[২০১১ সালের আগস্ট মাসে পরিবেশবিদ মাধব গ্যাডগিলের নেতৃত্বাধীন একটি সরকারি কমিটি পশ্চিমঘাট পর্বতের বাস্তুতন্ত্র বিষয়ে তাদের রিপোর্ট জমা দেন ভারত সরকারের কাছে। কিন্তু সেই রিপোর্ট অনুয়ায়ী কিছুই হয়নি, বরং মাধব গ্যাডগিল-এর দুর্নাম করা হয়েছিল উন্নয়নবিরোধী এবং জনবিরোধী বলে। এবং ২০১৩ সালে ওই কমিটিকে প্রতিস্থাপিত করে আরেকটি কমিটিকে দিয়ে (কস্তুরীরঙ্গন কমিটি) আরেকটি রিপোর্ট বানানো হয় যাকে পশ্চিমঘাট ধ্বংসের দলিল বলে চিঠি লিখেছিলেন মাধব গ্যাডগিল। আজ কর্ণাটক সীমান্তের খুব কাছে কেরালার ওয়েনাড়ে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিধসে যখন বহু শত মানুষ নিহত, তখন মাধব এবং তার রিপোর্টের কথা অন্ততঃ মিডিয়ায় এসেছে। মূল প্রতিবেদন ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ বেরিয়েছে ৩ আগস্ট। বাংলা অনুবাদ ঈষৎ সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত। সঙ্গের ছবি ইন্টারনেট থেকে পাওয়া।]
৩০ জুলাই ভোরে, কেরালার ওয়েনাড জেলার মেপ্পাদির শান্ত পাহাড়গুলি পর পর মারাত্মক ভূমিধসে বেঁকেচুড়ে গেছে। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত গ্রামগুলি – মুন্ডাক্কাই, চুরালমালা, আত্তামালা এবং নুলপুজা – বিশাল ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায়। কমপক্ষে ৩০০ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং অগণিত আরও নিখোঁজ। উদ্ধারকারীরা বন্ধ রাস্তা, নড়বড়ে মাটি এবং এবং ভঙ্গুর ভূখণ্ড-র বিপদ-এর সম্মুখে।
এটি এমন একটি ট্র্যাজেডি যা ভারতীয় সমাজে গরীব এবং ধনীর মধ্যকার ভয়ানক গর্তটিকে বেআব্রু করে দিয়েছে। মুন্ডাক্কাই পুথুমালা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে, ২০১৯ সালে যেখানে প্রায় একইরকম বিপর্যয় ঘটেছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে তখন যেতে পেরেছিলাম অকুস্থলে। প্রচন্ড বৃষ্টিতে এক ঘন্টার বেশি গাড়ি চালানোর পর, আমরা একটি পাকদণ্ডী রাস্তায় ওয়ানাডের পাহাড়ে উঠতে শুরু করি। খাড়া ঢালে উঁচু দালান ও জমি ছিল যা চা বাগানের জন্য সমতল করা হয়েছিল। পুরো রাস্তাটা ভূমিধসের কাদায় ঢেকে গেছিল। ভূমিধস থেকে কাদামাটির ধারা প্রায় দেড় কিলোমিটার নিচু পর্যন্ত বেয়ে এসেছে, বেশ কয়েকটি ছোট শাখা প্রবাহ-ও তৈরি করেছে। কয়েক ফুট কাদামাটি গিরিখাতের একেবারে নিচের চা-বাগান শ্রমিকদের পঞ্চান্নটি ঘর সম্পূর্ণরূপে পুঁতে ফেলেছে, ওই জায়গাটিতে মানুষের বসতি একেবারেই অনুপযুক্ত। কাদামাটির এই নদীটি তার নিষ্ঠুর স্রোতে ইউক্যালিপটাস বাগানের কোনও চিহ্ন রাখেনি, তবে একটি গাছ তার পথে গর্বিত এবং খাড়া দাঁড়িয়ে ছিল: ফিকাস বেডডোমেই, এই ভূখন্ডের নিজস্ব গাছ। এতে বোঝা গেছিল, ইউক্যালিপটাসের মতো বহিরাগত গাছেদের দিয়ে ভূখন্ডের আসল প্রাকৃতিক গাছগুলিকে প্রতিস্থাপন করা এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল।
চা-বাগানের শ্রমিকদের এইভাবে খাদের একেবারে নিচে থাকতে দেওয়া — এটাই বলে দেয় ইংরেজ শাসন চেপে বসার পর থেকে ভারতের বন ও ভূমি শাসন পরিচালনার ইতিহাস কেমন। তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, কীভাবে এই গাছের সমুদ্রের মতো দেশটিকে, যেমন ব্রিটিশ আমলের প্রথমদিকের ভ্রমণকাহিনীগুলিতে লেখা হয়েছিল আর কি, তারা শাসন করবে বা বলা ভালো লুঠ করবে। বনবাবুদের কাছে বড়ো প্রশ্ন ছিল, বনের গ্রামসমাজগুলির জঙ্গলের কতটা এক্তিয়ার আর থাকা উচিত, এবং কতটা রাষ্ট্র দখল করে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলবে। অনেক ব্রিটিশ বনবাবুর মত ছিল, জঙ্গল গ্রামসমাজগুলির এক্তিয়ারে যেমন আছে তেমনই থাকুক। ঝুম চাষ ছিল সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। ওই সময় তো তা খুবই চলত। লোকে বনের মধ্যেকার কাজে লাগা গাছগুলি বাদ রেখে বেশিরভাগ গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলে সেখানে বছর দু-তিন ধরে বাজরা লাগাত। তারপর তারা অন্য আরেক জায়গায় চলে যেত। পনেরো কুড়ি বছর ধরে আগের জমিটা ফাঁকা থাকত, ফলে আবার গাছের আচ্ছাদন ফিরে আসত সেই জমিতে। ব্রিটিশ চা-ও-কফি বাগিচা মালিকরা এই ঝুম চাষের বিরোধিতা করে কারণ এটা জোর করে বন্ধ না করলে তারা তাদের চা-কফি এস্টেটগুলির জন্য শ্রমিক পাবে না। এই এস্টেট মালিকরা চাইত দাসের মতো শ্রমিক; রে বাবা, তখন ওদেরই জাতভাইরা তো উত্তর আমেরিকায় কৃষ্ণবর্ণ দাসেদের দিয়ে রেশম চাষ করাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল দেশের জনগণকে সম্পদহীন করা; ব্রিটিশ মালিকানাধীন চা ও কফির বাগানের জন্য এবং সামরিক ও নির্মাণের জরুরি কাঠের বাগানের জন্য বনভূমিগুলিকে উৎসর্গ করা।
ওয়েস্টার্ন ঘাট ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল (ডব্লিউজিইইপি) এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে ভারতে যা ঘটছে তার একটি বাস্তব চিত্র এঁকেছিল। আমাদের প্রতিবেদনের থিম ছিল যে ভারত সহ যে কোনও দেশকে চারটি মূলধনের স্টক হিসাবে দেখা যেতে পারে, যথা, প্রাকৃতিক (জল, গাছপালা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, পশুপালন, মাছ উৎপাদন), সামাজিক (সহযোগিতামূলক আচরণ, নিরাপত্তা বোধ) , মানব (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান) এবং মানবসৃষ্ট মূলধন। ভারত একচেটিয়াভাবে প্রাকৃতিক, মানবিক এবং সামাজিক মূলধনের বিনিময়ে উচ্চ ভর্তুকিতে মানবসৃষ্ট মূলধন গড়ে তোলার দিকে মন দিয়েছে। এবং এতে করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত এবং স্বাস্থ্য বৈষম্যর হাল আরও খারাপ হচ্ছে। তাতে যেটা হচ্ছে, সামগ্রিক সামাজিক কল্যাণের অবনমনের পাশাপাশি আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ক্ষমতাকে খর্ব হচ্ছে। এতে মরিয়া হয়ে পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল সহ সর্বত্র পাহাড়ের ঢালে খনি এবং কোয়ারি, রাস্তা এবং বিল্ডিংয়ের মতো মানুষী হস্তক্ষেপের ঘটনা বাড়ছে ও আরো তীব্র হচ্ছে।
এই দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনার একমাত্র উপায় হল এগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য WGEEP-এর খসড়া নির্দেশিকা অনুসরণ করা এবং সেইসাথে তিনটি ভিন্ন স্তরের পরিবেশগত সংবেদনশীলতা — উচ্চ, মাঝারি এবং নিম্ন-সহনশীল অঞ্চলগুলির ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কার্যক্রমেরও স্তরবিভাজন করা। WGEEP নির্দেশিকাগুলি চূড়ান্ত, কঠোর প্রেসক্রিপশন নয় বরং এটা ছিল গ্রাম সভা থেকে শুরু করে নিচ-থেকে-ওপর পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যে।
সরকারগুলি এই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেয়নি কারণ তাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং মানুষকে সক্ষম করার কোনও আগ্রহ ছিল না। …