক পরিমাণ ভর্তুকি পেয়েছে। এই জন্য খরচ হয় বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো।

এর পর ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে পঞ্জাবে আম আদমি পার্টির সরকার এই বন্দোবস্ত চালু করে। প্রতি মাসে ৩০০ ইউনিট অবদি বিদ্যুৎ বিনাশুল্ক করে দেয়। কোনও ঘর এর চেয়ে বেশি খরচ করলে তাদের ক্ষেত্রে ওই বাড়তি ইউনিট-এর দাম দিয়ে দিতে হয়। সরকারের হিসেব অনুযায়ী, প্রায় নব্বই শতাংশ গৃহস্থালী বিদ্যুৎ গ্রাহক ২০২৩ সালে শুল্কহীন বিদ্যুৎ পরিষেবা পেয়েছে। পঞ্জাবে ৭৪ লক্ষ বিদ্যুৎ গ্রাহকের মধ্যে ৬১ লক্ষ গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল মাসে তিনশ’ ইউনিটের মধ্যে হয়। এই খাতে পঞ্জাব সরকার ২০২৩ সালে খরচ করেছে ৭৭৮০ কোটি টাকা। এছাড়াও পঞ্জাব সরকার ৯৩৩১ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে কৃষকদের বিদ্যুৎ বিল-এ, শিল্পসংস্থাগুলি পেয়েছে ৩,১৩৩ কোটি টাকা ভর্তুকি। পঞ্জাব সরকারের মোট বাজেটের চার শতাংশের মতো খরচ হচ্ছে এই গৃহস্থালীর নিঃশুল্ক ৩০০ ইউনিট বিদ্যুতের জন্য।

এরপর কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার ২০২৩ সালে ঘোষণা করে, ২০০ ইউনিট অবদি বিদ্যুৎ বিল শুল্কহীন হচ্ছে। তবে কর্ণাটক সরকারের এই প্রকল্পে কিছু বিশেষত্ব আছে, যা দিল্লি বা পঞ্জাব সরকারের প্রকল্পগুলির থেকে আলাদা। কর্ণাটক সরকার ২০২২-২৩ অর্থনৈতিক বর্ষে প্রতিটি গৃহস্থালী গ্রাহক কত ইউনিট বিদ্যুৎ গড়ে খরচ করেছে তা হিসেব করে। তার ওপর দশ শতাংশ বাড়তি ইউনিট ধরে, ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ সেই পরিবারের জন্য শুল্কহীন ঘোষণা করে। কারোর বিদ্যুতের বিল যদি তার চেয়েও বেশি হয়, তাহলে সেই বাড়তি টুকুর দাম দিয়ে দিতে হবে তাকে। যেমন, ধরা যাক, ২০২২ সালে কারোর বিদ্যুতের গড় মাসিক বিল ছিল ১২০ ইউনিট। তাহলে তার ওপর দশ শতাংশ ধরে গড় মাসিক নিঃশুল্ক বিদ্যুৎসীমা হবে ১২০+১২=১৩২ ইউনিট। এবার ওই পরিবারের মাসিক বিদ্যুতের খরচ কোনও মাসে যদি হয় ১৫০ ইউনিট, তাহলে বাড়তি ১৮ ইউনিটের দাম দিয়ে দিতে হবে, কিন্তু যদি তা কোনও মাসে ১৩০ ইউনিট হয়, তাহলে তা সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক। কিন্তু কোনও মাসে যদি এই খরচ ২০০ ইউনিটের বেশি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু পুরো ২০০ ইউনিটের দামই দিতে হবে ওই গ্রাহক পরিবারটিকে। কর্ণাটকে প্রায় ১.৯৫ কোটি গ্রাহকের মধ্যে ৮৭-৯৬ শতাংশ গ্রাহক নিঃশুল্ক বিদ্যুৎ পরিষেবা পেয়েছে প্রথম বছরে। গরম কালে যখন এসি ব্যবহারের কারণে বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যায়, তখন তা একটু কমে; আবার শীতকালে যখন বিদ্যুতের খরচ কমে, তখন গ্রাহকের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। এই জন্য কর্ণাটক সরকারকে বছরে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ধার্য রাখতে হয়, যা কর্ণাটক সরকারের বাজেটের পৌনে চার শতাংশের মতো।

অতএব, দিল্লি পঞ্জাব ও কর্ণাটক সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই, সমস্ত গৃহস্থালী গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল-এ ২০০/৩০০ ইউনিট অবদি ভর্তুকি দিতে যা খরচ হয়, তা বাজেটের চার শতাংশের মতো। কিন্তু এই ব্যবস্থায় উপকৃত হয় নব্বই শতাংশ বা তার বেশি গৃহস্থালী। ধরেই নেওয়া যায়, ধনীদের বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি। তাই আন্দাজ করা যায়, যারা উপকৃত হচ্ছে তারা গরীবতর নব্বই শতাংশ। এই ব্যবস্থাটিকে আমরা বলতে পারি, সর্বজনীন বিদ্যুৎ পরিষেবা। আরো পরিষ্কার করে বললে, প্রায় নব্বই শতাংশ নিম্নতর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী পরিবারের গড় সর্বোচ্চ ব্যবহার্য বিদ্যুৎ ইউনিট নিঃশুল্ক; এবং সেই বিদ্যুৎ হতে হবে গ্রিড-এর তিন ফেজ-এর বা উচ্চমানের বিদ্যুৎ, ও লোডশেডিং বিহীন — এটাই হল সর্বজনীন বিদ্যুৎ পরিষেবা। গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে আমাদের দেশের কয়েকটি রাজ্যের সরকার সফলভাবে এই ব্যবস্থা চালু করেছে, তাই এই লোকসভা নির্বাচনে এটা একটি অন্যতম বড়ো নির্বাচনী ইস্যু হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল — তা হয়নি।

একটা কারণ হয়ত, এই ব্যবস্থার মূল রূপকার যে দলটি, তাদের সর্বোচ্চ নেতা ও মাথা অরবিন্দ কেজরিওয়াল -কে জেলবন্দী করে রাখা হয়েছে। তাকে নির্বাচনের প্রচার করতেই দেওয়া হয়নি। আরেকটি কারণ হতে পারে, কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে এই প্রতিশ্রুতিটি রাখেনি, যদিও দু-বছর আগে কর্ণাটকের নির্বাচনে এই প্রতিশ্রুতিটি দিয়ে তারা পালনও করেছিল। এমনকি ২০২৩ সালে মধ্যভারতের নির্বাচনগুলিতেও এই প্রতিশ্রুতিটি দিয়েছিল কংগ্রেস। এবং তেলেঙ্গানায় জিতে আসার পর এই প্রতিশ্রুতিটি তারা পালনও করে; এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মাসে ২০০ ইউনিট অবদি বিদ্যুৎ নিঃশুল্ক করে দেয় কর্ণাটকের মডেল অনুসরণ করে।

এটা ঠিক যে, বিদ্যুৎ পরিষেবা যেহেতু রাজ্য সরকারের এক্তিয়ার, তাই লোকসভা ভোটে এটার কথা তোলা হয়ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি ক্ষমতার রাজনীতির দলগুলি। কিন্তু দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলতেই পারে, কেন চার পাঁচটি রাজ্যই কেবল এই সর্বজনীন বিদ্যুৎ পরিষেবা পাবে? কেন গোটা দেশ পাবে না? বিদ্যুতের নীতি নির্ধারণ হয় তো কেন্দ্রীয়ভাবে। তাহলে, দেশের সাধারণ নির্বাচনে কেন ইস্যু হবে না সর্বজনীন বিদ্যুৎ পরিষেবা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *