প্রশ্নোত্তরে প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়েলের যুদ্ধ (২০২৩) : প্যালেস্তাইনের মুক্তি-সংগ্রাম কি মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক রাজনীতির বোড়ে হয়ে যায়নি ?

ইজরায়েলের প্যালেস্তাইনের ওপর যুদ্ধ শুরু হয়েছে ৮ অক্টোবর, যার পোশাকি নাম ‘লোহার তরোয়াল’ । তাতে এখনও অব্দি ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গাজা ভূখণ্ডে প্রায় সাত হাজার মানুষ মারা গেছে যাদের প্রায় সবাই নিরস্ত্র নাগরিক, এবং প্রায় অর্ধেক অপ্রাপ্তবয়স্ক। আমরা কিছু প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে এই যুদ্ধ সম্পর্কে জানাবোঝা করতে চাইছি। পাঠকদের কাছে আবেদন, আরো প্রশ্ন করুন, এবং উত্তরগুলি সম্পর্কে মতামত দিন। প্রথম পর্ব এবং দ্বিতীয় পর্ব আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এটা তৃতীয় পর্ব। সঙ্গের ছবিটি জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের, উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া। — সম্পাদকমণ্ডলী।

৮) আশেপাশের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলি থেকেও ইজরায়েলের ওপর রকেট ছোঁড়া হচ্ছে শুনছি ?

ইজরায়েল এবং অধিকৃত প্যালেস্তাইনের আশেপাশের দেশগুলি প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুতে ভর্তি1। জর্ডনে বাস্তুচ্যুত প্যালেস্তাইনিদের সবচেয়ে বড়ো অংশটা থাকে, প্রায় কুড়ি লক্ষ। প্যালেস্তাইন থেকে প্রথম বাস্তুচ্যুতি শুরু হয় ১৯৪৮ সালে, যখন ইজরায়েলি মিলিশিয়ার আক্রমণে এবং গ্রাম ধ্বংসের কারণে প্যালেস্তাইনের প্রায় অর্ধেক মানুষ (সাত লক্ষ) উদ্বাস্তু হয়। এই ঘটনাকে বলে নাকবা। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সালে যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছিল প্যালেস্তাইন থেকে, তাদের অনেকেই জর্ডনে চলে আসে। তারা জর্ডনের নাগরিক হয়ে জনজীবনে মিশে গেছে এখন। বাস্তবতঃ জর্ডনের এখনকার যিনি রাণী, তিনি নিজেই প্যালেস্তাইনি বংশোদ্ভুত। যদিও ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল গাজা, জেরুজালেম ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দখল করার পর (এই ঘটনাকে বলে নাকসা) গাজা ভূখণ্ডের আশেপাশের এলাকা থেকে জর্ডনে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা প্যালেস্তিনীয়রা জর্ডনের নাগরিকত্ব পায়নি এবং এই মহল্লাগুলিতে হামাসের জনসমর্থন প্রবল, কিন্তু মার্কিন অনুদানে চলা জর্ডন রাজত্বে হামাস বা অন্যান্য জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ, এমনকি প্যালেস্তাইনের পক্ষে মিছিল মিটিং-ও নিষিদ্ধ2

লেবাননেও কয়েক লক্ষ প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু থাকে, যাদের বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালের নাকবায় চলে আসা, আর কিছু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে (২০১১-১৭) সিরিয়া থেকে ফের উদ্বাস্তু হয়ে লেবাননে চলে চলে আসা। লেবাননে প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুদের অধিকার অনেক কম এবং কিছু জঙ্গী সংগঠন এখানে কাজ করে। ১৯৬৭ সালে নাকসার পর থেকে প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু অংশ সংগঠিত হয়েছিল লেবাননের মাটি থেকে, এই সময় ইজরায়েল লেবাননের একাংশ দখল করে নেয় ও পরে সরে আসে। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী লেবাননে জঙ্গী ইসলামিস্ট গোষ্ঠী হিজবুল্লার সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধ হয় ২০০৬ সাল থেকে। ২০২৩ এ অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, অর্থাৎ ইজরায়েলের গাজা আক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হানা শুরু হয়েছিল ইজরায়েল-লেবানন সীমান্তে, উভয় পক্ষই তাতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু নভেম্বর মাসের শুরুতে হিজবুল্লা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, হামাসের প্রতি সংহতি থাকলেও ইজরায়েলের সঙ্গে তারা যুদ্ধ শুরু করছে না; যদিও ইজরায়েলের উসকানি ভালোই ছিল।

সিরিয়ার ইজরায়েল সংলগ্ন এলাকা গোলান হাইটস ইজরায়েল বহুদিন হল দখল করে রেখেছে। এছাড়া সিরিয়াতে প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুও থাকে প্রচুর। গোলান হাইটসে সিরিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়াতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইজরায়েল সিরিয়াকেও উসকানি দিয়েছিল যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য। কিন্তু সিরিয়া থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনও খবর নেই।

মিশরের সঙ্গে দক্ষিণ গাজার সীমান্ত আছে, রাফা ক্রসিং নামে। ইজরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর মিশর সেই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরের মিটিং ডেকেছে একদিকে, অন্যদিকে রাফা ক্রসিং বন্ধ করে দিয়ে ওষুধ, তেল ইত্যাদি সরবরাহ যাতে না হয় অবরুদ্ধ গাজাতে, সে ব্যাপারে ইজরায়েলের সাথে সহযোগিতা করেছে। এমনিতে মিশর ইজরায়েলের মিত্র রাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং শান্তিচুক্তি করার ব্যাপারে মিশর প্রথম সারির। মিশরে প্যালেস্তিনীয় শরণার্থী কিছু আছে। কিন্তু হামাস বা প্যালেস্তিনীয় রাজনীতি মিশরে নিষিদ্ধ, এমনকি প্যালেস্তাইনের পক্ষে মিটিং মিছিলও নিষিদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় মিশর রাফা ক্রসিং কিছুটা খুলে দিয়ে আহত গাজাবাসীর চিকিৎসা, গাজায় ওষুধ ও অন্যান্য দরকারি জিনিস সরবরাহের আন্তর্জাতিক পথ করে দেওয়া — এসব কিছুটা করছে, তবে অনেক দেরি করে। ইজরায়েলের সঙ্গে কোনও ধরনের যুদ্ধেই মিশর যাচ্ছে না।

এই প্রত্যেকটা দেশেই সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে প্যালেস্তিনীয়দের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে, তাই তাদের মন রাখতে এই সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মৌখিকভাবে ইজরায়েলের নিন্দা করছে বা ইজরায়েলের সঙ্গে দৌত্যের সম্পর্ক স্থগিত করছে ইত্যাদি। এইসব আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া এইসব রাষ্ট্র কোনও ভাবেই ইজরায়েলের সঙ্গে কোনও সংঘাতে যাচ্ছে না, বরং নিজেদের দেশে প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষে মিছিল মিটিং কম বেশি আটকাচ্ছে।

৯) কিন্তু ইরান তো সরাসরি জড়িত, তাই না ?

সাত-ই অক্টোবরের হামাসের হামলায় ইরান সরাসরি জড়িত এরকম একটা খবর হয়েছিল ইজরায়েলি এবং মার্কিন মিডিয়ার তরফে। কিন্তু ইরান তা অস্বীকার করে এবং মার্কিন রাষ্ট্র-ও জানায়, এটা সত্যি নয়। ইরানের রাষ্ট্রপ্রধানরা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গরম গরম অনেক কথা বললেও ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে কোনওভাবে অংশ নিচ্ছে না। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পর থেকে ইরানের সঙ্গে প্যালেস্তিনীয় সংগঠনগুলির সম্পর্কও ভালো নয়, যদিও হামাসের হামলা ও প্যালেস্তিনীয় মুক্তি সংগ্রামকে সামগ্রিকভাবে সমর্থন করছে ইরান

১০) কিন্তু প্যালেস্তিনীয় মুক্তি-সংগ্রামের সঙ্গে ইসলামিক রাজনীতির তো একটা সংহতি আছে ?

হামাস সহ প্যালেস্তিনীয় জঙ্গী সংগঠনগুলির বেশিরভাগই ইসলামিস্ট এবং ইসলামিক রাষ্ট্র এবং আইন বানাতে চায়। ইরানে চার দশক আগে ইসলামিক বিপ্লবের পর সেখানকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে ইসলামিস্ট রাজনীতি, এবং তারা ইসলামিক আইন অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। কিছুদিন আগেই হিজাব না পরা নিয়ে ইরান উত্তাল হয়, হিজাব না পরার অপরাধে কারাদণ্ড ও আরো কড়া সাজার মুখে পড়তে হয় স্বাধীনভাবে বাঁচার দাবিতে আন্দোলনরত মেয়েদের। লেবাননের জঙ্গী সংগঠন হেজবুল্লাও ইসলামিস্ট রাজনীতির, যদিও মিশ্র জনবসতির লেবানন রাষ্ট্র হিসেবে সব ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী। সিরিয়া রাষ্ট্র ইসলামিস্ট নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম, এটা ঘটনা। ইসলামিক রাজনীতি এই মুসলিম সত্ত্বার ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠা। গত পঞ্চাশ বছরে মধ্যপ্রাচ্যে এই রাজনীতির প্রভাব ভালোই বেড়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য তথা সারা পৃথিবীর ইসলামিক রাজনীতির সঙ্গে প্যালেস্তিনীয় মুক্তি-সংগ্রামের একটা সংহতি আছে। যদিও সৌদি আরব ও ইরানের ইসলামের গোষ্ঠী সত্ত্বা এক নয় এবং ইসলামিক রাজনীতির মধ্যে গোষ্ঠীগত ভাগাভাগি আছে।

এছাড়া ইজরায়েল হল ঘোষিত ইহুদি রাষ্ট্র। ইহুদি ধর্মের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের প্রাচীন বৈরিতারও কিছু ইতিহাস আছে। পূর্ব জেরুজালেম মুসলিম ও ইহুদি উভয়েরই পবিত্রভূমি। সেখানে পবিত্র স্থানের দখল নিয়ে মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে বিরোধ আছে। এই অংশ ইজরায়েলের অধিকৃত হলেও পবিত্র স্থানের মসজিদ আল-আকসা, তার চারপাশে প্যালেস্তিনীয় তথা মুসলিম বসতি, এবং সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষ-র। এই মসজিদকেই আবার ইহুদিরা নিজেদের পবিত্রতম ধর্মস্থান টেম্পল মাউন্ট বলে। আল-আকসায় ইহুদি রক্ষণশীল রাজনীতিকদের প্রবেশ আশেপাশে বসবাসকারী মুসলিম প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে ও পবিত্র ধর্মস্থান বাঁচানোর জন্য জিগির তোলা হয়। ২০০০ সালে ইজরায়েল প্যালেস্তাইন শান্তি আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর ইজরায়েলের কট্টরপন্থী রাজনৈতিক নেতারা ওই মসজিদ চত্বর পরিভ্রমণে আসলে পবিত্র ধর্মস্থান বাঁচানোর জিগির উঠেছিল। দ্বিতীয় অভ্যুত্থান বা ইন্তিফাদায় বারুদে অগ্নিসংযোগের কাজ করে এই ঘটনা। সম্প্রতি প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষের শক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও জেরুজালেমে ইজরায়েলি নিরাপত্তাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও ইজরায়েলি সেটলমেন্ট বেড়ে যাওয়ার ফলে আল-আকসা মসজিদ ইজরায়েল দখল করে নেবে, এরকম একটা আতঙ্ক প্যালেস্তিনীয় মুসলিমদের মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছিল। কট্টর ইহুদি রাজনীতিকদের ভালোই ইন্ধন ছিল বা আছে এই আতঙ্কের পেছনে3। ২০২২ সালে আল-আকসা মসজিদে ইজরায়েলি কট্টরপন্থীদের ছাগল বলি-র গুজব নিয়ে দাঙ্গা হয়েছিল, স্থানীয় প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে ইজরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পেছনে এই ঘটনাও যে দায়ী, তা হামাস বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল। ফলে প্যালেস্তিনীয় মুক্তিসংগ্রামে ইসলামিক রাজনীতির প্রভাব এখন নির্ধারক। এবং আশেপাশের দেশগুলির বা সারা বিশ্বের ইসলামিক রাজনীতির সংহতি তাই আশ্চর্যের কিছু নয়।

কিন্তু প্যালেস্তিনীয় মুক্তি-সংগ্রাম ইসলামিক রাজনীতির আভ্যন্তরীন বিষয় নয়, বরং তা ছাপিয়ে। তা একটি জাতিসত্ত্বার বিলীন হয়ে যাবার বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ, কষ্টকর এবং আত্মত্যাগে পরিপূর্ণ এক লড়াই। সেই কারণেই পৃথিবীর নানা দেশের বহু মানুষ, যারা প্যালেস্তিনীয় নয়, ইসলামিস্ট নয়, মুসলিম নয় — তারাও প্যালেস্তিনীয় মুক্তি-সংগ্রামের সংহতিতে রয়েছে। সারা পৃথিবীতে বহু মিছিল তারা করে চলেছে, যেগুলি শুধু ইজরায়েলের নৃশংস যুদ্ধ (২০২৩) বন্ধ করার দাবি তুলেই ক্ষান্ত থাকছে না, একইসাথে প্যালেস্তাইনকে ইজরায়েলের অবরোধমুক্ত করার দাবিও তুলছে। ইহুদিরাও বড়ো সংখ্যায় এই দাবিতে সামিল হয়েছে। ইজরায়েলকে মার্কিন অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য বন্ধ করা ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে মার্কিন শহর ওয়াশিংটনে গতকালই প্রায় তিন লক্ষ মানুষ মিছিল করেছে, একইসাথে আমেরিকা ও ইউরোপের নানা জায়গাতে মিছিল হয়েছে।

চলবে

টিকা

  1. প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু সম্পর্কে একটি ভালো লেখা এই বিষয়ে একজন গবেষক-এর। ↩︎
  2. জর্ডন-এ হামাস নিষিদ্ধ সেই ১৯৯৯ সাল থেকে । সম্প্রতি ইজরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর থেক প্যালেস্তাইনের পক্ষে মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ↩︎
  3. এই প্রসঙ্গে আমাদের দেশে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির নির্মাণের জন্য করসেবা করার কথা মনে পড়া আশ্চর্য কিছু নয়। ↩︎

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *